শ্রীমঙ্গল থেকে ফিরে: মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে উর্বর পাহাড়ের (টিলা) ঢালে অথবা সমতলে কোমর সমান চা-গাছ দেখতে দেখতে ইচ্ছে হলো বিশালাকার বৃক্ষকে ছোঁয়ার।
সিএনজিচালককে সে কথা বলতেই তিনি আধাঘণ্টার মধ্যেই নিয়ে গেলেন লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে।
টিকিট কেটে বনে ঢুকতেই চোখে পড়ল পথের দু’পাশে আকাশছোঁয়া গাছের সারি, যেন আমাদের অভ্যর্থনায় দাঁড়িয়ে। গাছগুলো ডালপালা ছড়িয়ে চাঁদোয়ার মতো সৃষ্টি করেছে। বৈশাখের উত্তেজিত সূর্য হার মেনেছে সেই চাঁদোয়ার কাছে। সুশীতল ছায়ার গালিচায় হেঁটে এগোতে থাকলাম সামনের দিকে।
বেশ কয়েকটি গাছের গোঁড়ায় তাদের নাম-পরিচয় লেখা। এই যেমন একটি গাছের নেমপ্লেটে লেখা দুর্লভ আফ্রিকান টিক ওক। একে ‘ক্লোরোফিল ট্রি’ও বলা হয়।
গাছের নামধামের তথ্য মস্তিষ্কে জমা করার ফাঁকেই কানে বাজল অসংখ্য পাখির ডাক। তারা যেন বলছে - আমাদের অভয়াশ্রমে স্বাগতম।
পাখিরা কি আমাদের দেখছে? মাথা উঁচিয়ে গাছগুলোর ডালের দিকে তাকিয়ে হাঁটছিলাম। হঠাৎ একজন বলে উঠলেন - সাবধান! সামনে রেললাইন, হোঁচট খাবেন।
সামনে তাকাতেই দেখলাম সেই রেল ট্র্যাক। সাধারণ একটা রেললাইনকে অসাধারণ ঠেকল মনে। কারণ, এই সেই বিখ্যাত রেললাইন যেখানে অস্কারজয়ী সিনেমা ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ’ - এর শুটিং হয়েছিল।
রেলক্রসিংটার এক কোণে সেই কথা মনে করিয়ে দেওয়া আছে পর্যটকদের। আরেক কোণে কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘আমার আছে জল’ সিনেমার কথা লেখা। সেটার শুটিংও হয়েছিল এখানে।
নিউরনের অনুরণন চলল - জুলভার্নের বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে করা সেই সিনেমার। যেখানে দেখানো হয়েছে বন ঘেঁষে যাওয়া রেলপথে ট্রেন ছুটছে। হঠাৎ চালক খেয়াল করলেন, লাইনের সামনে একপাল হাতি আপনমনে চড়ে বেড়াচ্ছে। ট্রেন থেমে যায়। ব্যাপারটা কী দেখতে কামরা থেকে নেমে আসেন নায়ক। সামনের গ্রামেই হচ্ছিল সতীদাহ। নায়ক ছুটে গিয়ে মেয়েটিকে আগুনে ফেলে দেওয়া থেকে বাঁচান।
সিনেমার দৃশ্য স্মৃতিপটে আনার মধ্যেই গেটম্যান পর্যটকদের সতর্ক করলেন, সরে যান, ট্রেন আসছে। কিছুক্ষণ পরেই লাউয়াছড়া বনের নির্জনতাকে একরকম খুন করে ঝকঝক করে চলে গেল দ্রুতগতির এক যন্ত্রদানব।
রেলক্রসিংয়ের ব্যারিকেড ওঠাতেই আমরা ঢুকে গেলাম বনের ভেতর। যতটা গহীনে যাওয়া যায়। এরই মধ্যে ইচ্ছে জাগল খাসিয়াপুঞ্জিতে যাওয়ার। এই বনেরই ভেতর উঁচু টিলায় তাদের বসবাস। পান চাষ করেই নাকি চলে তাদের জীবন-জীবিকা।
খাসিয়াপাড়ায় যাব কোন পথ ধরে! চারিদিকে তো গাছ আর গাছ, সবুজ আর সবুজ। শুনেছি - এ বনে তিন ধরনের ফুট ট্রেইল রয়েছে। একটি তিন ঘণ্টার, একটি এক ঘণ্টার ও অপরটি ৩০ মিনিটের।
পথে এক গাইড কাম ফটোগ্রাফার দিশা দেখালেন। শুরু হলো বনের পথ ধরে অজানায় হেঁটে চলা। যতই ভেতরে প্রবেশ করছি, বন ততোই ঘন হচ্ছে। কিছু কিছু স্থানে গাছপালা এতোই ঘন যে সূর্যের আলো মাটি অবধি পৌঁছায় না। দুপুরের উষ্ণতা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে! অরণ্যের হিম শীতলতা অনুভব করলাম খানিকটা।
এতো গাছপালার জন্ম হলো কী করে এ তল্লাটে! ইতিহাস বলছে - ১৯২৫ সালে ব্রিটিশ সরকার এখানে প্রথম গাছ রোপণ করে। তা-ই বেড়ে আজকের এই বনে পরিণত। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চিরহরিৎ অরণ্য এটি। আয়তনের দিক থেকে সুন্দরবনের পরেই নাকি লাউয়াছড়ার অবস্থান।
আগে এই বনের নাম ছিল পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বন। ১৯৯৬ সালে ‘জাতীয় উদ্যান’ হিসেবে ঘোষণা করে এ বনের নাম লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান রাখে সরকার।
স্থানীয়রা বলছিলেন, লাউয়াছড়ার গহীনে যেতে থাকলে নানা প্রজাতির বানরের দেখা মিলবে। আর ভাগ্য ভালো থাকলে পেতে পারি বিপন্ন প্রায় উল্লুকের দেখাও। কিন্তু এসব প্রাণীর একটিরও দেখা মিলল না।
মিলবেই বা কি করে! যে ঝকঝকানি আওয়াজে ট্রেন চলে গেল। বনের গাছগুলোতে সেই শব্দ প্রতিধ্বনিতই হয়েছে কয়েকবার। নীরব নান্দনিক নিসর্গে এই রেলপথকে হঠাৎ বেমানান লাগছিল তখন।
তথ্যভাণ্ডার বলছে - লাউয়াছড়া বন বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের জন্য বিখ্যাত। উল্লুকের ১৬টা পরিবার আছে এখানে। এছাড়াও আছে বিভিন্ন প্রজাতির বানর। আছে চশমাপরা হনুমান, লজ্জাবতী বানর, মুখপোড়া হনুমান, আরও আছে শিয়াল, মেছোবাঘ, এমনকি কালো ভাল্লুক আর মায়া হরিণও নাকি আছে। আরও আছে ভয়ংকর জোঁকের। তার চেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার অজগরও নাকি আছে।
আর নানান ধরনের পাখি তো আছেই। তবে লাউয়াছড়া শকুনের জন্য নিরাপদ। শকুন আর ডাহুকের ডাকও শুনেছি।
আমরা হাঁটছি তো হাঁটছি, কতশত গাছকে পাশ কাটালাম। অরণ্যের ঠাস বুনট ভেদ করে আসা সূর্যালোকেই ক্লান্ত হয়ে গেলাম অনেকটা। বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বানানো বেঞ্চে খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিলাম, ফের হাঁটলাম।
এরইমধ্যে জঙ্গলের এক কোণে দেখলাম, এক মধ্যবয়স্কা নারী গামছা পেতে বসে আনারস বিক্রি করছেন। তাকে খাসিয়াপুঞ্জির কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন,‘এইতো ধারেই, পাঁচ মিনিট লাগব আর। ’
জানে পানি এলো, ভাগ্যিস বনের প্রবেশের আগে ডাব কিনেছিলেন আমার স্ত্রী। ডাবের পানি পান করেই টিকিট কেটেছিলাম আমরা। স্ত্রীকে ধন্যবাদ জানালাম।
এবার আনারস কিনে তাকে খাওয়ালে স্ত্রী ধন্যবাদ জানালেন।
আমার স্ত্রী হাঁটার ফাঁকে ফাঁকে বিপন্নপ্রায় গাছগুলোর নাম পড়ছিলেন। একটি গাছ দেখলাম, নাম বাঁশপাতা গাছ। যদিও সেটা বাঁশ গাছ ছিল না, পাতাগুলো অবিকল বাঁশপাতার মতো।
স্ত্রীকে বললাম, লাউয়াছড়া বনে এমন অদ্ভুত ও বিপন্নপ্রায় অনেক গাছ আছে। তথ্য বলছে - ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে এখানে। এর মধ্যে রয়েছে গর্জন, সেগুন, গামারি, মিনজিরি, জামরুল, চাপালিশ, নাগেশ্বর, শিমুল, লোহাকাঠ, জাম, ডুমুর, শিরীষ প্রভৃতি।
সব মিলিয়ে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদ ও প্রাণী রয়েছে। এর মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভচর, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি এবং ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী দেখা যায়।
কথা বলতে বলতে আনারস বিক্রেতা নারীর কথা মনে পড়ল। পাঁচ মিনিট কি এখনও শেষ হয়নি? - স্ত্রী ক্লান্তি নিয়ে শুধালেন।
বললাম, আর যাই হোক খাসিয়া নৃগোষ্ঠীদের দেখতে তোমাকে আর ১২০০ হেক্টরের এই বন পুরোটা ঘুরতে হবে না।
বনের মাঝে হঠাৎ একটা মাঠের দেখা পেলাম, যেখানে গোলপোস্ট বানানো। বোঝাই যাচ্ছে গাছ কেটে মাঠ বানিয়ে এখানে খাসিয়াপল্লীর শিশুরা খেলাধুলা করে। মাঠের চারিপাশে পাহাড়ি বাঁশের বন।
পেরিয়ে পেলাম একটা দরজাহীন গেট। সেটা পেরিয়ে দেখলাম, পথ ঢালু হয়ে থেমেছে এক খাদে। কোথা থেকে যেন পানির ছোট্ট স্রোত বয়ে চলেছে সেই খাদ দিয়ে। লাফিয়ে সেই স্রোতধারা পার করলাম। একজন বললেন, এটাই লাউয়াছড়া, এর নামেই বনের নাম। এখন পানি কম।
এরইমধ্যে পেয়ে গেলাম পানের বাগান বা পানজুম। গাছ জড়িয়ে লতাগুলো আপন মনে বেড়ে উঠে গেছে বহু উপরে। লতায় ধরে আছে একটি একটি করে ছোট-বড় অনেক পান।
সেই পান বাগানকে ক্যামেরাবন্দি করতেই স্ক্রিনে ভাসল টিলার ওপরে মাটির ঘর। মাটি ও কাঠের তক্তা বসিয়ে বানানো সিঁড়ি বেয়ে সেসব ঘরে ওঠা যায়। বুঝলাম কাঙ্ক্ষিত খাসিয়াপুঞ্জির সামনেই দাঁড়িয়ে আমরা।
ঢুকতেই দেখা মিলল ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিহিত খাসিয়া নৃগোষ্ঠীর এক কিশোরী পানপাতা জমা করছে। মধ্যবয়স্কা একজন (তার মা) কলাপাতা কেটে পানগুলোর আঁটি তৈরি করছেন।
জিজ্ঞেস করতেই কিশোরী জানালো - বাজারে বিক্রির জন্য এভাবে প্রস্তুত করা হচ্ছে। এটাই তাদের প্রধান পেশা।
কয়েকটি পাকা বাড়ি চোখে পড়ল, ছাদে সোলার প্যানেল বসানো। ডিশ অ্যান্টেনা, টিভি, মোটরসাইকেলও রয়েছে সেখানে। একটি দোকানে বিক্রি হচ্ছে মিনারেল ওয়াটার, চিপস, সিগারেট আরও অনেক কিছু। সামনে একটি গির্জা। উপাসনালয়ের আশপাশ বেশ পরিপাটি। লালমাটির রাস্তাগুলো সরু হলেও পরিচ্ছন্ন।
কাঁধে ঝুড়ি নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এক যুবক। কোথায় যাচ্ছেন জিজ্ঞেস করতেই বললেন, পানপাতাগুলো কোথাও এক জায়গায় পৌঁছিয়ে দিয়ে আসলেন। এক বৃদ্ধ বললেন, এখানেই তার জন্ম, তার বাবারও জন্ম এখানেই। পান বেঁচেই চলে তার সংসার।
আরও কয়েকটি পান বাগান চোখে পড়ল। ফেরার পথে এক টুরিস্ট গাইডকে বললাম,লাউয়াছড়া চষে বেড়ালাম। তিনি সব শুনে জানালেন, বনের মাত্র কয়েক শতাংশই ঘুরেছি।
তবে এটুকুনেই খুশি আমরা। বিশেষ করে খাসিয়াপুঞ্জি আর বিপন্নপ্রায় গাছ তো দেখেছি।
এক কথায় বলতে পারি শ্রীমঙ্গলে এসে লাউয়াছড়া না ঘুরে যাওয়া পর্যটককে বোকা বললে অত্যুক্তি হবে না। প্রকৃতিপ্রেমী, বৃক্ষপ্রেমী, পশুপ্রেমী যাই হোন না কেন, লাউয়াছড়া আপনার সব চাওয়া-পাওয়া মিটিয়ে দেবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০২৪
এসএএইচ