নদীর জল হেলেদুলে বয়ে চলে অদেখা হাওয়ার ছোঁয়ায়। হাওয়ার আরেক নাম বায়ু।
তেমনি এক সুরবালিকার গল্প জানা যাক। কুষ্টিয়া অঞ্চলে হিসনা নামে এক নদী আছে। সেই নদীর পাড়ের গঙ্গারামপুর গ্রামেই সুরবালিকা মৌসুমীর জন্ম। উঠানের সাদামাটির বুকে বেণী দুলিয়ে ফড়িংয়ের মত উড়ে বেড়াতো সেই মেয়েটি। হঠাৎ হঠাৎ প্রিয় হিসনা নদীতে বন্ধুদের সঙ্গে দে ঝাপ। এভাবেই কাটে তার দিনকাল। বাতাসে আর জলে ভর করে কোন এক ভাটির দেশের সুর উজানে নিয়ে আসতো হিসনা, বোঝা দায় ছিলো। বুকের মাঝে কেবলই সুরের আকুলিবিকুলি।
মৌসুমী বলেন, 'তখন বয়স কত আর হবে! আমি তখন ক্লাস টু কি থ্রিতে পড়ি। আপনাকে একটা গল্প বলি শোনেন। আমার এক কাকা আছেন প্রতি মাসের ১১ তারিখ তার বাড়িতে ওরশ আয়োজন করেন। দূর দূরান্তের গ্রাম থেকে সেখানে গান গাইতে আসেন সাধু গুরুরা। আমার বাবা ছিলেন ভাবসঙ্গীতের ভক্ত। তাই তিনি আম্মাকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে যেতেন। আমি তখন ঘুমঘরে। কিন্তু আমিও কম না। ঘুম থেকে উঠে রাতের বেলা চলে যেতাম আব্বার কাছে গান শুনতে। সারারাত গান শুনে আব্বা-আম্মাসহ ভোরে বাড়ি ফিরতাম। '
ছোট্ট মৌসুমী বড় হতে থাকে। সুর তার ভেতরে আরও বেশিভাবে ভর করে। নিজের অজান্তেই মেয়েটি গেয়ে ফেলে গান। যেহেতু আছে দেয়ালের কান, তাই সুর আর লুকিয়ে রাখতে পারলো না সে। তার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে তারই এক চাচাতো ভাই তাকে ভর্তি করিয়ে দেন লালন সাধক শফি মন্ডলের গানের বিদ্যালয়ে। শফি মন্ডল তাকে বলেন, কী নাম তোমার মা, মেয়েটি বুকে সাহস নিয়ে ভয়টা লুকিয়ে বলে, 'মৌসুমী আক্তার সালমা'।
সেই থেকে শুরু গানের দুনিয়ায় সালমার আনুষ্ঠানিক পথচলা। ক্ল্যাসিক, ছড়া গান, নজরুলসংগীত শেখানোর পর সালমাকে লালনসংগীতের ওপর তালিম দেন শফি মন্ডল। স্থানীয় পর্যায়ে কোনো অনুষ্ঠান হলেই ডাক পড়ে ক্ষুদে সালমার। গানের সুরে মঞ্চ মাতিয়ে শ্রোতার মন ভরিয়ে দিতেন এই সুরবালিকা।
মাত্র ১৩ বছর বয়সেই সালমা নাম নিবন্ধন করেন ‘ক্লোজআপ ওয়ান’ প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় আসরে। ২০০৬ সালে ওই প্রতিযোগিতায় গান গেয়ে নিজের প্রতিভার প্রমাণ দিয়ে হিসনা নদীর পাড়ের ছোট্ট মেয়েটি গোটা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষি মানুষের কাছে হয়ে ওঠে পরিচিত শিল্পী। আর তার গাওয়া 'ও মোর বানিয়া বন্ধুরে' গানটি তো উড়তে থাকে মানুষের মুখে মুখে।
সেই পুচকি সালমা এখন এক সন্তানের মা। তার মেয়ে স্নেহাকে নিয়ে তিনি এখন থাকেন স্বামী শিবলি সাদিকের সঙ্গে ধানমন্ডিতে। গানের পথচলায় কিছুটা বিরতিও নিতে হয়েছিলো তাকে।
সে গল্পটা শোনা যাক তার মুখে, 'তখন আসলে আমার কিছু করার ছিলো না। আমি তো সন্তান-সংসার রেখে গান করতে পারতাম না। তবে সুরের মাঝে আবার ফিরছি ধীরে ধীরে। সুর থেকে আর দূরে থাকতে চাই না। আমি এখন পুরোদস্তুর গানের মানুষ হয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে চাই। গান ছাড়া আমি বাঁচবো না যে। কত সুর এখনো অধরা রয়ে গেছে। সব সুর গলায় তুলতে না পারলে তো শান্তি পাবো না। সুরের অভিশাপ লাগবে। '
সুরের অভিশাপ নিতে চান না। তাই সুর সাধনা আর নতুন নতুন গানের সন্ধ্যানেই নিজর সকল সময় ব্যয় করতে চান সালমা। তিনি অন্তরে লালন করেন লালন সাঁইকে। তাই যতটা পারেন লালনের জীবনদর্শনও মেনে চলেন।
এ পর্যন্ত সাতটি একক অ্যালবাম প্রকাশ হয়েছে তার। প্রথম একক অ্যালবাম ছিলো 'বেস্ট অব সালমা' আর সর্বশেষ অ্যালবামের নাম 'স্বপ্ন উড়াইলা'।
সংসার আর স্বামী সন্তান সামাল দিয়ে কী গানের সাধনা হবে? সালমা বলেন, 'কেন হবে না? যে রাঁধে সে তো চুলও বাঁধে। সবকিছু সামলে গানেও নিয়মিত হওয়ার চেষ্টা করছি। এ ছাড়া তো আমার আর কোনো কাজ নেই। '
ঈদের পরই পুরোদস্তুর সংগীত ভুবনে ব্যস্ত হয়ে পড়তে চান সালমা। বেশ কিছু কনসার্ট আর টেলিভিশন অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিকল্পনা করছেন তিনি। নিজের নতুন অ্যালবামের গানের কাজও এগিয়ে নিচ্ছেন। এই প্রথমবারের মতো লালনের গান নিয়ে অ্যালবাম তৈরি করতে যাচ্ছেন তিনি। এতে তার গুরু শফি মন্ডলও গাইতে পারেন।
সালমার গানের স্বপ্ন উড়ুক, হিসনা নদীর জলে ভাসুক তার সুর। কণ্ঠ-সুর-তালে এই সুরবালিকা মুগ্ধতার ঘোর লাগিয়ে দেবেন সংগীত পিপাসুদের মনে এই শুভকামনা রইলো মৌসুমীর জন্য, সালমার জন্য।
বাংলাদেশ সময় : ১৮৪০ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০১৪