সাতক্ষীরা ঘুরে: ঢাকা থেকে আবির এই প্রথম বেড়াতে এসেছেন সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে। বাসস্ট্যান্ড থেকে ভেতরের দিকে যাবেন।
আবির তো অবাক! এই বাসস্ট্যান্ডে হেলিকপ্টার আসবে কোথা থেকে! তাছাড়া সামান্য দূরত্বে হেলিকপ্টারেই-বা যেতে হবে কেন? উদয় হওয়া এসব প্রশ্নের সঙ্গে মনে মনে ভাবলো, পরামর্শদাতার মাথায় নিশ্চয় সমস্যা রয়েছে।
এখানে হেলিকপ্টার আসবে কোথা থেকে! এমন প্রশ্নে মৃদু হেসে লোকটি নিজের সঙ্গে থাকা বাইসাইকেলটিকে দেখিয়ে দেন। কৌতুহল মিটলে হেলিকপ্টাররূপী বাইসাইকেলে করে গন্তব্যস্থলে রওনা দেন আবির।
সাতক্ষীরার এই অঞ্চলে যোগোযোগের অত্যন্ত জনপ্রিয় বাহন ‘হেলিকপ্টার’। পায়ে চালানো সাইকেলের পেছনের কেরিয়ারে যাত্রী বহন করা হয়। কেরিয়ারে কাঠের তক্তা বসিয়ে এর উপর ফোম বা নারকেলের ছোবড়া দিয়ে বসার স্থানটি সিট কভারে ঢেকে করা হয় আরামদায়ক। সঙ্গে সাইকেলের পিছনের চাকার দুই পাশে লোহার পা-দানি। যেনো যাত্রীরা আরাম করে পা দিয়ে বসতে পারেন। এসব বিশেষ ব্যবস্থার কারণে স্থানীয়রা এ বাহনের নাম দিয়েছে হেলিকপ্টার। তবে ব্যাটারিচালিত ভ্যান, অটোরিকশা ও মোটরসাইলের কারণে দুর্দিন যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী এ বাহনের।
এর প্রমাণও পাওয়া গেলো- শনিবার (২৩ ডিসেম্বর) হেলিকপ্টার খুঁজতে শীতের মৃদু রোদকে সঙ্গে নিয়ে যখন পাউখালী থেকে কালীগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছাই, সেখানে বিশেষ এই যানটির একটিও চোখে পড়লো না।
বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা স্থানীয় বাসিন্দারদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, এখন মানুষ হেলিকপ্টারে যাতি চায় না, এজন্য কমে গেছে। সামনের দিকে (তারালির মোড়) যান, পাতি পারেন।
তারালির মোড় গিয়ে দেখা মিললো কয়েকজন হেলিকপ্টারওয়ালার। সাইকেল নিয়ে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছেন তারা। তবে চোখের সামনে একের পর এক যাত্রী মোটরসাইকেল ও ব্যাটারিচালিত ভ্যানে করে চলে যাচ্ছেন। এতে তাদের চোখে-মুখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠছে।
মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা লতিফ নামে এক হেলিকপ্টারচালক বলেন, এখন আর মানুষ হেলিকপ্টারে চড়তি চায় না। তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য ব্যাটারি ভ্যান, মোটরসাইকেলে যাতি চায়।
এক সময়ের সুখস্মৃতিচারণ করে এ পঞ্চাশোর্ধ্ব বলেন, আগে দিনে তিন-চারশো টাকাও আয় করতি পারতাম। আর এখন একশো টাকাও আয় করতি পারিনে। এ কারণে আধাবেলা হোটেলে পানি টানার কাজ করি।
স্থানীয়দের মতে, সাতক্ষীরা, কালীগঞ্জ, শ্যামনগর উপজেলাসহ পাউখালী, নলতা, কৈখালী, বংশীপুর এলাকার সবখানে এই বাহনের বেশ চলন ছিলো। পাকিস্তান আমলেরও আগে থেকে চলে আসছে এটি। একটা সময় শুধু কালীগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে দু’শোর মতো হেলিকপ্টার যাত্রীর জন্য দাঁড়িয়ে থাকতো। এখন ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলের প্রতাপে দুর্দিন যাচ্ছে হেলিকপ্টারের। পেশা বদলে কেউ ক্ষেত-খামারের কাজ ধরেছেন, কেউ ব্যাটারিচালিত ভ্যান চালাচ্ছেন।
আজিজ নামে অন্য এক হেলিকপ্টারওয়ালা বলেন, ২৪ বছর ধরে হেলিকপ্টার চালাই। হেলিকপ্টারের যাত্রী নিয়ে কেউ কেউ খুলনা পযর্ন্ত গিছি। কিন্তু এখন সবাই মোটরসাইকেলে যাতি-আসতি পছন্দ করে। হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে কষ্ট হলি পরে মানুষ এখন হেলিকপ্টারে চড়তি চায়। এছাড়া কম দূরির হলিও যাতি চায়।
আজহার নামে এক স্থানীয় বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছে দেয় বলে এগুলোকে হেলিকপ্টার বলা হয়। দুই বছর আগেও বাহনটি ভালো চলতো। ব্যাটারিচালিত ভ্যান, মোটরসাইকেলের চেয়ে হেলিকপ্টার যেমন পরিবেশবান্ধব, তেমনি দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কাও কম। কিন্তু কী আর করার, মানুষের ব্যস্ততা অনেক বেড়ে গেছে তাই এটার চলনও দিন দিন কমে যাচ্ছে।
ঘণ্টাখানেকের মতো তারালির মোড়ে দাঁড়িয়ে থেকেও একজন হেলিকপ্টারওয়ালা ছাড়া আর কাউকে যাত্রী পেতে দেখা গেলো না।
বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলার সময় ১০ টাকার ভাড়া হাতছাড়া হলে এক হেলিকপ্টারওয়ালার আফসোসের সীমা ছিলো না। এতে বোঝা গেলো ব্যাটারিযানের চাপে কতোটা অসহায় হয়ে পড়েছেন তারা।
বাংলাদেশ সময়: ১৫১৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১৬
এমসি/এসএনএস
আরও পড়ুন
** মকবুল-আবুল-আইয়ুবের বাঘের সঙ্গে লড়াইয়ের গল্প
** খুলনার হার্ডবোর্ড মিল এখন জঙ্গলবাড়ি!
** সন্ধ্যাটা কাটুক রূপসা সেতুর বর্ণিল আলোয়!
** খুলনার স্পন্দন রুপসার ঘাট!
** হিম শীতে ডাকাতিয়া বিলে
** বাগেরহাটের পালপাড়ার বাসনকোসন সারাদেশে
** সপ্তদশ শতকের বিস্ময় ‘অযোধ্যা মঠ’
** ‘এখানে বড়-ছোট নাই, যাই করেন দশ টাকা’!
** বিমানবন্দর রেলস্টেশনে অকেজো মাইক!