আলীকদম (বান্দরবান) থেকে: আকাশে উঠতে শুরু করলো চাঁদের গাড়ি। এতো খাড়া ঢালে গোঁ গোঁ আওয়াজে যেনো বিগড়ে যেতে চাইছে ফোর হুইলারের শক্তিশালী ইঞ্জিন।
নির্মাণ কাজের একটা আজদাহা গাড়িকে আকাশ থেকে নেমে আসতে দেখা গেলো। কোনোমতে সেটাকে পাশ কাটানো গেলো বটে, কিন্তু গোঁয়ারের মতো খক করে কেশে ঠিকই থেমে গেলো ইঞ্জিন। কোনোমতে ব্রেকে পা চেপে গাড়ি স্থির রাখলো চালক। চাকা হড়কালেই হাজার মিটার নিচে গড়াবে গাড়ি। অভিজ্ঞ চালকের জুলফি বেয়ে দরদরিয়ে ঘাম ঝরছে।
এখানে হয়তো প্রায়ই আটকে যায় গাড়ি। তাই বেশ ক’টি ইট রাখা রাস্তার পাশে। পেছন থেকে দ্রুত নেমে হেলপার ইটের ঠেকা দিলো চাকার নিচে। ব্রেকের ওপর তবু শক্ত হয়ে চেপে আছে চালকের পা।
এতো উঁচুতে উঠতে অতিরিক্ত শক্তি ক্ষয়ের কারণে খুব বেশি গরম হয়ে গেছে ইঞ্জিন। একটু সময় দিয়ে পানি দেওয়া হলো ইঞ্জিনে। তারপর ফের শুরু হলো পাহাড় বাওয়া।
আকাশের দিকে শক্তিশালী চাঁদের গাড়ি উঠছে তো উঠছেই। হার্টবিট বেড়ে গেছে সবার। হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে এই ঝুঁকিপূর্ণ পথে উঠতে উঠতে চোখের সামনে ফুটে উঠলো অবারিত এক বিস্ময়। আকাশের পটে ডিমের পিঠের মতো ফুলে আছে একটা পাহাড়। ডিমের পিঠের মতো বলেই ডিম পাহাড় নাম তার। সবুজ শরীরে তার স্বর্গের হাতছানি।
মনের ভেতর আর কোনো ভয়-শঙ্কার রেশ রইলো না। সব কিছুর বদলে এখন কেবল ওই ডিম পাহাড়ের আবেশ। আকাশ-পাহাড়ের মিতালী এতো সুন্দর হয়!একটানা দীর্ঘ ৮ কিলোমিটার ঢাল বেয়ে ডিম পাহাড়ের কাছে যখন চাঁদের গাড়ি পৌঁছুলো তখন ২৭৯৭.৮ ফুট উচ্চতা দেখাচ্ছে অলটিমিটার। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাস্তার সর্বোচ্চ পয়েন্টে উঠে আর একবার পানি পাল্টানো হলো ইঞ্জিনের। চালক জানালো, শক্তি ক্ষয় বেশি হয় বলে ১ কিলোমিটার উঠতে ১ লিটার তেল পোড়ে এখানে।
দু’পাশে অসংখ্য পাহাড়। পাহাড়ের পর পাহাড়। পাহাড়ের মাথায় মেঘের পাহাড়। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে শ্বেত পুকুর গড়েছে আয়েসি মেঘের দল।
বান্দরবানের প্রধান দুই নদী সাঙ্গু আর মাতামুহুরি উপত্যকাকে বিভক্ত করেছে এই পাহাড় শ্রেণী। বাঁয়ে কয়েক কিলোমিটার দূরেই মিয়ানমার সীমান্ত। পাহাড়ের চূড়ায় চুড়ায় কিছুক্ষণ ওড়ার পর থিম পার্কের রাইডের মতো নিচে নামতে শুরু করলো চাঁদের গাড়ি। একটা পাহাড়ের চূড়া থেকে খানিকটা নেমে ফের উঠে যায় আর একটা পাহাড়ের চূড়ায়। প্রতিটি চূড়া পেরুনোর সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে উচ্চতা। তবে প্রতিটি পাহাড় পাড়ি দেওয়ার সময়ই ফিরে ফিরে আসতে থাকে আকাশ ফুঁড়ে উপরে ভাসার অনুভূতি। নীল আকাশ যেনো নেমে এসে পাহাড়ের সঙ্গে মিতালী গড়েছে এখানে। অথবা পাহাড় উঠে গেছে নীল আকাশের বুকে। সবুজ পাহাড় আর নীল আকাশে মাঝে খেলায় মেতেছে মেঘেরা।
ওঠার সময় কোনো পাহাড়ি বসতি চোখে পড়িনি। এবার হঠাৎ হঠাৎ একটা দু’টো ছোট পাড়া চোখে পড়ছে। জনা কয় শিশু ফুটবল খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে পাহাড়ের মাথায়। কোথাও কোথাও খদ্দেরের আশায় বসে আছে নি:সঙ্গ দোকানি।
প্রায় ৭০টি পাহাড় ডিঙ্গিয়ে ৩৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে চাঁতের গাড়ি যখন আলীকদম পৌঁছুলো, তখন উচ্চতা কমে একশ’ ফুটেরও নিচে নেমে গেছে। পাহাড়ি জনপদে সূর্যাস্তের ছায়া। শুরুর দিকে নির্মাণ কাজের সেই গাড়ি ছাড়া ফেলে আসা গোটা রাস্তাটাতে আর কোনো গাড়ি দেখা যায়নি। তবে মাঝেমধ্যে ছুটে গেছে দেড়শ’ সিসির পালসার আর ডিসকভার বাইক। ওগুলো আসলে আলীকদম টু থানচি পাবলিক সার্ভিস। প্রতিটি বাইকে চালকের পেছনে দু’জন করে বসা। ভাড়া জনপ্রতি ৫শ’ করে। এ দুই উপজেলার মধ্যে চলাচলের জন্য এই বাইকই মূল ভরসা। নয়তো যেতে হবে চাঁদের গাড়ি ভাড়া করে। তবুও শক্তিশালী ফোর হুইলার ছাড়া আর সব গাড়ির পক্ষে এই পাহাড় ডিঙ্গোনো সম্ভব নয়।
৩০ থেকে ৩৫ ফু প্রশস্ত গোটা রাস্তাটাই নির্মাণ করা হয়েছে পাহাড়ের ঢালে। খরচ পড়েছে প্রতি কিলোমিটারে সোয়া ৩ কোটি টাকা করে। ২০০৬ সালে শুরু হওয়া রাস্তার নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে ২০১৫ সালে। এই রাস্তা চালুর আগে থানচি থেকে আলীকদম যেতে হতো পায়ে হেঁটে পাহাড় ডিঙ্গিয়ে। সময় লাগতো কয়েক দিন। এখন তো মাত্র সোয়া এক ঘণ্টায় থানচি থেকে আলীকদম আসা গেলো।
এ রাস্তা যে বান্দরবানের দক্ষিণ অংশে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
**পায়ের নিচে ছবির মতো বলি পাড়া
** পাহাড়ের উপরে দেবতার পুকুর
** পাহাড়ের খাদে রাম-সীতার ধুমনিঘাটে
**বাঁশের রাজবাড়িতে এক চক্কর
**বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া ভারতীয় বাঁকে
** বয়সী বটের নিচে বিশ্বাসের বাসা
** গিরিখাদের হাজারছড়ায় সীমাহীন বিস্ময়
বাংলাদেশ সময়: ১৯১২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৯, ২০১৬
জেডএম/