বিরিশিরি ঘুরে (দুর্গাপুর, নেত্রকোনা): গারো পাহাড়ের পাদদেশ ঘেঁষেই যেন স্বমহিমায় বয়ে চলেছে সোমেশ্বরী নদী। মেঘালয়ের গারো পাহাড়ও যেন দূর থেকে নিবিষ্ট মনে অবলোকন করছে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যভান্ডার সোমেশ্বরীর গতিপথ।
রাণীখং পাহাড়ের টিলায় গড়ে উঠা সাধু জোসেফের ধর্মপল্লীতে গিয়েও দৃষ্টি জুড়িয়ে যায় যে কারও। আর স্বচ্ছ টলমলে জল ছাড়াও সোমেশ্বরীর বুকে চিরে রয়েছে সোনালি বালুর প্রান্তর।
বিজয়পুরে রয়েছে সাদা মাটির পাহাড়। যা দিয়ে তৈরি হচ্ছে সিরামিকস পণ্য। আছে নীল পানির হ্রদ। হাতিখেদা আন্দোলনের পাশাপাশি ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতেও ঐতিহাসিকভাবেই ঐতিহ্যবহন করে সুসং দুর্গাপুর আর বিরিশিরি।
এখানে রয়েছে হাজংমাতা রাশিমণির স্মৃতিস্তম্ভ ও হাজংনেত্রী কুমুদিনীর বাড়ি। স্থানীয় সংস্কৃতির প্রাণ হিসেবে পরিচিত বিরিশিরি কালচারাল একাডেমি ছাড়াও এখানে গারো-হাজংসহ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস। তাদের বিচিত্র জীবনপ্রণালী বেশ আকৃষ্ট করে পর্যটকদের।
নান্দনিক এসব পর্যটন সম্ভারে প্রকৃতি যেন নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলাকে সাজিয়েছে অকৃপণ হাতে। এ উপজেলার রূপ-সৌন্দর্যের ঢালা যেন চুম্বকের মতো টানে পর্যটকদের।
কিন্তু সড়ক পথে অপার সৌন্দর্যের এ লীলাভূমিতে পৌঁছাতেই ভোগান্তি আর গলদঘর্ম হতে হচ্ছে ভ্রমণপিয়াসীদের।
এ কারণে দুর্গাপুর-বিরিশিরির নামের পাশে ‘দুর্গম’ শব্দটি যেন পেয়ে বসেছে! চলাচলে অনুপযোগী তবিত ময়মনসিংহ-পূর্বধলা-বিরিশিরি আঞ্চলিক মহাসড়কের মতোই বিকল্প নেত্রকোনা-কলমাকান্দা-দুর্গাপুর সড়কও বেহাল দশায় মার খাচ্ছে দুর্গাপুরের পর্যটন।
সম্প্রতি সরেজমিনে গেলে স্থানীয় ও ভুক্তভোগীরা বেহাল সড়কে পর্যটকদের দুর্গাপুর বিমুখ করার এমন চিত্র তুলে ধরেন।
গারো পাহাড় থেকে নেমে আসা অপরূপা সোমেশ্বরী নদীর পাড়ের প্রাচীন জনপদ দুর্গাপুর। প্রকৃতি আর পাহাড়ি সৌন্দর্যের টানে এখানে যারা আসেন তাদের আনন্দ ধূসর হয়ে যায় যাত্রাপথের নিদারুণ কষ্ট আর যন্ত্রণায়।
সড়কের ভয়াল অবস্থার কারণে প্রতিনিয়ত শুধু নাস্তানাবুদই হতে হয় না পর্যটকদের। দুরু দুরু বুকে চরম আতঙ্ক নিয়েই পথ চলতে হয় তাদের।
ময়মনসিংহ থেকে দুর্গাপুর যেতে দু’টি সড়কই খানাখন্দে ভরা। অনেক জায়গায় কার্পেটিং উঠে গেছে। রয়েছে ছোট-বড় গর্ত। সড়কের ভোগান্তির কারণেই এ মৌসুমে অনেকটাই পর্যটক শূন্য হয়ে পড়েছে দুর্গাপুর।
ভঙ্গুর আর বেহাল সড়কের কারণে এখানকার পর্যটন কতটুকু বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তা জানা গেলো স্থানীয় রিকশা চালক সেলিম মিয়ার (৩৫) কন্ঠে।
রিকশা চালানোর পাশাপাশি পর্যটকদের গাইড হিসেবে কাজ করেন তিনি।
সেলিমের ভাষ্যে- ভাঙাচুরা সড়কের কারণে পারতপক্ষে এখন কেউ দুর্গাপুর আসতে চায় না। গত কয়েক মাস ধইরাই পূর্বধলা-বিরিশিরি সড়ক ও কলমাকান্দা-দুর্গাপুর সড়কের ভগ্নদশা। এ কারণে পর্যটকদের আনাগোনা কমে গেছে। আর আমাদের পেটে টান পড়েছে।
স্থানীয় দুর্গাপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি মোহন মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, দুর্গাপুরে আসা-যাওয়ার সড়ক এবং আভ্যন্তরীণ সড়কেও ইট-পাথরের অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া কঠিন।
আর বৃষ্টি হলে পানি-কাঁদায় একাকার হয়ে উঠে এখানকার সড়ক। বাধ্য হয়ে অসহায়ত্ব নিয়েই চলতে হয় স্থানীয় বাসিন্দা ও আগন্তুকদের।
সড়কের নাজুক চেহারাতেই দুর্গাপুর-বিরিশিরি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন দেশি-বিদেশি পর্যটকরা-এমন মন্তব্য স্থানীয় টংক আন্দোলনের পথিকৃৎ নেত্রী হাজংমাতা শহীদ রাশিমণি স্মৃতিসৌধ সংলগ্ন ফার্মেসির পল্লী চিকিৎসক আশরাফুল আলমের (৩২)।
তার মতে, দুর্গাপুর পাহাড়, নদী আর প্রকৃতির অবারিত সৌন্দর্যের আঁধার হলেও পর্যটকরা স্বস্তিদায়ক ও নিরাপদ সড়কের অভাবে এখানে আসাই কমিয়ে দিয়েছেন। স্থানীয় অর্থনীতিতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
প্রকৃতির সুনসান নির্মল পরিবেশে অবকাশ কাটাতেই সপরিবারে দুর্গাপুরে এসেছেন ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার একটি স্পিনিং মিলের ম্যানেজার।
আকর্ষণীয় ও মনোমুগ্ধকর বিজয়পুরে সাদা মাটির পাহাড়ের পাশে দাঁড়িয়ে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, দূর থেকে পাহাড়ের সবুজ চূড়ায় তুলার মতো মেঘরাশির বিচরণ অন্যরকম শিহরণ জাগায় মনে। কিন্তু বেহাল সড়কে ম্লান হতে বসেছে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
‘ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ উপজেলা দুর্গাপুর। এখানকার পর্যটনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। ফলে দুর্গাপুরের পর্যটন সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। ’ যোগ করেন তিনি।
স্থানীয় স্কুল শিক্ষক আহমদ আলী বলেন, ‘এখানে আবাসনের সমস্যা না নেই। শুধুমাত্র সড়কের কারণেই পর্যটন বিকশিত হচ্ছে না । ’
বেহাল সড়কে নজর দিলে দুর্গাপুরের পর্যটনের সিংহদুয়ার খুলে যাবার পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়বে বলে মনে করেন স্থানীয় কুল্লাগড়া ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামের ব্যবসায়ী রোকন উদ্দিন (৪৫)।
সোমেশ্বরী ঘাট থেকে শিবগঞ্জ ঘাটে যাবার সময়ে এ বিষয়টি নিয়ে কন্ঠে আওয়াজ তুলেন এ খুদে ব্যবসায়ী।
অবশ্য চাষের জমির মতো বেহাল সড়কের বিষয়ে নেত্রকোনা সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী দিদারুল আলম তরফদার বাংলানিউজকে জানান, পূর্বধলা-বিরিশিরি সড়ক নির্মাণের জন্য একনেকে ৩১৬ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে।
‘আগামী ৩ বছরের মধ্যে স্থানীয় জনসাধারণ ও পর্যটকরা এর সুফল ভোগ করবেন। ’
আর কলমাকান্দা-দুর্গাপুর সড়কের ভগ্নদশার কথা স্বীকার করে এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলী ইসমত কিবরিয়া বাংলানিউজকে বলেন, সড়ক সংস্কারের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে দরপত্রও আহবান করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১৬
এমএএএম/এমএ