উদয়পুর (ত্রিপুরা) থেকে ফিরে: ভৈরব মন্দিরকে বাঁয়ে রেখে কিছু দূর এগুতেই তিনটি প্রাচীন মন্দিরের কম্পাউন্ড। খা খা দুপুরে আর কোনো দর্শনার্থী নেই মন্দির চত্বরে।
সবুজ ঘাসের চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা লালরঙা মন্দির তিনটির প্রতিষ্ঠাকাল ও প্রতিষ্ঠাতার পরিচয় এখনো অনুদঘাটিত। কেবল একটি মন্দিরের প্রস্তরলিপি ইতিহাসের ওপরে আলোর ছটা ছড়িয়েছে মাত্র। তাতে বলা হয়েছে, মহারাজা গোবিন্দ মানিক্যের স্ত্রী মহারানী গুণাবতী ১৬৬৮ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
অপর দুই মন্দিরেও সমসাময়িক স্থাপত্যশৈলীর ছাপ। তবে প্রকৃত ইতিহাস এখনো ধুলোয় ধাওয়া। প্রতিটি মন্দিরেই জোড়া কক্ষ। সামনেরটি অপেক্ষাকৃত ছোট, ছাদের আকৃতি চৌচালা। পেছনের মূল কক্ষের ছাদজোড়া চৌচালার ওপরে মুকুট আকৃতির বুরুজ। সেই মুকুট আর ছাদের কার্নিশের নিচে স্তরে স্তরে নকশা কাটা। মূল কক্ষের চার কোণার প্রতিটিতে নকশা কাটা মিনার উঠেছে ছাদের নিচ পর্যন্ত। দেওয়ালেও নানা নকশা। প্রতিটি মন্দিরের প্রবেশ পথের খিলানে খাঁজকাটা।
এই মন্দির গুচ্ছ ছাড়িয়ে আর একটু এগুতেই গোমতী নদী। এর উৎপত্তি রাজ্যের উত্তর-পূর্ব প্রান্তের পার্বত্য অঞ্চল ডুমুর। তীব্র স্রোত সম্পন্ন এ নদী পার্বত্যভূমিতে দেড়শ’ কিলোমিটার সর্পিল পথ পাড়ি দিয়ে কুমিল্লা সদর উপজেলার কটক বাজারের কাছে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
গোমতী পেরিয়ে হাতের বাঁয়ে টিলায় ওঠার রাস্তায় পরিত্যক্ত বিষ্ণু মন্দির। দেয়াল ও ছাদে তার আগাছার রাজত্ব।
আর একটু এগুতেই গোমতীর দক্ষিণ তীরে টিলার ওপরে মহারাজা গোবিন্দ মানিক্যের (১৬৬০ থেকে ১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দ) গড়া রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ। খনন করে কিছু কক্ষের আকৃতি সম্প্রতি বের করা হয়েছে মাটির নিচ থেকে। তাতে অবলুপ্ত বিশালতার অবয়ব স্পষ্ট। ওই ঘরগুলোর কোণায় কোণায় রাজকাহিনীর কতো যে অধ্যায় মিশে আছে তা আর কেইবা বলতে পারে! পাশেই দুর্গ আকৃতির একটি ভবন।
উত্তরে গোমতী নদী। পূর্ব ও পশ্চিমে খাড়া টিলা। দক্ষিণ থেকে ঢালু পাহাড় বেয়ে এখানে ওঠা যায় কেবল। এখানে দাঁড়িয়ে তাই চারিদিকে তাকালেই অনুমান করা যায়, ভৌগলিক অবস্থানগত কৌশলে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ এই টিলার অবস্থান। শত্রুর পক্ষে কতোটা কঠিন এই প্রাসাদ দুর্গ আক্রমণ। গোবিন্দ মানিক্যের রণকৌশলগত দূরদর্শীতার প্রমাণও তো এই প্রাসাদের অবস্থানই।
প্রাসাদের কাছেই ভুবনেশ্বরী মন্দির। উঁচু প্লাটফর্মের ওপরে নির্মিত মন্দিরটির আদল অনেকটা গুণাবতী মন্দিরের মতো। তবে চৌচালা ছাদের ওপরে মুকুটের বদলে আছে উল্টানো কলসী। গোমতীর দক্ষিণ পাড়ের ভুবনেশ্বরী আর উত্তর পাড়ের গূণাবতী মন্দির যে সমসাময়িক তা ধরেই নেওয়া যায়।
মন্দিরের পাশে বিশাল এক পাকুড় গাছ ছায়া বিছিয়ে রেখেছে। পাশেই তিনতলা সমান উঁচু ওয়াচ টাওয়ারে উঠে চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলোকন করা যায়। নিচে দেখা যায়, পাহাড়ি ভূমিতে ঘন গাছপালার ফাঁকে গোমতী বইছে। এক সময় এ মন্দিরে নরবলী হতো বলে জনশ্রুতি আছে রাজ্যে।
এখানে বসেই রাজর্ষি উপন্যাস ও বিসর্জন নাটক রচনা করেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ওই দুই মহাকর্মের প্রেক্ষাপটও এই মন্দিরই। আর বিসর্জন নাটকের মুখ্যচরিত্র মহারাজা গোবিন্দ মানিক্য। ওই দুই সাহিত্য কর্মের স্মৃতিস্বরূপ রবি ঠাকুরের ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে প্রাসাদ ও মন্দিরের মধ্যবর্তী স্থানে। প্রাসাদ চত্বরে গড়া হয়েছে রাজর্ষি মুক্তমঞ্চ।
ফের গোমতী পেরিয়ে উদয়পুর বাস স্ট্যান্ডে চলে আসে অটোরিকশা। গোমতি জেলার হেড কোয়ার্টার এই উদয়পুর থেকে ধরতে হয় মহেন্দ্র টাইপের ম্যাজিক গাড়ি। ঠাসাঠাসি ভিড়ে সেদ্ধ হতে হতে হতে পার হয় জামজুরি বন বিট। ত্রিপুরা সরকারের গ্রাম যোজনা সড়ক চলে গেছে বনের ভেতর দিয়ে। হাতের বাঁয়ে পড়ে থাকে পালাটানা বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এ কেন্দ্র থেকেই বিদ্যুৎ আমদানি করছে বাংলাদেশ।
এক ঘণ্টারও বেশি সময়ে ২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত মেলাঘরে পৌছে যায় ম্যাজিক। ফেলে আসা পুরো পথটাতে পাশে থেকে সঙ্গ দেয় গোমতী।
আগরতলা থেকে সিপাহীজলা জেলার ছোট্ট শহর এই মেলাঘরের দূরত্ব ৫৩ কিলোমিটার। এখান থেকে গোমতী জেলার হেডকোয়ার্টার ২০ কিলোমিটার দূরে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে অনেক শরণার্থী এই মেলাঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৩০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ৪, ২০১৬
জেডএম/
আরও পড়ুন:
** ত্রিপুরা সুন্দরীর কল্যাণ সাগরে বোষ্টমী ধুঁকছে (ভিডিও)
** আগরতলায় শতবর্ষী মসজিদ, প্রাসাদের আদলে স্টেশন
** রাজ প্রাসাদ যেখানে জাদুঘর
** মাণিক্য রাজ্যের নাম কি করে ত্রিপুরা
** আড়াইশ’ টাকায় আগরতলা, ঢাকা থেকে ৪ ঘণ্টা