ঢাকা, সোমবার, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

তারার ফুল

দেখা থেকে লেখা

মানবমুক্তির খোঁজে ‘ম্যাকাব্রে’

অপূর্ব কুমার কুন্ডু | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪০৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০১৫
মানবমুক্তির খোঁজে ‘ম্যাকাব্রে’ দৃশ্য : ‘ম্যাকাব্রে’/ ছবি: নূর/ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের সমালোচনা লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, যিনি সৃজন করেন তিনি আপনাকেই নানাভাবে প্রকাশ করেন। সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটারের (সিএটি) মতো পেশাদার থিয়েটার সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা কামালুদ্দীন নীলু বিভিন্ন মঞ্চনাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন, আলোচিতও হয়েছেন।

কিন্তু করণীয় কাজটা অব্যাহত গতিতে করে চলেছেন। জাতীয় পরিসর জয় করেছেন। আবার আন্তর্জাতিক আবহে উড়াল দিয়েছেন। দেশ-বিদেশের ভ্রমণের অভিজ্ঞতাকে উপজীব্য করে তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন ‘দ্য কমিউনিকেটর’, এর কেন্দ্রীয় চরিত্র বিশ্ব পরিভ্রমণে ব্যাপ্ত। ডিপ্লোম্যাট চানক্য বলেছেন, পরগৃহে এবং পরদেশে বাস কষ্টকর।

কামালউদ্দীন নীলু নির্দেশিত আরেক নাটক ‘প্রিজন’-এ কেন্দ্রীয় চরিত্রের কাছে সারাবিশ্ব ব্যবস্থাই একটা আস্ত কারাগার। ফ্রান্সের দার্শনিক মিশেল ফুকোর দর্শনে, আত্মহত্যাও একটা উপভোগ্য বিষয়! শুধু উপভোগ্য বললেই বলা হয় না বরং ফ্রান্সে শবাধারকে ঘিরে একটি আদিবাসীর নৃত্য পরিবেশন দৃষ্টিনন্দন, আনন্দের এবং উৎসব উদযাপনের। শবদেহ এবং শবাধারকে ঘিরে প্রচলিত এই নৃত্য ‘ম্যাকাব্রে’ নামে স্বল্প পরিচিত। স্বল্প পরিচিত শব্দটাকেই বিস্তৃত পরিসরে, বৃহৎ ক্যানভাসে মঞ্চায়ন উপযোগী করে তুললেন নির্দেশক কামালউদ্দীন নীলু।

বাস্তব জগতে ঘেরাও হয়ে, কল্পনা আশ্রিত এক জগৎ নির্মাণ করে, সেখানে ভার্চুয়াল জগতের একজন বাসিন্দা হয়ে মরে বাঁচার লক্ষ্যে এগিয়ে চলা এক বন্দি আত্মার মুক্তির লড়াই নিয়েই নাটক ‘ম্যাকাব্রে’। আনিকা মাহিন একা রচিত, কামালউদ্দীন নীলু ভাবিত-পরিকল্পিত ও নির্দেশিত সিএটি প্রযোজিত নাটক ‘ম্যাকাব্রে’র প্রদর্শনী এখন নিয়মিত হচ্ছে।

ঢাকার নাট্যশালায় হোক কিংবা আমেরিকার ব্রডওয়েতে নাটক মঞ্চায়ন করা হোক, সৈয়দ জামিল আহমদ কিংবা কামালউদ্দীন নীলুর মতো নির্দেশকের নাটক সৃজন প্রক্রিয়াটা নাট্যকারদের জন্যে সত্যিকার অর্থে চ্যালেঞ্জিং। প্রযোজনা দেখে বোঝা কঠিন, নাটক রচনা আগে নাকি প্রযোজনার লাইনআপ আগে! কিংবা নাট্যকারের ভাবনা আগে নাকি নির্দেশকের ভাবনা আগে। এসব ক্ষেত্রে ‘ভাবনা’ বিষয়টা জরুরি, তা না হলে ‘ম্যাকাব্রে’ নাটকে পরিকল্পক ও নির্দেশক হিসেবে কামালউদ্দীন নীলুর উপস্থিতিই যথেষ্ট হতে পারত। পারার বিষয় নয় বলেই তিনি একাধারে ভাবনায়, পরিকল্পনায় ও নিদের্শনায়। ফলে এখানে নাট্যকার আনিকা মাহিন একার উপস্থিতি নাট্যকার হিসেবে, কিন্তু নির্দেশকের লাইনআপে। অর্থাৎ তুমি তোমার মতো করেই চা পান করো, ঠিক আমি যেভাবে খাচ্ছি সেরকমভাবে। ফলে নাটকের সব কৃতিত্ব যেমন নাট্যকার আনিকা মাহিন একার নয়, আবার একাকে অস্বীকার করেও এটি তৈরি হয়নি।

অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, আমরা নানাভাবে উপায়হীন, নিরাপত্তাহীন, বিনোদনহীন, অর্থ-প্রতিপত্তিহীন, মনুষত্বহীন, মানহীন, বাসস্থানহীন, সুস্বাস্থ্যহীনসহ আরও কতো হীন তথা উপায়হীন। এতসব হীনের পেছনে স্বজন-সমাজ-রাষ্ট্র নাকি বিশ্ব ব্যবস্থা দায়ী সে প্রশ্নের উত্তর অমীমাংসিত। কিন্তু কেউ না কেউ তো দায়ী। যে শক্তির আধিপত্যের জোরে বাম্পার ফসল ফলা সত্তে¡ও দেশে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ হয়, নিরস্ত্র অফিসগামী যাত্রী অ্যাটমিক শক্তির দাবানলে পুড়ে কয়লা হয়, স্বভূমি থেকে উৎক্ষিপ্ত হয়ে উদ্ধাস্তু হয়, রাজনৈতিক দূষণ সত্তে¡ও রাজনৈতিক অবয়বে সত্যি-মিথ্যার বিভেদকে একাকার করে ফেলা যায়, সেই আধিপাত্যবাদী শক্তির শক্তিমূল থাকে আড়ালে, অন্তরালে এবং অদৃশ্যে। ‘ম্যাকাব্রে’ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র এই অদৃশ্য শক্তির আগ্রাসনে আক্রান্ত। তাকে কয়েদখানায় আটকে রাখা হয়েছে কয়েদি করে। কয়েদি জানে না তার কৃত অপরাধ কিংবা সম্ভাব্য শাস্তি। কার কারণে তার এই করুণদশা তা-ও কয়েদির কাছে অস্পষ্ট। তথাপি যন্ত্রণাকে লাঘব ও বিদ্রোহকে নিয়ন্ত্রিত করে ও দমননীতিকে মেনে নিয়ে, অনিবার্য এবং শেষ পরিণতি মৃত্যুকে গ্রহণের মানসিকতা তৈরি করে কয়েদি। স্বপ্নডানায় উড়াল দিয়ে পরাধীনতার গ্লানির বিপক্ষে লড়াই করার প্রস্তুতি নেয় সে। সেখানেই শেষ হয় নাটক ‘ম্যাকাব্রে’।

‘ম্যাকাব্রে’র নাট্যকার আনিকা মাহিন একার নাটক রচনার দক্ষতা নিয়ে যেহেতু অংশীদারিত্বের প্রশ্নে চূড়ান্ত বিশ্লেষণ করা গেলো না, তথাপি কিছু বলার থাকে। বাংলাদেশের নাট্যাকাশে প্রয়াত নাট্যকার এসএম সোলায়মান ছিলেন একাধারে অভিনেতা-নাট্যকার-নির্দেশক। মিউজিক্যাল ড্রামা প্রযোজনায় তার জুড়ি মেলা যেমন ভার, তেমনি মৌলিক নাটক রচনার পাশাপাশি বিদেশি নাটকের অনুবাদ-রূপান্তরে বিদেশি নাটকের বাঙালিকরণে এসএম সোলায়মান অবিসংবাদিত। উপরন্তু নাটকে সিরিয়াস ইস্যুকে ফ্যান্টাসির অবয়বে টুইস্ট করে পাথরকে তরমুজ বানিয়ে ফেলায় তিনি অনন্য। এসএম সোলায়মানের কন্যা আনিকা মাহিন একা স্বীকার করুন আর না করুন, ‘কোর্ট মার্শাল’ নাটকের সংলাপ ‘আমরা প্রত্যেকেই রাজনৈতিক শক্তির উত্তরাধিকার’-এর মতো করেই সাংস্কৃতিক শক্তির উত্তরাধিকার। ফলে বাবার মতো করেই কন্যা একা সিরিয়াস এবং টুইস্টের বহমান ধারার ধারক ও বাহক।

‘ম্যাকাব্রে’ নাটকের সার্কাস অংশে টুইস্টের ঝলকানি এবং আইনস্টাইন অংশে সিরিয়াসের ভারিক্কিতে তা দৃশ্যমান। বয়স ও অভিজ্ঞতা কম হলেও একাকিত্বকে মেনে নেবো নাকি জনারণ্যে জোয়ার আনবো প্রভৃতি মতানৈক্য দৃশ্যের সংলাপ রচনায় নাট্যকার হিসেবে একা ধারালো। টিকিট কেটে নাটক দেখতে আসা দর্শকদের শিল্প পিপাসা নিবৃত্তির জন্য এসএম সোলায়মান যদি গায়ের রক্ত বিক্রি করে প্রযোজনা নামিয়ে থাকেন তাহলে দর্শকদের স্থান কতো উঁচুতে তা বোঝাতে আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরেট হয়ে আসার প্রয়োজনা নেই।

নেই নেই করেও অসংখ্য নেই-এর ভিড়ে মঞ্চায়নে নৃত্য, সুর, সংলাপ, অভিনয়ের পাশাপাশি আবৃত্তি, পাপেট্রি, অ্যানিমেশন, জাদু, সার্কাস, চলচ্চিত্র, থ্রিডি সংস্করণ প্রভৃতির সফল প্রয়োগে নির্দেশক কামালউদ্দীন নীলু দক্ষ, স্বতন্ত্র, ব্যতিক্রম ও নান্দনিক। ইন্টারনেটের এই ভার্চুয়াল গতি প্রবাহে সবকিছুই সবার চোখের সামনে। কোন জিনিসটি যে নেই, সেই ‘নেই’কে নেই দেখানো অসম্ভব ব্যাপার! শূন্যস্থান, শূন্য সময় বলে নির্দেশক-নাট্যকার হ্যারল্ড পিন্টার যে কাল্পনিক জগৎ নির্মাণের পথ দেখান না কেনো, ‘ম্যাকাব্রে’ কাল্পনিক জগতের রিমেক তথা বিনির্মাণ। বাক্সবন্দি অবস্থাটা যেমন শূন্য সময়, শূন্যস্থানের ইঙ্গিত দেয়, কামালউদ্দীন নীলু নির্দেশিত ‘ম্যাকাব্রে’ মঞ্চায়ন তেমনি অবস্থা সৃজন করে।

মানুষের কল্পনার ছোঁয়া-ধরার বাইরের বিমূর্ত ভাবনাগুলোকে নানান রঙে-নানান বর্ণে, নানা ঘাত-প্রতিঘাতের দোত্যনায় নির্দেশক কামালউদ্দীন নীলু নির্দেশিত ‘ম্যাকাব্রে’ প্রয়োজনা দেখায় দৃশ্যত বন্দির দেয়ালে ঘেরা বন্দিদশা, নিরুপায়তার শেষ সীমায় পৌঁছে স্বপ্ন নির্মাণের একটি মাত্র পথকে ধরে বাঁচতে চাওয়া প্রভৃতি। আর অদৃশ্যে রয়ে যায় নীরব আকুতি। আধিপত্য শক্তিকে চিনে নেওয়ার আকুতি, বন্দিদশা থেকে মুক্তি লাভের আকুতি। কীভাবে কোন পথে এই যাত্রা সে ব্যাপারে নির্দেশক কামালউদ্দীন নীলুর নির্ভরতা শিল্পানুরাগী দর্শকদের ওপর। উত্তরের বিপরীতে সঠিক প্রশ্ন করাটা যেমন তার রুচি, ঠিক তেমনি শত বিভাজন সত্ত্বেও মানুষ মাত্রই এক এবং সম্মানের সাথে জীবন ধারনের অধিকার প্রতিষ্ঠা তার ইস্পিত চাওয়া। তাই কফিনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা তানপুরা পা-সা-পা সুরে আবহ ধরে থাকে। বেসুরো সময়ে কেউ না কেউ তার কথা ও গায়কী দিয়ে সুরের মূর্ছনায় মুক্তির পথ নির্মাণ করে ‘ম্যাকাব্রে’ স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটাবে মানব মুক্তির অন্বেষণে।

বাংলাদেশ সময় :  ১৬০১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

তারার ফুল এর সর্বশেষ