নাটোর থেকে ফিরে: শ্রীলঙ্কান ধলা শঙ্খে ভর করেই প্রায় দুশো বছরের বেশি সময় ধরে জীবন-জীবিকা চলছে জামনগর শাঁখারি পাড়ার ৭০-৮০ ঘর মানুষের। এ পাড়ার প্রতিটি পরিবারের সব সদস্য যুক্ত শৈল্পিক এ কাজে।
এমনটাই জানাচ্ছিলেন নাটোর শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরের বাগাতিপাড়া উপজেলার জামনগর শাঁখারি পাড়ার কারিগর শ্রী তাপস কুমার ধর।
আবহাওয়া মেঘলা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিও ছিলো। বিদ্যুতের অবস্থাও ছিলো করুণ। তাই পাড়ার অধিকাংশ পরিবার কাটাচ্ছিলো অলস সময়। ভ্যান থেকে নেমে খোঁজ নিয়ে জানা যায় তাপস আর শ্রীনিবাসের ঘরে কিছু কাজ হচ্ছে।
কথামতো তাপসের বাড়ির পাঁচিলের গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকেই নাকে অন্য রকম গন্ধ ঠেকলো। তবে খুব খারাপ নয়। বাঁয়ে তাকিয়ে দেখা মিললো বাঁশের চটায় ঘেরা খড়ের চালের ছোট একটি ঘর। সেখানে চুনের মতো পড়ে রয়েছে শঙ্খের গুঁড়া। আওয়াজ দিতেই বের হয়ে এলেন তাপস। তখনও ঘরে মেশিন বসেনি। বিদ্যুৎ আসছে যাচ্ছে বলে মেশিন বের করেননি। তবু দূর থেকে এসেছি শুনে বের করলেন। বসলেন কাজে।
মেশিন চালু হওয়ার কয়েক মিনিটেই আবার বিদ্যুতের দেখা নেই। হাত ঘুরিয়ে কাজ করতে করতেই কথা হচ্ছিলো তার সঙ্গে।
সনাতন ধর্মের মানুষ শাঁখা ছাড়া তাদের বিয়ে কল্পনা করতে পারেন না। কন্যার বাবা যেমন মেয়েকে শাঁখা দেন, তেমন স্বামীও স্ত্রীর জন্য কেনেন শাঁখা। কেন এই শাখা- তার রয়েছে ধর্মীয় ব্যাখ্যা। সেদিকে বেশি এগোলেন না তাপস।
বললেন, শাঁখা তৈরি বেশ কষ্টসাধ্য কাজ। পুরো প্রক্রিয়ায় সময় কম লাগে না। তবে মেশিনে করলে কাজ দ্রুত এগোনো সম্ভব।
উত্তরাঞ্চলের অন্যতম এ শাঁখারীপাড়ায় শাঁখা তৈরি মূল উপকরণ আসে শ্রীলঙ্কা থেকে। ভারত মহাসাগরের শ্রীলঙ্কান অংশে যে ধলা শঙ্খ পাওয়া যায় সে শঙ্খ মেশিনে চুড়ির আকৃতিতে কেটে তারা রপ্তানি করে। জামনগরের শাঁখারীরা এ শঙ্খ কেনেন খুলনা থেকে। জাহাজে মংলা বন্দর হয়ে আসে শঙ্খগুলো। ডলারের দাম বাড়া-কমার উপর নির্ভর করে দাম।
১শ শঙ্খ কিনতে মানভেদে গুনতে হয় ১০ থেকে ১৪ হাজার টাকা পর্যন্ত।
মোটরচালিত মেশিনে পাথরের চক্রে শঙ্খ ঘঁষে শাঁখায় পরিণত করার কাজ করতে করতে কথাগুলো জানাচ্ছিলেন তিনি।
তাপস জানান, একটি মেশিনে সারাদিন তিনজন পর্যায়ক্রমে কাজ করতে পারেন। মেশিনের কাজটি করেন বাড়ির ছেলেরা। পরিবারে সদস্যদের বয়স ১৪-১৫ হলেই এ কাজে হাতেখড়ি হয়। আর মেয়েরা করেন নকশাকাটার কাজ। একদিনে সর্বোচ্চ ২শ পিস শাঁখার কাজ করতে পারেন তারা।
ধারালো শঙ্খগুলো হাতে পরার উপযোগী হলে দেওয়া হয় নকশার জন্য। নকশা করার ঘর আবার আলাদা। যারা নকশা করেন তারা শুধু এ কাজই করেন।
দু’ঘর পরের শ্রীবাস ও জ্যোতিষ নকশার কাজ করেন। কিন্তু বিদ্যুতের জন্য তাদের কাজও বন্ধ। আমাদের দেখেই কাজে বসলেন। কাঠের খণ্ডে রেত দিয়ে হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় আধাঘণ্টার মধ্যেই অনেক নকশা করে ফেললেন শ্রীবাস।
তিনি জানান, দিনে সর্বোচ্চ ২০ থেকে ২৫ জোড়া শাঁখায় নকশা কাটতে পারেন তারা। প্রতি জোড়ার কাজ করতে সময় লাগে আধাঘণ্টা থেকে একঘণ্টা। মজুরি পান জোড়া প্রতি মাত্র ১০ টাকা। এ নিয়ে আক্ষেপও কম নয় তাদের।
তাদের ডিজাইনে থাকে মাছ, লতা, পদ্মকলি, পাখি, শাপলা প্রভৃতি।
শ্রীবাসদের কাছে থেকে ডিজাইন করিয়ে নিয়ে তাপস ধররা বিক্রি করেন বাজারে। তবে তাদের কাচে পাইকাররা আসেন বেশি। দিনাজপুর, রংপুর, কুড়িগ্রামসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায়।
তাপস জানান, বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য, মাঘ, ফাল্গুন, আষাঢ়, শ্রাবণ ও পৌষমাস তাদের ব্যবসা ভালো যায়। এ সময় বিয়ের লগ্ন থাকে বেশি। সিজন ও মানভেদে প্রতিজোড়া শাঁখা বিক্রি হয় ২৫০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত। এভাবে মাসে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় হয় তাদের।
পাড়ার প্রত্যেকের ঘরবাড়ি দেখেও বোঝা গেলো পাড়ার লোকজন মোটামুটি ভালোই আছেন। পুরুষের পর পুরুষ ধরে তারা আগলে রেখেছেন এ শৈল্পিক ব্যবসা।
বাংলাদেশ সময়: ০৭০০ ঘণ্টা, মে ১৫, ২০১৬
এএ
**ধোঁয়ায় ধুঁকছে চলনবিল জাদুঘর
** রস জ্বালিয়ে গুড় (ভিডিওসহ)
** চলনবিলের পথে-প্রান্তরে (ভিডিওসহ)
** চলনবিলের পথে-প্রান্তরে (পর্ব ৬)
**ওষুধি গাছে ‘সুস্থ’ গ্রাম (ভিডিওসহ)
** চলনবিলের পথে-প্রান্তরে (পর্ব ৫)
** চলনবিলের পথে-প্রান্তরে (পর্ব ৪)
** চলনবিলের পথে-প্রান্তরে (পর্ব ৩)
** চলনবিলের পথে-প্রান্তরে (পর্ব ২)
** চলনবিলের পথে-প্রান্তরে (পর্ব ১)
** আমহাটীর চামড়ায় সারাদেশে বাজে ঢাক-ঢোল
** ডুবো সড়কে ডুবছে চলনবিল
** ঝাড়ফুঁক-সাপ ছেড়ে ইমারতের পেটে!
** বিলের মাছ নেই চলনবিলের বাজারে (ভিডিওসহ)
** চলনবিলে হাঁস পুষে লাখপতি (ভিডিওসহ)
** হালতি বিলে দাগ কেটে ক্রিকেট, ধুমছে খেলা (ভিডিওসহ)
** ভাসমান স্কুলে হাতেখড়ি, দ্বীপস্কুলে পড়াশোনা
** দত্তপাড়ার মিষ্টি পান ঠোঁট রাঙাচ্ছে সৌদিতে
** একফসলি জমিতেই ভাত-কাপড়
** লাল ইটের দ্বীপগ্রাম (ভিডিওসহ)
** চলনবিলের শুটকিতে নারীর হাতের জাদু
** ‘পাকিস্তানিরাও সালাম দিতে বাধ্য হতো’
** মহিষের পিঠে নাটোর!
** চাঁপাইয়ের কালাই রুটিতে বুঁদ নাটোর
** উষ্ণতম লালপুরে শীতে কাবু পশু-পাখিও!
** পানি নেই মিনি কক্সবাজারে!
** টিনের চালে বৃষ্টি নুপুর (অডিওসহ)
** চলনবিলের রোদচকচকে মাছ শিকার (ভিডিওসহ)
** ঘরে সিরিয়াল, বাজারে তুমুল আড্ডা
** বৃষ্টিতে কনকনে শীত, প্যান্ট-লুঙ্গি একসঙ্গে!
** ভরদুপুরে কাকভোর!
** ডুবো রাস্তায় চৌচির হালতি
** হঠাৎ বৃষ্টিতে শীতের দাপট
** ঝুড়ি পাতলেই টেংরা-পুঁটি (ভিডিওসহ)
** শহীদ সাগরে আজও রক্তের চোরা স্রোত
** ‘অলৌকিক’ কুয়া, বট ও নারিকেল গাছের গল্প
** মানবতার ভাববিশ্বে পরিভ্রমণ
** সুধীরের সন্দেশ-ছানার জিলাপির টানে
** নতুন বইয়ে নতুন উদ্যম