উদয়পুর (ত্রিপুরা) থেকে ফিরে: অতিকায় পুকুরের বাঁধানো ঘাটে মানুষের আদর খাচ্ছে জল ডুব ডুব বাদামী রঙের বিরাট শরীর। একটু ডুবছে তো ভুস করে ভেসে উঠছে ফের।
নরম খোলের এই কচ্ছপ প্রজাতিটির নাম বোষ্টমী। মাতাবাড়ির এই পুকুর ছাড়া আর কোথাও নাকি এখন আর দেখা মেলে না বোষ্টমী কচ্ছপের। বিরল প্রজাতির এই কচ্ছপ তাই কার্যত বিলুপ্তির পথে। গোমতি জেলার ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরের এই পুকুরেই কেবল টিকে আছে বোষ্টমী কচ্ছপের গুটিকয় প্রতিনিধি। যদিও চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামির মাজারের বোস্তামি কচ্ছপের সঙ্গে দারুণ মিল রয়েছে এগুলোর।
বিশাল পুকুরটির সাড়ে ৩ দিকে পাকা গাঁথুনির দেওয়াল। ওই দেয়ালগুলোর কারণে পাড়ে ওঠা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো কচ্ছপগুলোর। আর পাড়ের মাটি না পাওয়ায় ডিম পাড়তে পারছিলো না তারা। তাই প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিলো অতি বিরল এই কচ্ছপের প্রজনন।
সম্প্রতি আদালতের আদেশে এক পাড়ের অর্ধেকটা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে ইট-সিমেন্টের দেয়াল। প্রজননের ধারায় ফিরেছে বোষ্টমী। যদিও দর্শনার্থীদের ফেলে যাওয়া বোতল-ক্যান জীবন বিষিয়ে তুলেছে তাদের। কল্যাণ সাগর নামে এই দিঘিই কিন্তু বোষ্টমী কচ্ছপের আদি বাসভূমি।
পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় মন্দির ত্রিপুরেশ্বরী। যার নামে রাজ্যের নাম ত্রিপুরা বলে দাবি করা হয়ে থাকে কোনো কোনো মতে। পঞ্চদশ শতকে রাজা ধনমাণিক্য আগরতলা থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরে এই মন্দির স্থাপন করেন।
মন্দিরটিও কচ্ছপের পীঠের মতো উঁচু এক টিলার ওপরে। স্থানীয়ভাবে যাকে কুর্মপীঠও বলা হযে থাকে।
মন্দিরের ভেতরে কষ্টি পাথরের দু’টি মূর্তি। বড়টির নাম ত্রিপুরেশ্বরী। মহারাজা ধনমানিক্য স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ পাহাড় থেকে এই বিগ্রহ এনে এখানে স্থাপন করে বলে কথিত আছে।
পরবর্তীতে রাজা কল্যাণ মানিক্য মন্দির লাগোয়া স্থানে একটি বিশাল দিঘি খনন করেন। তার নামে ওই দিঘির নাম হয় কল্যাণ সাগর।
শক্তি পুরাণ অনুসারে, এই ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির ৫১ শক্তি পীঠের অন্যতম এক পীঠস্থান। বলা হয়ে থাকে, একবার এক মহাযজ্ঞ আয়োজন করেন দক্ষ রাজা। সেই যজ্ঞে শিব ছাড়া ত্রিভূবনের সবাইকে নিমন্ত্রণ জানানো হয়। শিবের মূর্তি বানিয়ে রাখা হয় প্রাসাদ ফটকে প্রহরী হিসেবে।
খবর পেয়ে ছুটে আসেন দক্ষ রাজারই কন্যা শিবপত্নী সতী। শিবের দারোয়ান মূর্তি দেখে লজ্জায় দেহত্যাগ করেন তিনি। উন্মত্ত শিব তখন সতীর মরদেহ কাঁধে নিয়ে শুরু করেন প্রলয়নৃত্য। কাঁপতে থাকে পৃথিবী। পৃথিবীটাই ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে যায় বুঝি। নিরুপায় হয়ে বিষ্ণু তখন তার হাতের চক্র দিয়ে সতীর শবদেহ খণ্ড-বিখণ্ড করতে থাকেন। সতীর শরীরের মোট ৫১টি খণ্ড পতিত হয় ভারতের বর্ষের ৫১টি স্থানে। সেই স্থানগুলো পরিচিতি পায় শক্তিপিঠ হিসেবে। এমনই দুই শক্তিপিঠ চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ পাহাড় আর মহেশখালীর আদিনাথ পাহাড়। এই ত্রিপুরেশ্বরী তেমনই এক শক্তি পীঠ। রাজমালা গ্রন্থের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে বলা হয়েছে, সতীর ডান পা পতিত হয়েছিলো এখানে।
লাল রঙা ছো্ট্ট মন্দিরটা বহু দূর থেকেও বেশ চোখে পড়ে। গোটা রাজ্য জুড়েই খ্যাতি কুড়িয়েছে এখানকার প্যাড়া সন্দেশ। প্রতি কেজি বিকোচ্ছে ৪০০ রূপী দরে।
আগরতলা থেকে এখানে এই মাতাবাড়িতে আসতে সময় লেগেছে ২ ঘণ্টা ২০ মিনিট। বাসে ভাড়া নিয়েছে ৪০ রূপী করে। রাস্তাগুলো অপরিসর হওয়ায় ট্রাভেল টাইম বেশি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এই রাজ্যে।
মাতাবাড়ি মন্দির পরিদর্শন শেষে গোমতী পারের ভুবনেশ্বরী মন্দির আর রাজা বিজয় মানিক্যের প্রাসাদ দেখে আসার জন্য ১শ’ রুপীতে অটো রিজার্ভ পাওয়া গেলো।
আরও পড়ুন:
***আগরতলায় শতবর্ষী মসজিদ, প্রাসাদের আদলে স্টেশন
**রাজ প্রাসাদ যেখানে জাদুঘর
**মাণিক্য রাজ্যের নাম কি করে ত্রিপুরা
**আড়াইশ’ টাকায় আগরতলা, ঢাকা থেকে ৪ ঘণ্টা
বাংলাদেশ সময়: ২০৩৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৩, ২০১৬
জেডএম