১৯৬৬ সালে বাংলা চলচ্চিত্র পেয়েছিল কয়েকজন নতুন উত্তম কুমারকে! শুনতে একটু অবাক লাগছে? ভাবছেন উত্তম কুমার তো একজনই ছিলেন। আসলেই তাই, উত্তম একজনই, সেজন্যই তিনি মহানায়ক।
অভিনেতা কিংবা প্রযোজক নন, আরও চারটি পরিচয়ে বাংলা ছবিতে কাজ করেছিলেন উত্তম কুমার৷ তিনি প্রযোজনা করেছেন ৭টি ছবি। এর বাইরে ৬টি ছবিতে কাজ করেছেন গায়ক, সুরকার, চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালক পরিচয়ে৷ পরিচালক এবং সুরকার হিসেবে সফলও হয়েছিলেন৷ ২৪ জুলাই তার ৩৫তম প্রয়াণ দিবস৷ তার স্মরণে বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য অভিনেতা পরিচয়ের বাইরে উত্তমের আরও কিছু গুণের কথা তুলে ধরা হলো টুকরো কথায়৷
নায়ক যখন গায়ক
অভিনয়ের আগেই গানের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল উত্তম কুমারের৷ গিরিশ মুখার্জি রোডে তাদের বাড়িতে নিয়মিত গানের আসর বসতো৷ পরিচালক হূষিকেশ মুখার্জির বাবা শীতল মুখার্জি সেখানে টপ্পা গাইতেন৷ গানে মন বসলো অরুণ চট্টোপাধ্যায়ের (উত্তম কুমারের প্রকৃত নাম)৷ এরপর পোর্ট কমিশনার্সে চাকরির পাশাপাশি তিনি তালিম নেন প্রখ্যাত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী নিদানবন্ধু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে৷ পরে চক্রবেড়িয়া স্কুলের সংগীত শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন অরুণ। নানান ঘরোয়া আসরে এবং মঞ্চে গাইলেও চলচ্চিত্রে এই ভূমিকায় একবারই পাওয়া গেছে তাকে৷ উত্তম কুমার অভিনীত চরিত্রের কন্ঠে হেমম্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, কিশোর কুমারের গাওয়া গানগুলো আজও হিট৷ তবে নিজের গাওয়া গানে তিনি অভিনয় করেন ৪৭তম ছবিতে, ১৯৫৬ সালে৷ সে বছর মুক্তি পায় তার ১১টি ছবি৷ এর মধ্যে চারটির অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন৷ ওই বছরের প্রথম ছবি ‘সাগরিকা’৷ শেষ ছবি ছিল দেবকীকুমার বসু পরিচালিত ‘নবজন্ম’৷
১৯৫৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর মুক্তি পাওয়া ‘নবজন্ম’ ছবিতে পর্দায় শোনা গেলো প্রথম এবং শেষবারের মতো গায়ক উত্তমকুমারের গান৷ ‘গৌরাঙ্গ’র ভূমিকায় নচিকেতা ঘোষের সুরে মহানায়ক গেয়েছিলেন মোট ৬টি গান৷ তার মধ্যে ছিল ‘কানু কহে রাই, কহিতে ডরাই’, ‘আমি আঙুল কাটিয়া’ ইত্যাদি৷ এতে উত্তমের নায়িকা ছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় (বাসম্তী) এবং অরুন্ধতী দেবী (সুধামুখী)৷
সুরকার উত্তমকুমার
‘গায়ক’ উত্তম কুমারের পর্দায় আসার ঠিক এক দশক পর ১৯৬৬ সালে টালিগঞ্জের সিনেমাপাড়ায় সুরকার হিসেবে আবির্ভূত হন তিনি৷ ওই বছরের ৩০ ডিসেম্বর শ্রীলোকনাথ চিত্রমের ব্যানারে মুক্তি পায় শচীন মুখার্জি পরিচালিত ‘কাল তুমি আলেয়া’৷ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘কাল তুমি আলেয়া’র চিত্রনাট্য লেখেন লেখক নিজেই৷ এতে ধীরাপদ চক্রবর্তীর ভূমিকায় অভিনয় করেন উত্তম৷ সঙ্গে ছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় (সোনা বৌদি) এবং সুপ্রিয়া চৌধুরী (ড. লাবণ্য সরকার)৷ নিজের অভিনীত এই ১১২তম ছবিতেই গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রথম জুটি গড়েন সুরকার উত্তম৷ তার সুরে হেমম্ত মুখোপাধ্যায় গাইলেন ‘যাই চলে যাই’৷ আশা ভোসলের কন্ঠে শোনা গেল দুটি গান- ‘আমার মনের মানুষ ফিরল ঘরে একটু বেশি রাতে’ এবং ‘পাতা কেটে চুল বেঁধে সে টায়রা পড়েছে’৷ ছবি সুপারহিট হলো৷ এটি প্রেক্ষাগৃহে চলেছিল টানা ১৪ সপ্তাহ৷
ঠিক বছর দশেক পর ফিরে এলেন সুরকার উত্তমকুমার৷ সেই শেষবার৷ ১৯৭৭ সালের ২১ জানুয়ারি পর্দায় আসে অসীম সরকার প্রযোজিত এবং পীযূষ বসু পরিচালিত উত্তম কুমারের ১৭৭তম ছবি ‘সব্যসাচী’৷ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পথের দাবী’ অবলম্বনে নির্মিত এই ছবিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় ছাড়াও সুরকারের দায়িত্বও পালন করেন উত্তম৷ ছবিটিতে তার সহশিল্পী ছিলেন সুপ্রিয়া দেবী৷
স্বাধীনতা-আন্দোলনের পটভূমির ছবিতে উত্তম ব্যবহার করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের দেশাত্মবোধক গানগুলো৷ এগুলো হলো- কবিগুরুর ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’, বিদ্রোহী কবির ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ এবং ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ আর ডিএল রায়ের ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’৷ এই ছবিতে সুরকার উত্তমকে সহায়তা করেন তার সঙ্গীত শিক্ষক নিদানবন্ধু বন্দ্যোপাধ্যায়৷ করমুক্ত ছবিটি দর্শক ও সমালোচক মহলে প্রশংসিত হয়৷
চিত্রনাট্যকার উত্তম কুমার
একই বছর অভিনেতা ও সুরকারের পাশাপাশি নিজের নামের সঙ্গে চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালক পরিচয় দুটি যুক্ত করেন উত্তম কুমার৷ ১৯৬৬ সালের ১ এপ্রিল মুক্তি পায় ‘শুধু একটি বছর’৷ গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারও গীতিকার পরিচয়ের বাইরে এসে রোমান্টিক কমেডি ধাঁচের গল্পটি লেথেন। এর চিত্রনাট্য তৈরি করেন উত্তম৷ সংলাপ লেখেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার৷ ছায়াছবি প্রতিষ্ঠানের প্রযোজনায় নির্মিত উত্তম-সুপ্রিয়া জুটির ‘শুধু একটি বছর’-এ সুর দেন রবীন চট্টোপাধ্যায়৷ গান লেখেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়৷ হেমম্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘স্বপ্ন জাগানো রাত মাধুরী ছড়ায়’ আজও অনেকে গুনগুনিয়ে ওঠেন৷
১৯৭৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পর্দায় আসে শিল্পী সংসদ প্রযোজিত ‘বনপলাশীর পদাবলী’৷ উত্তম তখন শিল্পী সংসদের সভাপতি৷ এই ১৪৮তম ছবিতে রমাপদ চৌধুরীর উপন্যাস অবলম্বনে চিত্রনাট্য লেখেন তিনি৷
পরিচালক উত্তম কুমার
উত্তম কুমার প্রথমবার পরিচালনায় আসেন ১৯৬৬ সালেই৷ ‘শুধু একটি বছর’ ছবিতে সঞ্জয় চরিত্রে অভিনয়ও করেন তিনি৷ চিত্রনাট্যকারের দায়িত্ব সামলে পরিচালকের ভূমিকাতেও সাফল্য পেলেন মহানায়ক৷ টানা ১২ সপ্তাহ চলেছিল ছবিটি৷ ‘শুধু একটি বছর’ ছবির ট্রেনের দৃশ্যটির কাজ করা হয়েছিল ‘নায়ক’ ছবির শিল্প-নির্দেশক বংশীচন্দ্র গুপ্তর তৈরি সেটে৷ সত্যজিৎ রায়ও নতুন পরিচালক হিসেবে উত্তমকে শুভেচ্ছা জানান। এরপর ১৯৭৩ সালে ‘বনপলাশীর পদাবলী’ ছবিতে অভিনেতা ও চিত্রনাট্যকারের পাশাপাশি পাওয়া গেল পরিচালক উত্তম কুমারকে৷ সুবর্ণজয়ম্তী পেরিয়ে টানা ১৭ সপ্তাহ চলেছিল এই ছবি৷ এতে তার সহশিল্পী ছিলেন সুপ্রিয়া দেবী৷ এই ছবিতে পাঁচজন সুরকারকে দিয়ে গান করান উত্তম৷ নচিকেতা ঘোষ, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, অধীর বাগচী, শ্যামল মিত্র এবং সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুরে গানগুলো এখনও জনপ্রিয়৷
পরিচালক উত্তম কুমারের শেষ ছবি মুক্তি পায় তার প্রয়াণের এক বছর পর৷ ১৯৮১ সালের আগস্টে মুক্তি পায় সেই সময়ে ৮৫ লাখ রুপি বাজেটের ছবি ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’৷ নীহাররঞ্জন গুপ্তর কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত এ ছবিতে ধূসর চরিত্রে অভিনয় করেন উত্তম৷ এটি ছিল তার ২০৫তম ছবি৷ পরিচালক পীযূষ বসুর আকস্মিক প্রয়াণে দৃশ্যধারণ শুরুর পর দিন পাঁচেকের মধ্যে নতুন পরিচালক হন মহানায়ক৷ তিনিও পাঁচদিনের কাজ বাকি থাকতেই প্রয়াত হন৷ সে কাজটুকু শেষ করেন সহকারী পরিচালক উদয় ভট্টাচার্য৷ রাহুল দেব বর্মণের সুর এবং অভিনয়শিল্পী হিসেবে মিঠুন চক্রবর্তী, শর্মিলা ঠাকুরের উপস্হিতি সত্ত্বেও ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’ তেমন সাফল্য পায়নি৷ তবে এ ছবির একক পরিচালক ছিলেন না মহানায়ক৷ তাই ব্যর্থতার দায়ও তার একার ছিল না৷ তবে বড় প্রেক্ষাপটে ‘বনপলাশীর পদাবলী’ ছবির পরিচালক হিসেবে যে দক্ষতা তিনি দেখিয়েছেন, তা আজও দর্শককে বিস্মিত করে৷
বাংলাদেশ সময় : ১৪৫৩ ঘণ্টা, জুলাই ২৩, ২০১৪