সুচিত্রা সেন যদি এখন বেঁচে থাকতেন, কেমন থাকতেন? তিনি কি লোকচক্ষুর আড়াল থেকে বাইরে আসতেন? দুই বছর আগে অনেকদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা বাংলা ছবির এই মহানায়িকা যদি সুস্থ হতেন, তাহলে কি স্বেচ্ছা নির্বাসনের ইতি টানতেন? এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া হয়নি, আর হবেও না। সুচিত্রা সেন আর আসবেন না।
সুচিত্রা সেন মানেই যেন শেষ না হওয়া গল্প। জীবনে যেসব চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, মূর্তিমতি লাবণ্য, সৌন্দর্য ও প্রতিভার সম্মিলনে সেগুলোতে মিশিয়ে দিয়েছিলেন অদ্ভুত বিষণ্নতা। তিনি ছিলেন জমকালো সেলুলয়েড সেনসেশন! তার ঘাড় কাত করে তাকানো ছিলো বিখ্যাত ম্যানারিজম। যুগ যুগ ধরে আজও চলে আসছে এটা। নিজের অভিব্যক্তি ও সৌন্দর্য আবেগ ভরে উপস্থাপনে তিনি ছিলেন অনবদ্য। সাধারণ একটা টাঙ্গাইল শাড়ি পরলেও তাকে অসম্ভব রূপসী দেখাতো। তার স্টাইলের বিশেষত্বই ছিলো সারল্য।
সুচিত্রা সেনের নাম শুনলেই অতীতকাতরতায় ভোগেন দর্শকরা। দুই বাংলার তরুণী থেকে শুরু করে গৃহবধূদের অনুসরণীয় ছিলেন তিনি। অনিন্দ্যসুন্দর মুখ, আকর্ষণীয় শারীরিক গড়ন ও অতুলনীয় অভিনয়ের সুবাদে তিনি পৌঁছেছিলেন খ্যাতির শিখরে। তার চুল, চোখ, সাজগোজ বাঙালি নারীদের ফ্যাশনের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
তখনকার রক্ষণশীল সমাজে পুরুষদের কাছে প্রেমিকার আদল ছিলেন সুচিত্রা। তাকে দেখলেই মনে হতো পাশের বাড়ির মেয়ে। এই কীর্তিমতী নারী জন্মেছিলেন আমাদের পাবনায়। ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল বাংলাদেশের বৃহত্তর পাবনার সিরাজগঞ্জ মহকুমার ভাঙাবাড়ি গ্রামে নানাবাড়িতে সুচিত্রা সেনের জন্ম। পর্দা-নাম সুচিত্রা সেন হলেও বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত আর মা ইন্দিরা দেবী মেয়ের নাম রেখেছিলেন রমা দাশগুপ্ত। পাবনা শহরের দিলালপুরের বাড়িতে কেটেছে তার শৈশব-কৈশোর।
সুচিত্রা ছিলেন পাবনা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগে পরিবারের সঙ্গে তাকে কলকাতায় চলে যেতে হয়। পরের বছর কলকাতার শিল্পপতি আদিনাথ সেন তনয় দিবানাথ সেনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের এক বছর পর তাদের ঘর আলো করেন একমাত্র মেয়ে মুনমুন সেন।
১৯৫২ সালে ‘সুচিত্রা সেন’ নামে চলচ্চিত্রাঙ্গনে যাত্রা শুরু করেন রমা সেন। অভিনয়-জীবনে তিনি কোটি কোটি পুরুষের হৃদয়ের রানীর আসন দখল করেছিলেন। তার অভিনীত প্রথম ছবি ‘শেষ কোথায়’ মুক্তি পায়নি। মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম ছবি ‘সাত নম্বর কয়েদি’। সুচিত্রার জয়যাত্রা শুরু হয় ১৯৫৪ সালে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ মুক্তি পাওয়ার পর থেকে। একই বছর মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অগ্নিপরীক্ষা’ তাকে সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তোলে। চরিত্র রূপায়ণে তার সাবলীলতা ও নৈপুণ্য যুগ যুগ ধরে দর্শকদের হৃদয় স্পর্শ করে আছে।
১৯৫৬ সালে ‘একটি রাত’ ছবিতে সরলমতী সান্ত্বনা চরিত্রে অভিনয় করেও প্রশংসিত হন সুচিত্রা। রূপালি পর্দায় তার নায়ক হিসেবে অভিনয় করেই সবচেয়ে বেশি সফল হয়েছিলেন উত্তম কুমার। সুচিত্রাই সত্যিকার অর্থে উত্তমকে ম্যাটিনি আইডল করে তুলেছিলেন। তাদের দু'জনের একসঙ্গে করা ৩০টি বাংলা ছবির মধ্যে সবই বক্স অফিস মাতিয়েছে। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ দিয়েই শুরু হয়েছিল তাদের হিরন্ময় অধ্যায়। অন্য ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘সবার উপরে’, ‘শাপমোচন’, ‘শিল্পী’, ‘সাগরিকা’, ‘পথে হলো দেরী’, ‘হারানো সুর’, ‘গৃহদাহ’, ‘প্রিয় বান্ধবী’ ইত্যাদি। বাংলা ছবির ইতিহাসে সুচিত্রা-উত্তমই সবচেয়ে রোমান্টিক জুটি হিসেবে আখ্যা পেয়েছে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলা প্রেমের ছবিকে স্বর্ণযুগে পৌঁছে দিয়েছিলো উত্তম কুমারের সঙ্গে তার চিরসবুজ জুটি।
উত্তম কুমার ছাড়া সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘দত্তা’ ও ‘প্রণয়পাশা’, বিকাশ রায়ের সঙ্গে ‘সাজঘর’, ‘মেজ বৌ’, ‘ভালোবাসা’, ‘সন্ধ্যাদীপের শিখা’ ও ‘উত্তর ফাল্গুনী’, বসন্ত চৌধুরীর সঙ্গে ‘শুভরাত্রি’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ও ‘মেঘ কালো’ আর অশোক কুমারের বিপরীতে ‘হসপিটাল’ ছবিতে অভিনয় করেন সুচিত্রা।
এ ছাড়া হিন্দি ছবিতে দিলীপ কুমারের সঙ্গে ‘দেবদাস’ ও ‘মুসাফির’, দেব আনন্দের সঙ্গে ‘মুম্বাই কা বাবু’ ও ‘সারহাদ’, অশোক কুমার ও ধর্মেন্দ্রর সঙ্গে ‘উত্তর ফাল্গুনী’র হিন্দি রূপান্তর ‘মমতা’ ছবিতে আর সঞ্জীব কুমারের সঙ্গে ‘আঁধি’ ছবিতে দেখা গেছে তাকে। সুচিত্রা অভিনীত শেষ ছবি ‘প্রণয়পাশা’র নায়ক ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বাংলা চলচ্চিত্র সম্ভারে তার অভিনীত ছবির সংখ্যা ৫৩। আর হিন্দিতে ৭। সব মিলিয়ে ৬০।
অবাক করা ব্যাপার হলো, সুচিত্রা সেনের মতো প্রতিভাবান অভিনয়শিল্পী সত্যজিৎ রায় কিংবা মৃণাল সেনের পরিচালনায় কাজ করেননি। অবশ্য সত্যজিৎ তাকে নিয়ে ‘দেবী চৌধুরাণী’ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অন্য ছবির কাজে ব্যস্ত থাকায় সময় বের করতে পারেননি সুচিত্রা। ওই ঘটনার কয়েক বছর পর দীনেন গুপ্ত ‘দেবী চৌধুরাণী’ পরিচালনা করেন তাকে নিয়ে।
সুচিত্রা সেন অভিনীত ছবির অধিকাংশ গানই শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছে। কালজয়ী এসব গানের তালিকায় ‘হারানো সুর’ ছবিতে গীতা দত্তের গাওয়া ‘তুমি যে আমার’, ‘হসপিটাল’ ছবির ‘এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায়’, ‘পথে হলো দেরী’ ছবিতে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘এ শুধু গানের দিন’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবির ‘কে তুমি আমারে ডাকো’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
১৯৭৮ সালে 'প্রণয়পাশা' মুক্তির পর আর লোকচক্ষুর সামনে আসেননি বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় মিথ সুচিত্রা সেন। সুচিত্রা-রহস্যভেদ করা সম্ভব হয়নি কারও। প্রায় ৩৬ বছর তিনি ছিলেন লোকচক্ষুর আড়ালে। থাকতেন কলকাতার বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে। মেয়ে মুনমুন সেন, দুই নাতনি রাইমা সেন ও রিয়া সেন এবং নিকটাত্মীয় ছাড়া আর কারও ওই বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি ছিলো না।
সুচিত্রা সেন তার ২৫ বছরের অভিনয় জীবনের দাঁড়ি টেনে দিয়েছিলেন বহু আগেই। সাড়ে তিন দশক ধরে অন্তরালবাসিনী থেকেছিলেন। নস্টালজিয়া আর রোম্যান্টিকতার চিরকালীন প্রতীককে না-দেখতে পাওয়ার দীর্ঘশ্বাস জমাট বেঁধে তৈরি করেছিলো অনেক প্রশ্ন- কেমন ছিলেন সুচিত্রা? কেমন হয়েছিলেন দেখতে? উত্তর মেলেনি কোনোটার। ফলে রহস্য দানা বাঁধতে বাঁধতে জন্ম নিয়েছে মিথ। বাঙালির সেই মিথের নাম সুচিত্রা সেন!
২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি ৮৩ বছর বয়সে অনন্তলোকে পাড়ি জমান সুচিত্রা সেন। স্বপ্নকাতর বাঙালির অধরা স্বপ্নের রানী ছিলেন তিনি, থাকবেন রানী হয়েই। তিনি বাঙালির চিরদিনের প্রেমিকা! তাকে ঘিরে যেন কৌতূহলের শেষ নেই, ছোটগল্প যেমন শেষ হয়েও হয় না শেষ!
বাংলাদেশ সময় : ১২৩৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০১৬
জেএইচ