ঢাকা, শুক্রবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পর্যটন

আলো-আঁধারির মায়ালোক কক্সবাজার

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২২
আলো-আঁধারির মায়ালোক কক্সবাজার

কক্সবাজার থেকে: সন্ধ্যা নেমেছে সমুদ্রপাড়ে। কয়েক পা এগোলেই পায়ের পাতায় শীতল স্পর্শ দিয়ে যাবে ঢেউয়ের দল।

হু হু করে চোখে-মুখে আছড়ে পড়ছে আউলা বাতাস। খোলা আকাশের নিচে এমনিতেই আঁধার খুব একটা থাকে না। অদ্ভুত এক আলো-আঁধারির মায়ালোক।

দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি রয়েছে কক্সবাজারের। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের অবস্থান দেশের সর্ব দক্ষিণের এ জেলাতেই। বৈশ্বিক পর্যটনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দ্রুত বিকশিত হচ্ছে এখানকার পর্যটন শিল্প।

বর্তমানে পর্যটকদের সেবা দিতে নির্মিত হয়েছে অনেক হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট। বেড়ানোর পাশাপাশি সস্তায় সৈকতের ঝিনুক, মনোহরি দ্রব্য, মাছ আর শুঁটকি কেনারও সুযোগ আছে কক্সবাজারে। এছাড়া সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে গা ভাসিয়ে বা দলবেঁধে ঢেউ ছুঁয়ে হেঁটে হেঁটে কাটিয়ে দেওয়া যায় সুন্দর বিকেল। তারা ভরা রাতে সৈকতে বসে সখ্য গড়া যায় গর্জনের সঙ্গে। সাগর ছুঁয়ে আসা বাতাসে শরীর-মন যে জুড়াবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এদিকে লাবনী, সুগন্ধা আর কলাতলী পয়েন্টেই পর্যটকদের সমাগম সবচেয়ে বেশি। তবে মেরিন ড্রাইভ রোড ধরে ইনানি, হিমছড়ির দিকেও চলে যান কেউ কেউ। একপাশে সাগর আর এক পাশে পাহাড় হওয়ায় মেরিন ড্রাইভ রোড দিন দিনই পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে।

এদিকে কলাতলী রোড থেকে ঝাউবন বিচ। অর্ধ কিলোমিটারের মতো সড়কটি কক্সবাজারের অন্য সব সড়ক থেকে একটু আলাদা। মিনিট দশেকের এ হাঁটাপথে সন্ধ্যা থেকে মেলে টাটকা সব সামুদ্রিক মাছ। রাস্তার একপাশ জুড়ে গরম কড়াইয়ে ভাজা হয় সুস্বাদু সব মাছ। শুধু পছন্দের মাছটি বেছে দোকানিকে দিলেই পেয়ে যাবেন কড়কড়ে ‘ফিশ ফ্রাই’। অপরপাশে আবার সবই শুঁটকির দোকান।

কয়েক রকম কাঁকড়া আর চিংড়ি, টুনা, লইট্টা, রূপসা, ছুরি আর জিহ্বায় জল আনা রূপচাঁদা পাওয়া যাবে এখানে। আরও আছে স্যামন, কোরালসহ নাম না জানা, স্বাদ না জানা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। ১০ টাকা থেকে দুই হাজার টাকার মাছও মিলবে এখানে।

দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে সি ফুড কালচারও বেশ সমৃদ্ধ। কক্সবাজারের বিভিন্ন তারকা ও মানসম্পন্ন হোটেলগুলোতে রয়েছে সি ফুডের বিশেষ আয়োজন। মন চাইলে আপনার প্লেটে হাজির হবে- টুনা স্টেক, সি-ফুড প্ল্যাটার, গ্রিলড কালামারির, গ্রিলড স্ন্যাপার ফিশ, প্ল্যাটারে ক্র্যাব, স্কুইড, টুনা, প্রন, স্যামন, লবস্টার প্রভৃতি জিভে জল আনা সব পদ। রেড স্ন্যাপার, ভেটকি, সুরমা মাছ, কাটল ফিশ, দেশি স্কুইড, রূপচাঁদা, ম্যাকারেল, সামুদ্রিক কাঁকড়াও পাবেন লোভনীয় স্বাদে। তবে গুণে-মানে স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের নিশ্চয়তা আপনাকে দেবে ইকো-রেস্টুরেন্টগুলো।

কক্সবাজারে বেড়াতে গেলে কেনাকাটার জন্য বার্মিজ মার্কেটে ঢুঁ না মারলেই কিন্তু চলে না। প্রসাধনী থেকে শুরু করে শুঁটকি মাছ সবই মেলে রাখাইনদের সাজানো দোকানে। সীমান্তবর্তী হওয়ায় মিয়ানমার থেকে একদল রাখাইন সেখানকার বিভিন্ন পণ্য এনে এখানে বিক্রি করে এজন্যই মার্কেটটি ‘বার্মিজ মার্কেট’ নামে পরিচিত পর্যটকদের কাছে। কক্সবাজার শহরের কেন্দ্রেই এর অবস্থান। যেকোনো জায়গা থেকেই রিকশা বা অটোরিকশা যোগে যাওয়া যাবে সেখানে। বললেই হবে, বার্মিজ মার্কেট যাবো। এখানে মিলবে রংবেরঙের ছাতা, বাহারি জুতা, ক্যাপ, নানা ধরনের প্রসাধনী সামগ্রী, শাল, চাদর, ব্যাগ, বেডশিট, নজরকাড়া সব শো-পিস, গহনা, আচার ও চকলেট ইত্যাদি।
 

এদিকে শুঁটকির জন্যও সুনাম কুড়িয়েছে কক্সবাজার। বঙ্গোপসাগরে বিপুল প্রজাতির মাছ পাওয়া যায় বলে এখানকার শুঁটকিতেও রয়েছে বৈচিত্র্য। কক্সবাজারে বেড়াতে আসা পর্যটকরা তাই বেশ সস্তায় পছন্দের শুঁটকি কিনতে পারেন কক্সবাজারে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে লইট্যা, ছুরি, পাছকাড়া, চিংড়ি, রূপচাঁদা, মলা, কাচকি, গইন্যা, নোনা ইলিশ, কালাচাঁদা, লাক্ষা, কোরাল, সুরমা, শৈল, বাইলা, ফাইস্যা, কামিলা, করাত, রূপসা, সুরমা, তাইল্যা, হাইরচাঁদা, মাইট্যা, পোঁপাসহ বিভিন্ন প্রজাতির শুঁটকি।

সবকিছুর পাশাপাশি নজর কাড়বে সৈকতের সৌখিন আলপনা শিল্পীরা। নিপুণ হাতে-পায়ে যেন আলপনা আঁকায় ব্যস্ত এই পর্যটকরূপী শিল্পীরা। বাহারি সেই নকশা। ভাবুক শিল্পী সৈকতে বসে কোথাও নারিকেল গাছ এঁকেছে। কোথাও ফুটিয়ে তুলেছে পাতা বা রূপচাঁদা মাছের অবিকল অবয়ব। কেউ আবার সৈকতে লিখে দেন নিজের বা প্রিয়জনের নাম। সাগরের বালুকাবেলায় এসব অপরূপ শিল্পকর্ম দৃশ্যমান হয় কেবল ভাটার সময়ে পানি সরে গেলে। জোয়ারের সময়ে উত্তাল জলে আবার ঢাকা পড়ে সেসব শিল্পকর্ম।

পর্যটনের পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে সুখ্যাতি রয়েছে কক্সবাজারের মহেশখালীর পানের। এখানকার পানের রস যেমন মিঠা, তেমনি অতুলনীয় তার স্বাদ। আর পান বরজে মাচার ফাঁক গলে অদ্ভুত সুন্দর রোদ রেখার খেলা মন ভরিয়ে দেয়। তেমনি এর বিক্রির সময়ের পান-মশলার সাজও। এই পান নিয়েই জননন্দিত কণ্ঠশিল্পী শেফালী ঘোষ গেয়েছিলেন, ‘বক্সির হাটের পানের খিলি তারে বানাই খাবাইতাম’ গানটি। পরে ‘বক্সির হাট’ এর বদলে ‘মহেশখালী’ শব্দটি বসিয়ে সাম্পানওয়ালা সিনেমায় গানটি ব্যবহার করেন আজিজুর রহমান। ফলে গানটি ছড়িয়ে পড়েছিল দেশজুড়ে।

সব মিলিয়ে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। যারা অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়, তাদের জন্যও সার্ফিং-স্কিসহ বিভিন্ন আয়োজন রয়েছে কক্সবাজারে। এখানে সকালে সমুদ্রের লোনাজলে নেমে গোসল, বিকেলে বালুচরে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখা পর্যটকের প্রধান আকর্ষণ হলেও ইদানীং অনেকে নির্জন সৈকত বেছে নিচ্ছেন। এজন্য দল বেঁধে পর্যটকরা ছুটছেন কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বিভিন্ন পয়েন্টের সৈকতে। কোলাহলমুক্ত-নিরিবিলি পরিবেশে পর্যটকরা সৈকত ভ্রমণের পাশাপাশি পশ্চিমাকাশে অস্তে চলা সূর্য দেখার সুযোগ নেন। আর এসব সৌন্দর্য মিলিয়ে আলো-আঁধারির মায়ালোকে পরিণত হয়েছে কক্সবাজার।

বাংলাদেশ সময়: ১০১৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২২
এইচএমএস/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।