ঢাকা, বুধবার, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৫ মে ২০২৪, ০৬ জিলকদ ১৪৪৫

তারার ফুল

দেখা থেকে লেখা

মনে পড়ে ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিলো’

অপূর্ব কুমার কুন্ডু | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৫
মনে পড়ে ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিলো’ দৃশ্য: ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিলো’

একই আলোর নিচে বসে কেউ বই পড়ে, আবার কেউ জাল দলিলে সই করে। আলো কিন্তু আলোর মতোই থাকে।

তেমনি পূর্ণিমার আলোয় কারও জীবনের সফল উত্থান হতে পারে। আবার কর্ম দোষে পূর্ণিমার আলো পতনের সাক্ষীও হতে পারে। সুহাসিনা গ্রামে ঘটনাবহুল জীবনের অধিকারী মফিজুদ্দিনের উত্থান ও পতনের আলোকে লেখা কথাসাহিত্যিক শহিদুল জহিরের উপন্যাস ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’। উপন্যাসকে সরাসরি মঞ্চে এনে নাট্য মঞ্চায়ন করলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্য শিক্ষক ও নির্দেশক রেজা আরিফ। আরশিনগর নাট্যদল প্রযোজিত প্রথম নাট্য প্রযোজনা ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিলো’র প্রদর্শনী হচ্ছে নিয়মিত।  

নিরীক্ষার প্রথম ধাপ উপন্যাসকে নাট্যরূপ না দিয়ে সরাসরি মঞ্চে উপস্থাপন। ঔপন্যাসিক শহিদুল জহিরের প্রথম নিরীক্ষা অস্তিত্বহীনের অস্তিত্বদান। নাম-গোত্রহীন এক নারীর জীবনে কামলা আকালুর উপস্থিতিতে সন্তান মফিজুদ্দিনের জন্ম। শৈশব-কৈশোর ডিঙিয়ে যৌবনে যাত্রা শিল্পে অংশগ্রহণ। খরতর যৌবনে সামন্ত প্রভু আলি আসগরের কন্যা চন্দ্রভানকে ঘিরে ঘর সাজাতে গিয়ে বিতাড়িত এবং মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে সামন্ত প্রভু হয়ে চন্দ্রভানকে আয়ত্তিকরণ। বৎসরান্তে সন্তানের বাবা হয়ে সুখে জীবনযাপন। ছোট ছেলে নাসির উদ্দিন এবং তার প্রেয়সী দুলালীর প্রণয়কালে সামন্ত প্রভুর দাম্ভিকতা নিয়ে মফিজুদ্দিনের বিরোধ পূর্ণ অবস্থান। একদিন আলি আসগর যে নির্মমতা দিয়েছিলো মফিজুদ্দিনকে আজ সেই একই নির্মমতা মফিজুদ্দিন ফিরিয়ে দিলো নিজ পুত্র এবং তার প্রেয়সীর ওপর। করুণ পরিণতির বলি দুলালী এবং নাসিরউদ্দিন। অনুতাপ আর অনুশোচনায় এক পূর্ণিমার আলোয় জন্ম নেওয়া মফিজুদ্দিন মরে বাঁচার পথ খুঁজে পায়, তেমনই এক রাতে ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিলো’।

পূর্ণিমা হোক আর অমাবশ্যা হোক, নির্দেশক রেজা আরিফ এক মঞ্চের ওপর দুই ঘণ্টা সময়ের মাঝে মাঝারি মাপের মহাকাব্যিক স্থান-কাল-পাত্র তুলে ধরলেন বিরতিহীন টানটান গতি রেখা। মফিজুদ্দিনের জন্মের প্রাক-কথন, জন্ম, শৈশব, কৈশোর, যৌবন, বার্ধক্য, পুত্রের শৈশব-কৈশোর-যৌবন-করুণ পরিণতি প্রভৃতিকে সীমিত সময় ও পরিসরে কিন্তু বলিষ্ঠভাবে ছুঁয়ে যেতে পারা এবং বলার বিষয় ঠিকভাবে বলতে পারাটা নান্দনিক। উপন্যাসে বর্ণিত যৌনতার তীক্ষ্মতাকে মার্জিত এবং সুনিয়ন্ত্রিত রূপকের (প্রসঙ্গ দোলনা) সাহায্যে উপস্থাপনা করতে পারা রুচির পরিচয়। অভিনয়ে আঙ্গিক, বাচিক এবং সাত্তি¡কভাবের সর্বোচ্চ ব্যবহার করিয়ে নিতে পারায় নির্দেশক সফল। রেজা আরিফের নির্দেশনায় লাইভ মিউজিকের জোরালো অবস্থান থাকে (প্রসঙ্গ কেরামত মঙ্গল) এবং এবারও তা আবহ নির্মাণে প্রাণবন্ত ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে লোকসুরের সঙ্গে আধুনিক সুর ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার শ্রুতিমধুর। মঞ্চ এবং দর্শক একাত্মতা বোঝাতে গিয়ে কারণে-অকারণে দর্শকের মাঝ থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রী আনায়নের ভাড়ামি থেকে রেজা আরিফ মুক্ত। ভেতর থেকে আনার এবং প্রয়োগের যৌক্তিকতা পরিষ্কার। আলোকের নিমগ্নতার পরিবর্তে বিক্ষিপ্ততা মনোযোগের বিঘ্ন ঘটায়। লেজার রিপ্লেক্ট (অন্ধকারে ঘোরানো বিবেচ্য) বহমনতার সাক্ষী দেয়। নির্দেশকের সীমাবদ্ধতা বলতে, গতির মাঝে গতিহীনতা।  

ঢাকার যানজটে মানুষ এমনিতেই আটকে থাকে। মঞ্চের দর্শক হয়ে বিমান গতিতে ছোটা ছাড়া তার আর কোনো উপায় থাকে না। ফলে দুরন্ত গতি এবং মাপা সময় বিবেচনা নির্দেশক রেজা আরিফের অবশ্য করণীয়। করণীয় ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই প্রত্যেককে ছাড়িয়ে। তোরাব আলী, পুলিশ চরিত্রে ইভানের কৌতুকবোধ, আকুল চরিত্রে সোহেলের নিরূপায়তা, কিশোর মফিজুদ্দিন চরিত্রে আতিকের যাত্রাপালা দর্শনের বিহ্বলতা, পরিণত মফিজুদ্দিন চরিত্রে পার্থর বৈচিত্রতা, চন্দ্রভান চরিত্রে ডেইজির টক ঝাল-মিষ্টি, নয়নতারা চরিত্রে মৃন্ময়ীর স্মৃতিকায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা, নাসিরউদ্দিন চরিত্র আতিকের কৌত‚হলী নিমগ্নতা, দুলালী চরিত্রে রূপার বহুমাত্রিকতা, সাতভাইয়ের বুদ্বিদীপ্ত বোকামি প্রভৃতি ভোলার নয়। খেয়াঘাটে পৌঁছেও দর্শক হৃদয়ে মনে পড়ে আরশিনগর নাট্যদলের প্রযোজনা ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিলো।

বাংলাদেশ সময় : ২০৩১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

তারার ফুল এর সর্বশেষ