মহাস্থানগড় ঘুরে: আকাশে সাদা-কালো মেঘের ভেলা। চারপাশ ঘিরে অসংখ্য গাছপালা।
নদীর কথাটুকু বাদ দিলে চোখে ধরা দেবে সবুজ-শ্যামল বেষ্টিত এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। যা আজও সবাইকে বিমোহিত করে। অত্যন্ত আপন করে দর্শনার্থী ও পর্যটকদের কাছে টানে। সেই করতোয়া ঘেঁষেই ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ‘গোবিন্দ ভিটা’।
বগুড়ার মহাস্থানগড়ের উত্তর-পশ্চিমে মহাস্থান জাদুঘর অবস্থিত। জাদুঘরের ঠিক প্রবেশ পথের সামান্য আগে বগুড়া-শিবগঞ্জ আঞ্চলিক সড়কের সঙ্গে লাগানো উত্তর পাশে গোবিন্দা ভিটার অবস্থান।
কালের আবর্তে ইটের গায়ে জমেছে ময়লা। নিপুণ হাতে গড়া সেই ইটগুলোয় সার্বক্ষণিক যেন লাল-কালোর আভরণ ছড়াচ্ছে চারদিকে। পুরো চত্বরে গজিয়েছে সবুজ ঘাস। গোবিন্দ ভিটার ওপর থেকে সমতল পর্যন্ত ছেয়ে আছে এ ঘাস। যেন সবুজের আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে দিচ্ছে ঘাসগুলো।
সীমানা প্রাচীরবেষ্টিত গোবিন্দা ভিটায় প্রবেশ করতে টিকিট লাগে। প্রবেশ পথেই রাখা হয়েছে টিকিট সংগ্রহের ব্যবস্থা। দর্শনার্থী ও পর্যটকরা সেখান থেকে টিকিট সংগ্রহ করে ইতিহাস-ঐতিহ্য সমৃদ্ধ এ স্থাপনাটি পরিদর্শন করেন।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, গোবিন্দ ভিটা খননকৃত প্রত্নস্থল। যার অর্থ হিন্দু দেবতা তথা বিষ্ণুব আবাস। তবে এ স্থানে বৈষ্ণব ধর্মের কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি। ১৯২৮-২৯ সালে গোবিন্দ ভিটা খনন করা হয়। ১৯৬০ সালে এর খনন কাজ করা হয়।
দীক্ষিতের খননে পাওয়া যায় পরপর চারটি যুগের নিদর্শন। এরমধ্যে গুপ্তযুগে নির্মিত প্রদক্ষিণপথ বেষ্টিত আয়তকার ডায়াস, প্রাথমিক পাল যুগের কমপ্লেক্স ও বহুপার্শ্ব বিশিষ্ট প্রস্তর বেদি, পাল পরবর্তী যুগে নির্মিত কিছু ক্ষয়িষ্ণু দেয়াল ও সম্ভাব্য অগ্নিশিলা। সুলতানি যুগে নির্মিত ভগ্ন মেঝের মধ্যে ১৮টি মুদ্রা ভর্তি মাটিরপাত্র অন্যতম।
প্রাথমিক পাল যুগে মন্দির দু’টি ঘিরে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছিলো। মন্দির ঘেঁষে বহমান করতোয়া নদীর তীরে নির্মাণ করা হয়েছিলো একটি পাথরে বাঁধানো ঘাট। ১৯২২ সালে প্লাবনে যা ভেসে যায়।
পূর্ব ও পশ্চিমে দিকে পাশাপাশি অবস্থিত দুসেট মন্দিরের সন্ধান মেলে। ছয়-সাত শতকে গুপ্তযুগে নির্মিত বারান্দাযুক্ত একটি মন্দির। পশ্চিমে যার অবস্থান। প্রচুর গভীর এর ভিত্তিভূমি ও অফসেট যুক্ত। পাশেই উচুঁতে রয়েছে আরেকটি বারান্দাযুক্ত মন্দির। আট-নয় শতকে এটি নির্মিত। প্রাথমিক পাল যুগের মন্দির এটি। এগারো শতকে মন্দিরের পাশে একটি করে চন্ডী দেবীবর ও নৃত্যরত গণেশের প্রস্তর প্রতিমা পাওয়া যায়। উপরিভাগে পনের-ষোল শতকের সুলতানি যুগে নির্মিত ইটের প্লাটফর্ম আবিষ্কৃত হয়।
গোবিন্দ ভিটায় ১৯৬০ সালে খননে মৌর্য যুগের ছাপা ও ঢালাই করা রৌপ্য মুদ্রা, উত্তরাঞ্চলীয় কালো চকচকে মাটিরপাত্র, সুঙ্গ যুগের ৬টি পোড়া মাটির ফলক, খ্রিষ্টীয় প্রথম-দ্বিতীয় শতকের খোদাই করা নীল পাথরের চাকতি আকৃতির একটি প্রসাধনী ট্রে, চতুর্থ শতাব্দীর কাদা মাটির তৈরি একটি সীলমোহর ও পোড়া মাটির মস্তক, খ্রিষ্টীয় ছয়-সাত শতকের তিনটি বড় মাটির পাত্র পাওয়া যায়। এতে শঙ্খখোসা, চুন ও নরকঙ্কাল ছিলো।
এছাড়া পোড়া মাটির মূর্তি, খেলান, কমমূল্যের পাথরের তৈরি গুটিকা, বোতাম, কানবালা, কুন্তল, নাকফুল, তামা, ব্রোঞ্জের তৈরি বলয়, সুরমা দণ্ড, ছাচে ঢালা তাম্র ও রৌপ্য মুদ্রা প্রভৃতি নানা সময় গোবিন্দা ভিটা খননকালে বিভিন্ন আমলের এসব প্রত্নবস্তু পাওয়া যায়।
মহাস্থান জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান মো. মজিবর রহমান বাংলানিউজকে জানান, দর্শনার্থী ও পর্যটকরা জাদুঘরে রক্ষিত প্রত্নবস্তু দর্শনের সাধারণত গোবিন্দা ভিটা পরিদর্শনে যান। আবার অনেকেই আগে এ স্থানটি ঘুরে মনের তৃপ্তি মেটান। পরে জাদুঘরে আসেন।
নিয়মিত এ স্থানটি পরিদর্শনে বিপুল সংখ্যক দশনার্থী আসেন। এছাড়া মাঝে মধ্যেই দেশ-বিদেশের পযটকরাও ইতিহাস-ঐতিহ্য সমৃদ্ধ গোবিন্দ ভিটায় ঘুরতে আসেন বলেও জানান এ কাস্টোডিয়ান।
বাংলাদেশ সময়: ০৭২১ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৩, ২০১৬
এমবিএইচ/ওএইচ/