সবাই ভাবে মেয়েটা খুব গম্ভীর, কাঠখোট্টা। কিন্তু কাছের মানুষরা জানে অনিতা কতটা মজার।
স্টেডিয়ামে খেলা থাকলে তাকে কেউ খুঁজে পায় না। বাংলাদেশের খেলা হলে তো কথাই নেই। স্টেডিয়াম হলো তার দ্বিতীয় বাড়ি। অনিতার শোবার ঘরের টিভিতে সারাক্ষণই ক্রিকেট চলে। তবে কৈশোরে পছন্দ করতেন টেনিস। লন টেনিস খেলতেন। বাবাই শিখিয়েছিলেন। ফুটবল কিছুটা ভালো লাগতো। কিন্তু ক্রিকেট পৃথিবীর সবচেয়ে একঘেয়েমি খেলা মনে হতো তার কাছে! মানুষ এতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে কেনো ক্রিকেট দেখে এর কোনো মানে খুঁজে পেতেন না তিনি। একদিন কাজ ছিল না বলে ক্রিকেট দেখতে বসেন অনিতা। একটু একটু করে মজা লাগলো। এরপর ক্রিকেট সম্পর্কে জানতে গিয়ে ক্রিকেটের প্রেমে পড়ে গেলেন।
ক্রিকেট পাগল অনিতা দেশীয় সংগীতাঙ্গনে পরিচিত মুখ। পেন্টাগন ব্যান্ডে ছিলেন চার বছর। ব্যান্ডে থাকাকালে বিখ্যাত গানগুলো পরিবেশন করতেন তিনি। তখন ওয়েস্টার্ন (রক, ফাঙ্ক, ডিস্কো, পপ), ল্যাটিন, র্যাগে, অ্যারাবিক সং করতেন বেশি। তার ভাবমূর্তিটা ওভাবে তৈরি হয়েছে। সবার কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন জনপ্রিয় গান নিখুঁতভাবে উপস্থাপনের বিশেষজ্ঞ! কিন্তু একটা অতৃপ্তি কাজ করতো তার মধ্যে। এর কারণ অনিতার কাছে উচ্চাঙ্গসংগীত, নজরুলসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, গজল বেশি প্রিয়। এসব শিখেই বেড়ে উঠেছেন তিনি। এই অতৃপ্তি ঘোচানোর জন্য সিদ্ধান্ত নেন এসব ঘরানার গান নিয়ে কাজ করবেন। পাশাপাশি দেশের চেনা আধুনিক গানের চর্চাও চালিয়ে যাবেন। তবে ওয়েস্টার্ন যে ছেড়ে দিয়েছেন তা নয়। ফিউশন আর নিরীক্ষাধর্মী কাজও করছেন।
অনিতা বাংলানিউজকে বললেন, ‘ছয় বছর বয়স থেকে গান শিখি। উচ্চাঙ্গসংগীত ও নজরুলসংগীত আমার শেকড়। চারুকলার শিক্ষার্থী লিপির কাছে আমার হাতেখড়ি। এর বছরখানেক পর বেতারের গীতিকার-সুরকার আলতাফ হোসেনের কাছে শাস্ত্রীয়সংগীতে তালিম নিয়েছি। ’
অনিতার আদর্শ রুনা লায়লা, আশা ভোঁসলে, পুলিশ ব্যান্ডের স্টিং। রুনা লায়লার গান সবচেয়ে বেশি পছন্দ তার। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই কণ্ঠশিল্পীর গান শুনে শুনেই গাওয়ার ইচ্ছে জাগে অনিতার। সানবিমসে পড়ার সময় তার সহপাঠী ছিলেন রুনার মেয়ে তানি লায়লা। তারা ছয়-সাত মাস একসঙ্গে পড়েছিলেন। ওই সময় রুনাকে সামনে থেকে দেখার সুযোগ হয় অনিতার। আট-নয় বছর আগের কথা। ঘরোয়া একটি অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেছিলেন তিনি, সেখানে অতিথি হিসেবে ছিলেন রুনা লায়লা। আয়োজকদের বিশেষ অনুরোধে অনুষ্ঠানে অনিতা গেয়ে শোনান রুনার ‘ও আমার পাশের বাড়ির বন্ধু বড় বেয়ারা’, ‘ও মেরা বাবু ছেল ছেবিলা’ গান দুটি। এরপর রুনা তাকে আশীর্বাদ করে চর্চা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
২০০৬ সালে প্রকাশিত একটি মিশ্র অ্যালবামে ডিজে রাহাত ও মাসুমের সংগীতায়োজনে লতা মঙ্গেশকরের ‘ও পলাশ ও শিমুল’ এবং রুনা লায়লার ‘এই বৃষ্টি ভেজা রাতে’ গান দুটি গেয়েছিলেন অনিতা। এরপর জি-সিরিজ থেকে প্রকাশিত নমনের মিশ্র অ্যালবামে তার গাওয়া দুটি মৌলিক গান ছিল। এগুলোর শিরোনাম ‘নিয়ে যারে’ এবং ‘যাও পাখি’। এ গানগুলো এখনও রেডিও প্রচারিত হয়। তার প্রথম একক অ্যালবাম ‘চন্দ্রালোকে’ বাজারে আসে ২০০৯ সালে। এর তিন বছর পর প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘অনিতা’। আর গেলো ঈদ উপলক্ষে শ্রোতাদের জন্য তিনি নিয়ে এলেন ‘অনিতা ২’। এরই মধ্যে তার নতুন গানগুলো প্রশংসা কুড়াতে শুরু করেছে।
তৃতীয় একক অ্যালবাম প্রকাশ উপলক্ষে অনিতা এসেছিলেন বাংলানিউজ কার্যালয়ে। শুরুতেই জানালেন তার নামের শানে নূযূল। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর একমাত্র মেয়ের নাম অনিতা। এজন্যই এম আকমল হোসেইন তার মেয়ের নাম রাখেন অনিতা। তিনি তথ্যসচিব ও জ্বালানি সচিব ছিলেন। ২০০১-২০০২ মেয়াদে বিসিবির প্রেসিডেন্ট আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারারও ছিলেন। মা ফরিদা বেগম গৃহিণী।
অনিতার গ্রামের বাড়ি সিলেটে। নানা (করিমগঞ্জ), নানি (বিয়ানিবাজার), দাদা-দাদি (সুনামগঞ্জ) সবাই এই অঞ্চলের মানুষ। ভিকারুন নিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি শেষে এক বছর ভারতের দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে মাইক্রো বায়োলজি বিষয়ে অনার্স পড়েছেন অনিতা। এখন স্টেথোস্কোপ, রক্তচাপ মাপার যন্ত্র, ছুরি, কাঁচি নিয়েই ব্যস্ত থাকার কথা ছিল তার। কারণ মা-বাবা চাইতেন মেয়ে চিকিৎসক হবে। তাই ১৯৯৯ সালে দেশে ফিরে ভর্তি হন বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজে। বাংলাদেশ মেডিক্যাল সার্জারিতে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় অনারারি মেডিক্যাল অফিসার পদে কাজ করেছেন। কিন্তু গানের টানে ২০০৮ সালে ডাক্তারি ছেড়ে দিয়েছেন।
গানেও মা-বাবার উৎসাহ পেয়েছেন জানিয়ে অনিতা বললেন, ‘মায়ের ইচ্ছে ছিল, তার সন্তান গান গাইবে। কারণ তিনিও একসময় গাইতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারিপার্শ্বিকতার কারণে হয়ে ওঠেনি। অনিতার গান শোনার অভ্যাসটা গড়ে উঠেছে বাবার সুবাদে। উপমহাদেশ ও পশ্চিমের সব বিখ্যাত শিল্পীর গান শুনতেন তিনি। তার কাছে এল-পির বিশাল সংগ্রহশালা ছিল। তাই আমি গানকে গুরুত্ব দেওয়ায় তারা বরং খুশিই হয়েছেন। ’
রোগ সারানো আর গানে মন ভরানো ছাড়াও অনিতার কয়েকটি সুপ্ত প্রতিভা আছে। বাচ্চাদের কণ্ঠে ছড়া আবৃত্তি করতে পারেন। প্রায়ই বাসার সবাইকে বিনোদন দেন। তিনি ভালো ছবি তুলতে পারেন, তবে শখেই ছবি তোলেন। আলোকচিত্রী আবু নাসের, আরমান হোসেন বাপ্পি, প্রীত রেজার সঙ্গে তার ভালো বন্ধুত্ব। প্রীত রেজা ও অনিতার জন্মদিন একই দিনে (১৪ আগস্ট)। এজন্য তারা একে অপরকে টুইনি বলে ডাকেন।
কেউ যদি জনসমক্ষে প্রেমের ভাব দেখায় তখন অনিতা এমনভাবে তাকান যে উল্টো ছেলেরাই লজ্জায় পড়ে যায়! মাঝে মধ্যে ছেলেরা মুঠোফোনে রং নাম্বারের বাহানা করলে বলেন, ‘হ্যাঁ, লাইনে থাকেন। ’ তারপর লাইনে ধরিয়ে রাখেন যতক্ষণ খুশি!
অনিতাকে বলা যায় বুদ্ধিমান দুষ্টু। যখন ছোট ছিলেন, ওয়াসিম আকরামের মতো দেখতে একজন বিকেলে বাড়ির পাশে খেলতে এলেই অনিতা তার দিকে তাকিয়ে থাকতেন হাঁ হয়ে! তাকে দেখে তো বেচারা লজ্জায় লাল হয়ে যেতেন। প্রেম-বিয়ে প্রসঙ্গে অনিতা বললেন, ‘সংগীতের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে। গানই আমার প্রথম বর! দ্বিতীয় বিয়ে কবে হবে জানি না (হা হা হা)। ’
অনিতার মনটা এখন বিষণ্ন। কারণ দীর্ঘদিন অসুস্থতায় ভুগে তার বাবা চিরতরে বিদায় নিয়েছেন। অনিতার বাবার প্রতি বাংলানিউজ বিনোদন বিভাগের পক্ষ থেকে অগাধ শ্রদ্ধা।
বাংলানিউজের পাঠক ও শ্রোতাদের জন্য অনিতার গান :
বাংলাদেশ সময় : ২০৪০ ঘণ্টা, আগস্ট ০৬, ২০১৪