বেনাপোল (যশোর) : সীমান্ত ভুলে এ যেন অন্য এক বাংলা! এখানে বাঁধনহারা আনন্দের কাছে হার মানে নিরাপত্তার বজ্র আঁটুনি। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ এবং ‘জন গণ মন অধিনায়ক ও জয় হে ভারত ভাগ্য বিধাতা’- এভাবে এক বাঁশিতে বেজে চলে দুই দেশের জাতীয় সংগীত| কিছুক্ষণের জন্য মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় দুই বাংলার সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) আয়োজনে যশোরের বেনাপোল সীমান্তের চেকপোস্ট নো ম্যানস ল্যান্ডে এভাবে প্রতিদিন বিকেল ৫টা থেকে ১৫ মিনিট যৌথ জাতীয় সংগীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে প্যারেড ও পতাকা নামানো হয়। পরে সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে মিষ্টিমুখ-উপহার বিনিময় চলে। এর মধ্য দিয়ে হয়ে থাকে দুই বাংলার সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষদের মিলনমেলা।
এখানে এক মাথার ওপর ওড়ে বাংলাদেশের লাল-সবুজ এবং ভারতের সবুজ-সাদা ও গেরুয়া রঙা জাতীয় পতাকা। বিএসএফ ও বিজিবি সদস্যদের মধ্যে একতালে যৌথ প্যারেড হয়। দুই বাংলার শিল্পীরা প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠেন স্বদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে প্রতিবেশি রাষ্ট্রের বাসিন্দাদের সামনে তুলে ধরতে। এই ব্যতিক্রমধর্মী অনুষ্ঠান উপভোগ করতে ঢল নামে দেশি-বিদেশি পাসপোর্ট যাত্রী, পর্যটক ও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশাজীবী শত শত নারী-পুরুষের। হাঁটি হাঁটি পায়ে এগিয়ে এসে আনন্দ নিতে ভোলে না অবুঝ শিশুরাও।
অনুষ্ঠানটির নামকরণ হয়েছে ‘জয়েন্ট রিট্রেড সেরেম্যানি’। সীমান্তরক্ষী বিজিবি ও বিএসএফ এবং সীমান্তে বসবাসরত মানুষের মধ্যে ভ্রার্তৃত্ববোধ ও সৌহর্দ্যপূর্ণ মনোভাব জোরদার করার উদ্দেশ্যে ২০১৩ সালের ৬ নভেম্বর দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা যৌথভাবে এই রীট্রেড সেরেম্যানির উদ্বোধন করেন। সেই থেকে এটি হয়ে আসছে রোজ বিকেলে।
অনুষ্ঠান উপভোগ করতে আসা কলকাতার মধ্যমগ্রামের অমিতাভ বিশ্বাস জানান, বাংলাদেশ তার পূর্ব পুরুষের জন্মস্থান। অনেক স্বজন দেশভাগের পর বাংলাদেশে রয়ে গেছে। কিন্তু দেশভাগ হলেও আত্মার সম্পর্ক তো আর বিচ্ছেদ হয়নি। তাই তো মন কাঁদে ফেলে আসা স্বজনদের জন্য। বাংলাদেশে আসার জন্য কয়েক বছর ধরে তিনি পাসপোর্ট তৈরির চেষ্টা করছেন। কিন্তু কাগজপত্রের জটিলতার কারণে তা হয়নি। এর মাঝে স্বজনদের সঙ্গে দেখা করার জন্য কয়েকবার চেকপোস্টে আসার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বিএসএফের বাঁধার কারণে দেখা হয়নি। এবার রীট্রেড সেরেম্যানি অনুষ্ঠান দেখার কথা বলায় বিএসএফ বাঁধা দেয়নি। তিনি এখানে এসে বাংলাদেশি স্বজনদের সাথে কিছু সময়ের জন্য হলেও দেখা করতে পেরে খুব আনন্দিত। এ সময় তার ছেলেমেয়েদের বাংলাদেশের মাটি ছুঁয়ে আনন্দ করতে দেখা যায়। কেউ কেউ আবার মুঠি ভরে নিচ্ছে বন্ধুদের দেখাবে বলে- এটা বাংলাদেশের মাটি!
বাগেরহাটের চিলতমারী গ্রামের কাওছার তার পরিবার নিয়ে বেনাপোলে বেড়াতে এসেছিলেন। এর আগে কখনও ভারতে যাননি তিনি। দুই বাংলার এমন অনুষ্ঠানের কথা শুনে তিনিও এসেছেন আনন্দ উপভোগ করতে। ভারতীয় সীমানায় পা রেখে তাদের মধ্যেও এক অজানা আনন্দ!
বেনাপোল সরগম সংগীত অ্যাকাডেমির সভাপতি মোস্তাফিজ্জোহা সেলিমের মন্তব্য, আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের স্বার্থে বেনাপোল স্থলবন্দর এলাকায় দেশের প্রথম সারের সরকারি কর্মকর্তারা তাদের পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মানুষজনের বসবাস রয়েছে। কিন্তু এখানে আজও পর্যন্ত কোনো বিনোদনকেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। তাই রিট্রেড সেরেম্যানি সবার জন্য একমাত্র ভরসা। সময় পেলে সবাই এখানে পরিবার নিয়ে আড্ডা দিতে আসে।
বাংলাদেশ ও ভারতের বিশেষ বিশেষ দিন অথবা প্রশাসনিক বড় কর্মকর্তার আগমনে রীট্রেড সেরেম্যানিতে সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়াজন করে বিজিবি ও বিএসএফ সদস্যরা। তখন ব্যতিক্রমধর্মী অনুষ্ঠানে সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষের আড্ডায় হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে। এতে দুই দেশের মানুষের মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও গভীর হয়।
সীমান্তে কর্তব্যরত দুই দেশের প্রশাসনিক সূত্রে জানা যায়, উভয় দেশের মধ্যে চোরাচালান, মাদক, অস্ত্র এবং নারী ও শিশু পাচার প্রতিরোধে সীমান্তরক্ষী সৈনিকদের মধ্যে আন্তরিকতার প্রয়োজন। কিন্তু সীমান্তে কর্মরত বিজিবি ও বিএসএফ ভিন্ন ভাষাভাষি। এ কারণে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতার অভাব দেখা দেয়। এ ছাড়া প্রতিবেশি দেশ ভারতে এমন অনেকে আছেন যাদের স্বজনরা পাসপোর্ট জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশে আসার সুযোগ পান না। তেমনি একই সমস্যা আছে বাংলাদেশেও। রীট্রেড সেরোম্যানি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উভয়ই কাছাকাছি আসতে পারায় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বেড়েছে|
যশোরের ২৬ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল জাহাঙ্গীর হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘এ অনুষ্ঠান আপাতত দুই দেশের মধ্যে স্বল্প পরিসরে হচ্ছে। বৃহৎ আকারে অনুষ্ঠানটি করার জন্য জাইগা অধিকরণসহ বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। তখন বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তের জয়েন্ট রীট্রেড সেরেম্যানি বিশ্বদরবারে ব্যাপক আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। এতে প্রশাসন ও সাধারণ মানুষের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বৃদ্ধিতে এ সীমান্তে অপরাধমূলক কর্মকান্ড অনেকাংশে কমে আসবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩০ ঘন্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৬
এএইচ/জেএইচ