আগের প্রতিবেদন
রানা পাগলা-দি মেন্টাল
কখনও কখনও আমরা ভাবি এক, হয় আরেক। এই যেমন ঈদের আরেক ছবি ‘রানা পাগলা-দি মেন্টাল’ দেখার জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করছিলাম দীর্ঘদিন।
দুপুর আড়াইটার শো। বসুন্ধরা সিটির স্টার সিনেপ্লেক্সে বরাবরই টিকেটের দীর্ঘ লাইন থাকে, তাই দুপুর সাড়ে বারোটাতেই পৌঁছে গেলাম যমুনা ফিউচার পার্কে। দুটি টিকিট চাইলাম। বক্স অফিস থেকে বললেন, ‘দুঃখিত। আপনি দয়া করে দেড় ঘণ্টা পর আসুন। ’ কিন্তু কেনো? তখন যদি টিকিট না পাই! আগে এসেছি যেহেতু, টিকেট কেটে ফেলি- আবদার করলাম। কাচুমাচু করে ব্লকবাস্টার কর্তৃপক্ষ বললেন, আসলে ক’দিন ধরে এ ছবির দর্শক সংখ্যা তেমন নেই বললেই চলে। যদি আপনারা ছাড়া অন্য কেউ দেখেন, তাহলে অবশ্যই টিকিট দেবো। অগত্যা দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করে আবার গেলাম।
এবারও জানানো হলো, এখনও কোনো দর্শকের খোঁজ পাওয়া যায়নি। ১৫ মিনিট পর আসুন। ২০ মিনিট পর গেলাম। উত্তর এলো, দর্শক নেই। মেজাজ বিগড়ে গেলো। এত কষ্ট করে এলাম, ফিরে যাবো? যদি এ ক’দিন দর্শক না-ই থাকে, ছবিটি আপনারা প্রদর্শন করছেন কেনো? এ ছবি নামিয়ে অন্য ছবি দেখান! কর্তৃপক্ষ জানালেন, ৫-৬ জন দর্শক হলেও তারা ছবিটি চালাবেন। আবার মেজাজ বিগড়ে গেলো। মনে প্রশ্ন জাগলো, দুই জনের পরিবর্তে ৫-৬ জন হলে কি তারা মহা ধনী হয়ে যাবেন? তাছাড়া আগে বললে ফেসবুকে স্ট্যটাস দিয়ে দর্শক নিয়ে আনতাম। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কাকে ডাকবো? আমার কথা শুনে, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ‘শিকারি’, ‘বাদশা-দ্য ডন’ ও হলিউড ছবির দর্শকরা হাসছিলেন। স্ত্রী আমার বিব্রত। পেছন থেকে অস্ফুটে বলে, ‘চলো ফিরে যাই। ’ তার মুখের দিকে তাকিয়েই কি-না জানি না, কর্তৃপক্ষের হঠাৎ দয়া হলো। তারা বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, টিকিট নিয়ে যান। ’
এরপরই ঘটলো ইতিহাস! পুরো একটি হলে দর্শক আসনে শুধু আমরা দু’জন। সত্যি বলতে কষ্ট পেয়েছি। নির্মাতারা তাদের কষ্টের টাকা দিয়ে ছবি নির্মাণ করেন, এ ছবি নির্মাণের পেছনে থাকে কতো মানুষের মেধা, পরিশ্রম। কিন্তু দর্শক যদি এভাবে কোনো ছবি ফিরিয়ে দেন, ভালো তো লাগার কথা না। যদিও শুনেছি একক প্রেক্ষাগৃহগুলোতে দর্শক ‘রানা পাগলা-দি মেন্টাল’ দেখেছেন। দেখছেন।
শুরু হলো ছবি। বিগত দুই বছর ধরে ছবিটি নিয়ে এতো চমকের খবর পড়েছি, সময়মতো ছবিটি মুক্তি দেওয়া হলে আমার মনে হয় এর বক্স অফিস ফলাফল অন্যরকম হতো। নতুন পরিচালক শামীম আহাম্মেদ রনি এ ছবির ক্যাপ্টেন। তার কাঁধে ভর করে সব গুণী, মেধাবী, সুপারস্টার শিল্পীরা পথ চলেছেন। নতুন নির্মাতার ভুল হতেই পারে। সব ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবো এই শপথ করেই ছবিটি দেখতে বসি। কারণ আমি ভুল ধরতে নই, বিনোদন নিতে ছবি দেখি। ছবি দেখা শেষে নিজেকে প্রশ্ন করেছি, ‘রানা পাগলা-দি মেন্টাল’ কি আমাকে বিনোদন দিতে পেরেছে? এ ছবির ভালো দিক কী?
ভালো দিক অবশ্যই আছে। ছবির নির্মাতাদের সবকিছুতে একটা চমক দেওয়ার চেষ্টা ছিলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। কাজের ক্ষেত্রে আবেগী ছিলেন তারা, এটি পর্দায়ও বোঝা গেছে। মিশা সওদাগর বিভিন্ন পত্রিকায় বলেছেন, তিনি ‘রানা পাগলা-দি মেন্টাল’ ছবির কাহিনি বোঝেননি। অনেক দর্শকও বলেছেন, তারা এই সাইকো থ্রিলার ছবির মাথামুন্ডু কিছুই বোঝেননি। নিজেকে অনেক জ্ঞানী মনে হয়েছে এটা ভেবে, আমি এবং আমার স্ত্রী কাহিনি ধরতে পেরেছি। শুধু ধরতেই পারিনি, এ ধরনের গল্প নিয়েও যে বাংলাদেশে চলচ্চিত্র হতে পারে, এটা ভেবে ভালো লেগেছে। তবে আমি একমত, এ ধরনের কাহিনি এখনও সহজ-সরল দর্শকের জন্য নয়। পরিচালক এ ক্ষেত্রে একটু নিরীক্ষাই করে ফেলেছেন। আর যেহেতু করেই ফেলেছেন, দর্শকদের কাছে গল্পটি সহজবোধ্য করার জন্য আরেকটু যত্নশীল হতে পারতেন।
ছবির শুরুতেই তিন-চারটি খুন করেন শাকিব খান। এ দৃশ্যগুলো আবার পরবর্তীতে দু’বার লম্বা সময় নিয়ে দেখানো হয়। কেনো? সম্পাদক কি ভুলে গিয়েছিলেন, দর্শক এ দৃশ্যগুলো বেশ কয়েকবার দেখে ফেলেছেন? ‘রানা পাগলা-দি মেন্টাল’-এর চিত্রনাট্য লিখেছেন তিনজন। সবাই আমার প্রিয়। তবে যে কোনো কারণেই হোক, ছবিতে শাকিবের পাগলাটে হয়ে একের পর এক প্রতিশোধ নেওয়ার দৃশ্যগুলো খুব একটা উত্তেজনা তৈরি করতে পারেনি আমার ভেতর। হিন্দি ‘গজিনি’ ছবিতে আমির খান যেমন অসিনের হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বেপরোয়া হয়ে পাগলাটে হয়ে ওঠেন, এখানেও শাকিব ঠিক তেমন। তবে এখানে শাকিবের ‘আমি প্রতিবাদ, আমি প্রতিশোধ, আমি ঘৃণা, আমি মহাকাল, আমি মেন্টাল’ সংলাপ প্রক্ষেপণের ভঙ্গিমা ছিল খুব সাদামাটা। তাছাড়া ‘গজিনি’তে আমির-অসিনের প্রেমের রসায়ন তৈরির পেছনে চিত্রনাট্যকার যথেষ্ট সময় নিয়েছিলেন। যে কারণে পরবর্তীতে আমিরের কষ্ট তারা অনুভব করতে পেরেছিলো।
‘রানা পাগলা’য় আঁচল-শাকিব কিংবা তিশা-শাকিবের প্রেম কাহিনিতে খুব একটা সময় দেওয়া হয়নি। এ কাহিনি না ছিলো টক, না ঝাল, না মিষ্টি। দর্শক কেন ‘রানা’ শাকিব খানের কষ্ট অনুভব করবেন? ছবির শুরুতে চমকের জোগান দিতে কণ্ঠশিল্পী পড়শি হাজির। একটি গানেই শুধু তার উপস্থিতি, কিং খানের সঙ্গে। কিন্তু পড়শী কেনো এলেন, কেনোইবা গানের পর হাওয়া হয়ে গেলেন, লাখ টাকার প্রশ্ন। তাছাড়া শাকিব খানের সঙ্গে পড়শীর জুটি বাবা-মেয়ে কিংবা মামা-ভাগ্নে জুটির কথা মনে করিয়ে দেয়। কি দরকার ছিলো জোর করে পড়শীকে শাকিবের সঙ্গে নাচানো? এ গানটি কি কোনোদিক দিয়ে ‘প্লাস’ করেছে ছবিটিকে?
তিশাকেও বা কেনো এ চরিত্রে শাকিবের নায়িকা হিসেবে নির্বাচন করা হলো? তিশা ছোট পর্দার দাপুটে অভিনেত্রী, সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেত্রী বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না। তিশা মূলধারার বাণিজ্যিক ছবিতে অভিনয় করতেই পারেন। শাকিবও তার নায়ক হতে পারেন। কিন্তু ‘সিমি’ চরিত্রের মাঝে তিশা কি পেয়েছিলেন? প্রধান নায়িকা হলেও বিরতির আগে তিশা পর্দায় আসেন। বিরতির পরও তিশার চরিত্র খুব একটা উত্তাপ ছড়াতে পারেনি। যদিও তিশার পক্ষে বাজে অভিনয় করা মুশকিল, তিনি তার স্বভাবসুলভ অভিনয়ের চেষ্টা করেছেন। তবে প্রধান নায়িকা হয়েও তিশা এ ছবিতে পেয়েছেন দুটি গান। যার মধ্যে ‘উড়ছে ধুলো’ গানে বাণিজ্যিক ছবির নায়িকাদের মতো খোলামেলা কিছু দৃশ্যে ক্যামেরার সামনে এসেছেন। যদিও তার পোশাক এবং স্টাইলিং আরও ট্রেন্ডি হতে পারতো! মোদ্দা কথা, ‘রানা পাগলা’য় তিশার তেমন কিছুই করার ছিলো না। তাহলে এ চরিত্রে তিশার মত অভিনেত্রী কেনো? এ চরিত্রে তো যে কেউই অভিনয় করতে পারতেন! নির্মাতারা দর্শককে এক প্রকার নিরাশই করেছেন চমকের নামে এ চরিত্রে তিশাকে অভিনয় করিয়ে। এটি বুঝতে পেরেই কি তিশা এ ছবির কোনো ধরনের প্রচারণায় অংশ নেননি?
‘রানা পাগলা-দি মেন্টাল’ ছবির সবক’টি গানেই ছিলো ভারতীয় সংগীতের ছোঁয়া। একটি গানেও দেশের ছাপ পাওয়া যায়নি। কোরিওগ্রাফি মোটামুটি। সবচেয়ে খারাপ লেগেছে আঁচলের সঙ্গে শাকিবের গানটি। পুরো ছবিতে কিং খানের লুকে কোনো ধারাবাহিকতা ছিলো না। বেশকিছু দৃশ্যে অস্বাভাবিক মোটা লেগেছে। তাছাড়া ‘সম্রাট’-এর মতো এ ছবিতেও তার কিছু উচ্চারণের ব্যাপারে নির্মাতা ধ্যান দেননি। ট্রেলারকে তিনি বলেছেন ‘টেইলার’, ডায়বেটিসকে ‘ডায়বেটিক’, খাবারের পারিশ্রমিক মানে কি বুঝিনি। পর্দার সামনে এস এ হক অলিক, দেবাশীষ বিশ্বাস, প্রযোজক পারভেজ চৌধুরী, পাভেল ইসলামকে দেখে পুলকিত হয়েছি। সেই সঙ্গে সংলাপে আবদুল্লাহ জহির বাবু, জাকারিয়া সৌখিন নাম শুনেও মজা পেয়েছি। তবে এই মজা পুরো ছবি দেখে পেলে আরও ভালো লাগতো।
অবশ্য আমি হতাশ নই। যৌথ প্রযোজনার দুই ছবির সঙ্গে একই পাল্লায় দেশীয় দুই ছবিকে তুলনা করতে চাই না। বাজেট এবং আয়োজন দুই ক্ষেত্রেই দেশীয় ছবি দুটি পিছিয়ে। তাতে কি? যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা এবং শিল্পীদের পূর্ণ সহযোগিতা পেলে দেশীয় ছবির স্বল্প বাজেটের মধ্যেও নির্মাতারা সেরা কাজ বের করে আনতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস। তবে এ ক্ষেত্রে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকাটা খুব জরুরি বলে মনে করি।
ঈদের ছবি নিয়ে মুক্তির আগে ও পরে বেশ কাদা ছোঁড়াছুড়ি দেখেছি। এক প্রযোজক নায়ককে দুষছেন তো নায়ক পরিচালককে দুষছেন। তাছাড়া যৌথ প্রযোজনার ছবি কেনো হিট হবে? এ নিয়েও রয়েছে অনেকের ক্ষোভ। একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে আমি সাধুবাদ জানাই জাজ মাল্টিমিডিয়াকে। তাদের ছবিগুলোর কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া অনেক প্রেক্ষাগৃহ এই ঈদে নতুন করে চালু হয়েছে। হোক না জিতের ছবি, সিনেমা হল বাঁচলে কিন্তু পুরো ইন্ডাস্ট্রি বাঁচবে। অবশ্য যৌথ প্রযোজনার নামে যৌথ প্রতারণা কখনওই কাম্য নয়। পরবর্তীতে শতভাগ নীতিমালা মেনেই দেশীয় প্রযোজকরা যৌথ প্রযোজনার ছবি করবেন বলে আশা করছি।
সব আধাঁর কাটিয়ে আমি কেনো জানি সবসময় আলোর খোঁজ পেয়ে যাই। ঈদের দিন ঢাকার স্টার সিনেপ্লেক্সে হঠাৎ এক তারকা চিত্রনায়ককে দেখি মুখোশ পড়ে ‘শিকারি’ দেখছেন। ছবি দেখা শেষ করে তিনি জানান, দুপুর থেকে পরপর ‘সম্রাট’, ‘বাদশা’ এবং ‘শিকারি’ তিন ছবিই দেখা শেষ করেছেন। পরদিন ‘রানা পাগলা-দি মেন্টাল’ দেখবেন। চার ছবি দেখা শেষ করে নায়কের ভাষ্য, ‘আমি এ ছবিগুলোতে নেই, তাতে কি? ভালো অভিনয়ের জন্য পড়াশোনাটা তো জরুরি। চার ছবি নিয়ে রীতিমতো পড়াশোনা করছি। শাকিব খানের ‘শিকারি’ সবচেয়ে ভালো লেগেছে। খান সাহেব ভাগ্যবান। তিনি এ ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছেন এবং সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন। ’
ভালো লেগেছে এই নায়কের মতো চারদিকে এখনও ঈদের ছবি নিয়ে চলছে আলোচনা, সমালোচনা। আর কিছু না হোক, সুবাতাস তো বইতে শুরু করেছে। দীর্ঘদিনের দমবন্ধ আবহাওয়াটা তো অন্তত হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। বাংলা ছবির আজ সোনালি দিন। চারদিকে টিকিটের জন্য দীর্ঘ লাইন, টিকিট না পেয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়া, কালোবাজারির কর্কশ কণ্ঠস্বর, প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ বোর্ড, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে পত্রিকা, টিভি চ্যানেলে বাংলা ছবি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা, এমন দিনটিরই তো অপেক্ষায় ছিলাম আমরা। এই সুদিনের অংশীদার হওয়ার জন্য সবাইকে অভিনন্দন।
* লেখক : চিত্রনাট্যকার
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪২ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০১৬
জেএইচ