এ গল্প সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার পানিয়া গ্রামের মোস্তফা নূরুজ্জামানের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা করে ফিরে যান গ্রামে।
বাংলানিউজ কার্যালয়ে কথা হয় সুশীলনের নির্বাহী প্রধান নূরুজ্জামানের সঙ্গে। গল্প শোনান এনজিওতে আসা, সুন্দরবন, সুন্দরবনের লোকজসাহিত্য, গ্রামীণ জীবনের পরিবর্তনসহ নানা বিষয়ে। এতেই উঠে আসে বাংলাদেশের পর্যটনের সম্ভাবনা, উন্নয়ন ও সুন্দরবন নিয়ে পর্যটন শিল্পের সম্ভবনাও।
বহু বছর ধরে সাতক্ষীরা সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটন সরকারের নথি আর ‘হচ্ছে-হবে’র দোলাচলে। এসব ভেবে দেশের পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিতে পদক্ষেপ নেন নূরুজ্জামান। তার ভাবনার ফসল সুন্দরবনের কোলঘেঁষে মুন্সিগঞ্জের ব্যাঘ্রতটে সুশীলনের টাইগার পয়েন্ট গেস্ট হাউজ।
এ গেস্ট হাউজের পেছনেও ছিল তার ভ্রাম্যমাণ এনজিও জীবন। প্রশিকা, ব্র্যাকসহ বিভিন্ন এনজিও ভিজিটের সময় একটি এনজিওর যে সুন্দর রিসোর্ট থাকতে পারে তা মাথায় ঢোকে তার। সে ভাবনা থেকে জাপান অ্যাম্বেসিকে প্রস্তাব এবং সবশেষ ফল টাইগার পয়েন্ট গেস্ট হাউজ। থাকার পাশাপাশি কনফারেন্স রুম, খোলা মঞ্চ, খাওয়া-দাওয়ার সুব্যবস্থাও রয়েছে। ৮০ বিঘা জমির উপর গেস্টহাউজের পাশাপাশি রয়েছে মাছের খামার, সবজি ক্ষেত, পশুপালনের মতো কার্যক্রমও।
আরও পড়ুন: ডিরেক্টরই, তবে ফিল্মের বদলে এনজিওতে
গেস্টহাউজ নির্মাণের আগে মুন্সিগঞ্জের বাঘ-বিধবা অধ্যুষিত গ্রামের পাশে একটি গেস্ট রুম ভাড়া নেন। প্রথম ভাড়া নেওয়া গেস্ট রুম এখনও স্মৃতি হিসেবে রয়েছে। তবে বেড়েছে প্রসার। সুশীলনের গেস্ট হাউজে যারা বেড়াতে ও ট্রেনিং করতে আসেন, তারা সুন্দরবনের আমেজও পান। ছাদে দাঁড়ালেই চোখে ভাসে মালঞ্চ নদী, ওপারে সবুজ বন। সুশীলন থেকে অল্প দূরত্বে সুন্দরবনকেন্দ্রিক জনগোষ্ঠীর বসবাস। মৌয়াল, বাউয়াল, জেলে, বাঘবিধবাদের দেখা মেলে সেখানে।
সরকার দীর্ঘদিন ধরে কমিউনিটি ভিত্তিক পর্যটনের কথা বললেও বাস্তবায়নে রয়ে গেছে বিস্তর ঘাটতি। কমিউনিটি ভিত্তিক পর্যটন শিল্পের জন্য সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে বলে মনে করেন নূরুজ্জামান।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সরকার কমিউনিটি পর্যটনকে লালন করছে জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশেও পর্যটনকে শিল্প হিসেবে গড়ে তুলতে কমিউনিটি পর্যটন নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। পর্যটনের জন্য যারা পাগল এমন লোকজনকে খুঁজে বের করে তাদের কাজে লাগানো উচিৎ। পর্যটনের উন্নয়নে সরকারকে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আসলে পর্যটনের ক্ষেত্রে সরকার নিজের হয়ে উঠলে সমস্যা। সরকার নিজের না হয়ে সবার হতে হবে। তাহলেই কাজ করা সম্ভব।
নূরুজ্জামান মনেপ্রাণে ধারণ করেন বাংলার লোকজ ঐতিহ্য। তাই তো রিসোর্টের বিভিন্ন রুমের নাম দিয়েছেন সুন্দরবনের গাছপালা, মাছ আর লোকজ ঐতিহ্য, ইতিহাস থেকে। যেমন, গাজী কালু, চম্পবতী, বনবিবি, গরান, সুন্দরী, কেওড়া প্রভৃতি। তিনি অভিযোগ করে বললেন, এ অঞ্চলের একসময়ের প্রভাবশালী শাসক রাজা প্রতাপাদিত্যের স্মৃতি সম্বলিত নির্দশনগুলো সংস্কার না করে জাদুঘরে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সংরক্ষণ না করলে ৫ বছর পর প্রতাপাদিত্যের কোনো স্মৃতি সাতক্ষীরায় আর পাওয়া যাবে না। যেমন ইতোমধ্যে এভাবে নাম লেখা শুরু হয়েগে গেছে।
সুন্দরবনে পর্যটকের সংখ্যা নেহাতই কম জানিয়ে নূরুজ্জামান বলেন, সুন্দরবনে যারা বেড়াতে আসেন তাদের বেশিরভাগই পিকনিক পার্টি ও এনজিওর লোক। তারাই সুশীলনের রেস্ট হাউজে থাকেন। কিন্তু পর্যটক বাড়লে আরও রেস্টহাউজ গড়ে উঠতে পারে। আমাদের তখন কাউকে লোকসান দিতে হবে না।
পর্যটকবান্ধব পরিবেশের অভাবই সুন্দরবনে পর্যটক কম হওয়ার কারণ বলে তিনি মনে করেন। পর্যটককে যদি বাঁধাধরা নিয়মের মধ্যেই থাকতে হয়, তাহলে পর্যটনের বিকাশ কখনই হবে না। তাকে দেখার, ঘোরার স্বাধীনতা দিতে হবে, বিনোদনের ব্যস্থা করতে হবে, বাঘ দেখতে চাইলে কীভাবে বাঘ দেখানো যাবে সেভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। তবেই পর্যটক আসবে।
আরও পড়ুন: সুন্দরের শীলন- সুশীলন
অনেকটা একক আন্দোলনে সাতক্ষীরার এই অঞ্চলের পর্যটনকে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন তিনি। তবে সীমাবদ্ধতার কথাও জানাতে ভুললেন না। সুশীলনের ট্যুরিজমকে তুলে ধরার কোনো ক্ষমতা নেই। এখানে সরকারের সাহায্য দরকার। একেক মানুষ একেক প্রত্যাশা নিয়ে সুন্দরবনে আসেন। তাদের সে প্রত্যাশা পূরণের দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। সরকার ট্যুরিজমকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবে, সরকারের স্বপ্নে আমরাও স্বপ্ন দেখবো।
নূরুজ্জামান এখনও পাড়ি দিতে চান বহুপথ। স্বপ্ন দেখেন মুন্সিগঞ্জে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল সার্ভিস গড়ে তোলার।
তার আরও একটি ইচ্ছা ওয়াটার মিউজিয়াম করা। লবণাক্ত অঞ্চল হওয়ায় এখানকার মানুষের পানির ভীষণ কষ্ট। ওয়াটার মিউজিয়ামের মাধ্যমে মানুষের পানির কষ্ট দূর করতে চান তিনি।
সক ‘সু’-কে তিনি ধারণ করতে চান। তাই সুশীলন নামের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির খুলনা অফিসের প্রতিটি রুম ও সেকশনের নাম রেখেছেন ‘সু’ দিয়ে। যেমন, প্রধান নির্বাহীর রুমের সামনের খোলা জায়গাটির নাম সুবর্ণরেখা। আবার রান্না-খাবার ঘরের নাম সুখবর। প্রধান নির্বাহীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখতে হয় এমন কর্মকর্তারা যে রুমে বসেন তার নাম সুসম্পর্ক।
আরও পড়ুন: সুশীলনের ব্যাঘ্রতট থেকে সুন্দরবনের হাতছানি
এমন সুন্দর ভাবনার পাশাপাশি কবিতা আবৃত্তিতে দারুণ দখল তার। শত শত লাইনের কবিতা তার মুখস্ত। ২২ মিনিটে রবীন্দ্রনাথের শিশুতীর্থ আবৃত্তি করে ফেলেন, যার মধ্যে সম্মিলন ঘটেছে বেটোফেন, লালনের সুর, কখনও পুথি, কখনও গজল।
সবকিছুর পরও ইচ্ছাপূরণে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে তার। তবে ‘যতক্ষণ জীবন ততক্ষণ লড়াই’ কথাটি স্মরণ করিয়ে দিলেন স্বপ্নবাজ এ মানুষটি।
বাংলাদেশ সময়: ১৫১৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১৭
এমসি/আরআর/এএ