তবে সন্ধের পরের সময়টায় হাত-পা ঝাড়া অখণ্ড অবসর। এ অবসরে রান্নার ফুরসত আমার।
দামার হারসান্তো রান্নায় পটু। তবে সেটা ইন্দোনেশিয়ান খাবার। সেখানে কোনও মশলা নেই। সে আবার ধর্মে ক্যাথলিক। খাবারেও তেমন কোনো বাছবিচার নেই। শূকর, গরু, মুরগী, চিংড়ি সবই তার চলে। তবে কোনো বেলাতেই তার চলে না নুডলস ছাড়া। ভাতের সঙ্গে নুডলস মিশিয়ে কিভাবে খেতে হয় সেটাও আমার দিব্যি শেখা হয়ে গেছে ওর কাছ থেকে। আমার রান্না করা ডাল ওর কাছে তেতো লাগে। মুখে পুরেও গিলতে পারে না। আমি ভেবেছিলাম সেটা খুবই সুস্বাদু। তবে রান্না করার কষ্টে ওর রান্না করা যে কোনো খাবারকেই আমার কাছে মনে হয় পরম উপাদেয়। তবে অবশ্যই চিংড়ি আর কাঁকড়া ছাড়া।
* জেনেট স্ট্যালিনের ক্লাস:
ফেলোশিপের প্রথম মোচড়টা দিলেন জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক জেনেট এস স্টিল। দেশে সাংবাদিকতার ওয়ার্কশপগুলোর গৎবাঁধা কিছু নয়, বরং সাংবাদিকতায় লেখার সীমাকে বড় করে দিলেন। গল্পচ্ছলে রিপোর্টিং, দেখা থেকে লেখা, সাংবাদিকের নিজেকে উপস্থাপন করার হরেক মনকাড়া উপায় --- এসবের ওপর পুরোপুরি রোমাঞ্চকর ক্লাস।
বাংলাদেশে বাংলানিউজের লেখার স্টাইলের সমালোচনা করেন কেউ কেউ। তবে এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেন যে কতটুকু এগিয়ে বাংলাদেশের সনাতন সাংবাদিকদের তুলনায় সেটা বুঝিয়ে দিলেন জেনেট। আমি তাকে বাংলানিউজের কিছু রিপোর্টের উদাহরণ দিলাম এবং বললাম যে গত ৮ বছর ধরেই আমরা এ ধরনের লেখার প্র্যাকটিস করে আসছি। এশিয়ার অন্য ফেলোরা একটু অবাকই হলেন! তারা নিজেরাও এ ধরনের লেখার সঙ্গে পরিচিত নন। বরং গৎবাঁধা ইন্ট্রো আর তথ্যের বাধা ছকের ভেতরেই এখনও ঘুরপাক খাচ্ছেন তারা।
হোমওয়ার্কের পালা। জেনেটের হোমওয়ার্ক নিয়ে চিন্তিত সবাই। কিভাবে কি করবে! কিভাবে লিখবে! কার ইন্টারভিউ নেবে! প্রথম ক্লাসে নিজের সেরাটুকুই জাহির করতে কে না চায়!
* ধূমপান কি তবে ছাড়তেই হবে!
ন্যারেটিভ রাইটিংয়ের(বর্ণনামূলক লেখার)এই হোম ওয়ার্ক আমাকে কেন জানি ভাবিত করলো না। ক্লাশ শেষে নানিয়াং ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার পথে এমআরটি স্টেশনে নামার পর একটা সিগারেট ধরালাম। আর ভাবলাম সিগারেটের অভিজ্ঞতা নিয়েই লিখবো। পরের দিন সকালে ক্লাশের অন্য সবাই ভারি ভারি বিষয় নিয়ে হাজির। আমি উপস্থাপন করলাম আমার গল্প---সহজ সাবলীল গল্প।
"মেনথল সিগারেট এর আগে আমার কাছে এতো স্বাদের কখনো মনে হয়নি। এই ধরনের মশলা মেশানো মিষ্টি সিগারেট টেনেছিলাম ১৭ বছর আগে ক্লাস নাইনে পড়ার সময়। স্কুলের পেছনের মাঠে গিয়ে লুকিয়ে সিগারেট টানতাম। সিঙ্গাপুরের সিগারেট নয় এটা। সিঙ্গাপুরে অবস্থান করা আমার এক বন্ধু সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়া ঘুরে এসেছে। সেখান থেকেই এ সিগারেট এনেছে। তবে এখন এই ‘সুরিয়া’ (বাংলায় যাকে বলি ‘সূর্য’) সিগারেট টেনে আমার কাছে মনে হচ্ছে ধোঁয়ার নেশাটা তো মেটানো গেল, যেখানে এক প্যকেট মার্লবোরো সিগারেটের দাম ১৩.১০ ডলার (৮০০ টাকা)। বাংলাদেশে এই টাকায় তিন প্যাকেট মার্লবোরো কেনা যায়।
পাইওনিয়ার এমআরটি স্টেশনে নেমে হাতের ডানে মোড় ঘুরে ১০০ মিটার হাঁটলেই বাস টার্মিনালের পাশে সিগারেট ফোঁকার জায়গা রয়েছে। এই কাঠফাটা গরমে ঠাণ্ডা সিগারেট কেমন যেন কোল্ড ড্রিংকসের মতো লাগল। তবে আমি বেনসন বা ডানহিলের মতো সিগারেট খেতে চাই মনে মনে, যেটা কফির মতো কাজে দেবে।
গত ১০ দিনে আমার সিগারেটের নেশা অর্ধেকে নেমে এসেছে। এদেশে যেখানে সেখানে সিগারেট টানা যায় না। এমনকি কেন্ট ভেলের অ্যাপার্টমেন্টেও আমি আর দামার হারসান্তো বারান্দায় গিয়ে সিগারেট টানি। মনের ভেতর ভয় কাজ করে, যদি জরিমানা গুনতে হয়!
দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় একবার মায়ের কাছে সিগারেট নিয়ে ধরা খাই। তার মাথা ছুঁয়ে শপথ করেছিলাম আর ধূমপান করবো না। তবে সে শপথ আমি রাখতে পারিনি এবং ইচ্ছেও হয়নি। তবে আমি ঠিকই বিমানে ভ্রমণ করার সময় ৮ থেকে ১০ ঘন্টাও ধুমপান না করে থেকেছি। এছাড়া ঘুম ছাড়া অন্য কোনো সময় এতো অপেক্ষা করিনি। মনে আছে একবার সিগারেট টানতে গিয়ে মালয়েশিয়ায় ফ্লাইট মিস করেছিলাম।
বাংলাদেশেও তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পাস হয়েছে। তবে কার্যকর করার বেলায় রয়েছে গাফিলতি। সেটা আমাকে দিয়েও উদাহরণ দেয়া যায়। ২০১৩ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ সাংবাদিকতায় পুরস্কার লাভ করি আমি। তামাকের বিরুদ্ধে প্রচুর লেখালেখি করলেও আমি সিগারেট ছাড়িনি। আমি নিজে ধূমপানের অভ্যাস বরং আরো বাড়িয়েছি না ছেড়ে দিয়ে। এছাড়াও ঢাকায় আমার কখনোই মনে হয়নি, ধূমপানের কারণে আমার জরিমানা হতে পারে বা এটা অপরাধ।
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের সেন্ট্রাল লাইব্রেরির দেয়ালে ধূমপানের জরিমানা হিসেবে ১০০০ ডলারের কথা উল্লেখ ছিল। সেটা দেখে আমার চক্ষু চড়ক গাছ। আমাকে কেউ ১০০০ ডলার জরিমানার টাকা হাতে দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে দিলেও তো আমার পক্ষে টানা সম্ভব হবে না।
তবে ধীরে ধীরে ভয় কেটে উঠছে। প্রথম এরাব স্ট্রিটে দেখলাম পথের অস্থায়ী বারগুলোতে বসে নিশ্চিন্তে সিগারেট টানা যায়। আরো কয়েক জায়গাতেও চোখে পড়ে দেয়ালে ‘নো স্মোকিং’ লেখা থাকলেও স্থানীয়রা নিশ্চিন্ত মনে ধূমপান করে যাচ্ছে। আমার এখন মোটামুটি বোঝা হয়ে গেছে, কোথায় সিগারেট টানা যাবে আর কোথায় যাবে না। সিগারেটের স্বাস্থ্যগত ক্ষতি, পরোক্ষ ক্ষতি ও আর্থিক ক্ষতি রয়েছে। সবকিছু জেনেও ঢাকায় আমি সিগারেট ছাড়তে পারিনি। তবে এখানে আইনের কঠোর প্রয়োগ আমাকে ভাবাচ্ছে এবং যে কোনো মুহূর্তে শত ডলার জরিমানা দিতে হতে পারে সেটাও মাথায় থাকছে। আমি ধরে রেখেছি যে কোনো সময় দুশো ডলারের মতো আমাকে জরিমানা দিতে হতে পারে। তবে তার বেশি দিতে হলে আমাকে সত্যিই ধূমপান ত্যাগ করতে হবে। "
আমার রিপোর্টের শিরোনাম ছিল, 'প্রতিজ্ঞা থেকে ভয় যখন শক্তিশালী। '
সবার রিপোর্টের পর বিবেচনায় সেরা রিপোর্ট বলা হলো আমার লেখাকে। জেনেট বললেন, এটা সিঙ্গাপুরের পত্রিকাতেও ছাপানো যাবে। তাদের আইন কতটুকু কার্যকরী তার ছায়া পাবে আবার বাংলাদেশে ছাপালে সরকার বুঝবে সমস্যাগুলো কোথায়!
* সাঁতার আর জগিংয়ে ক্ষান্ত দিলাম
কেন্ট ভেলে প্রথম দিকে দ্রুত ঘুম ভেঙ্গে যেতো। সময়ের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। আর এখানে জানালার রোলস্ক্রিন পর্দাও সকালে দীর্ঘ ঘুমের জন্য উপযোগী নয়। তাই ভোরে উঠে চৈতন্যর সঙ্গে দৌড়ানোর অভ্যাস করেছিলাম। এছাড়াও শেষ রাতে সুইমিংয়ের। তবে ব্যস্ত দিনের আগে আর পরে এই বাঙালি শরীর সেসব সুঅভ্যাস ত্যাগ করলো। বরং ক্লাস শেষে সন্ধ্যায় আড্ডা আর সকালে যতটা সম্ভব ঘুমানোই শ্রেয় ভাবলাম। দামারো আমার মতোই ক্ষান্ত দিলো সব শারীরিক কসরত। এখন আর রুমের জানালা দিয়ে কোনো সুন্দরীকে সুইমিংপুল পাড়ে দেখলেও পানিতে ঝাঁপাতে যাই না আমরা।
* রহস্যময়ী লরি
লাওসের একমাত্র ইংরেজি ও সরকারি সংবাদ সংস্থা ভিয়েনচেন টাইমসের রিপোর্টার পাতিতিনের সঙ্গে সখ্য বেড়ে ওঠে আমার। সে নেপালের সেতোপাতি দৈনিকের রিপোর্টার গিরীশ গিরির ফ্ল্যাটমেট হলেও বেশিরভাগ সময় আড্ডা দ্যায় আমাদের রুমে এসে।
ন্যারেটিভ রিপোর্টিং ক্লাসের শেষ দিন সকালে নাস্তার টেবিলে পাতিতিন বললেন, তার বান্ধবী আসছেন আজ। গার্লফ্রেন্ড কিনা জানতে চাইলে মুচকি হাসেন। বছর দুই আগে লাওসে রিপোর্টিংয়ের কাজে গেলে কংয়ের সঙ্গে পরিচয় হয় লরির। তারা কয়েকদিন একসঙ্গে ছিলেন এবং কং প্রেমে পড়েন। তবে লরি ছুটে চলা তরুণী। কোথাও মন বসেনি। ফ্রি ল্যান্স রিপোর্টিং করেন, কিছু আয় হলে ছুটে যান অন্য কোনো দেশে। সেখানকার জীবনবৈচিত্র নিয়ে রিপোর্ট করেন।
লরি এলেন। হাতে-পায়ে-পিঠে চমৎকার সব ট্যাটু। কথা বলেন চমৎকার ইংরেজিতে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে রিপোর্টিং এবং ঘোরার অভিজ্ঞতা শোনান আমাদের। সেই রাতে সকলের জন্য রান্না করেন লরি এবং কং।
পরের দিন থেকেই লরি হয়ে উঠলেন এখানকার সবচেয়ে আলোচিত চরিত্র। রাতে লরি কোথায় ছিলেন? যদি কংয়ের সঙ্গে থেকে থাকেন, তাহলে গিরি কি তার রুম ছেড়ে দিয়েছিল? কংয়ের সঙ্গে সম্পর্কটা আসলে কি? পরের দিনের ন্যারেটিভ রাইটিংয়ে বলা হলো সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য। ভিয়েতনামের হাওং মি'তো লরির সাক্ষাৎকার উপস্থাপন করলেন ক্লাসে। আলোচনার মুখ্য চরিত্র হয়ে উঠলেন লরি। পরের কয়েকটা দিন এমনকি এখনো লরি আলোচনায় এক রহস্যময় চরিত্র।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১২, ২০১৭
এমএন/জেএম