দিগন্তে বরফের মুকুট পরা দানবদের নিচে ঢেউ খেলালো সবুজ পাহাড় সারি আহ্বান জানাচ্ছে অসীমের। চারপাশে কখনও হাজির হচ্ছে বাহারি রডোডেনড্রন।
এ সময়টা রডোডেনড্রন ফুলের। এপ্রিল-মে মৌসুমে কখনও প্রকৃতি আপনার সঙ্গে হেঁয়ালি করতে পারে, ঢেকে দিতে পারে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে। কিন্তু এই বাহারি ফুল আপনাকে ভুলিয়ে দেবে সব কষ্ট। নানা ধরনের পাখিও চোখে পড়ছে আজ। পক্ষী, প্রাণী বৈচিত্র্যে সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্কের জুড়ি মেলা ভার। হিমালয়ান স্নো লাইনের একেবারে নিচে বলে এ অঞ্চলের প্রাণীকূলের মধ্যে রয়েছে নানা বৈচিত্র্য। আছে রেড পান্ডা, ক্লাউডেড লেপার্ডের মতো মহামূল্যবান প্রাণী, আছে হিমালয়ান কালো ভাল্লুক, বেশ কয়েক জাতের হরিণ, চিতাবাঘ সহ নানা স্তন্যপায়ী এবং পাখির আবাস।
বইয়ের পাতায় সৌন্দর্যের তুলনা করতে গিয়ে সব সময় সুইজারল্যাল্ডের ভূ-প্রকৃতির বর্ণনা পড়েছি। সুইজারল্যান্ড যাইনি তাই বলতে পারবো না। কিন্তু সিঙ্গালিলার যে রূপ চোখের সামনে দেখছি তাতে অন্য কিছুকে বেশি সুন্দর কীভাবে বলি। বড় গাছপালা একটু একটু করে কমে আসছে। তার বদলে ঘন সবুজ ঘাসের গালিচা। তার লোভে ভিড় করেছে ইয়াকের দল। তাই বলে মহা আরামসে যে পথ পাড়ি দিচ্ছি তা কিন্তু না। চড়াই বাইতে হচ্ছে প্রচুর। সান্দাকফু থেকে ফালুটের দূরত্ব ২১ কিলোমিটার। এর অনেকটা পথই কষ্টকর। কিন্তু যদি তা উপক্ষা করে একবার পথে নামতে পারেন নিশ্চিত স্বর্গ হাতে পাবেন। পথে এসএসবি ক্যাম্পে পাসপোর্ট এন্ট্রি করতে হলো। মাঝে একবার জিরিয়ে নিয়ে এক বিশাল চড়াইয়ের পর পৌঁছালাম সাবারকুম। এটি মূলত বন বিভাগের একটি বাংলো। তবে এর কর্মচারীরা ট্রেকারদের সুবিধার্থে খাবারের ব্যবস্থা করেন বলে এখানে সবাই এসে বিশ্রাম নিয়ে নেন।
সাবারকুম থেকে ফালুটের দূরত্ব ৪ কিলোমিটার। আজ প্রায় অর্ধেক পথ জুড়ে ছিলো কাঞ্চনজঙ্ঘা। কিছুক্ষণ আগে মেঘের আ[ড়ালে হারিয়ে গেলো সে। স্থানীয়রা বললো বাকি ছয় কিলোর মধ্যে চার কিলো নামতে হবে বাকি ২ কিলো চড়াই। স্যুপ নুডলস গিলে আবার পথে নামলাম। এবার লক্ষ্য খুবই সরল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফালুট পৌঁছানো। সামান্য একটু উঠতেই বহুদূরে ফালুটের ঘরগুলি নজরে এলো। এখন শুধু নামছি। একেবারে একা আমি। মধ্যদুপুরে পাহাড়ি এই রিজ লাইনে হু হু করে বাতাস বইছে। একটা জনমানবও চোখে পড়ছে না কাছে পিঠে। ক্ষানিক ভয় করতে লাগলো, ভূতের ভয়। মনে হলো কেউ যেন পেছনে অনুসরণ করছে। সামনে ফালুটের ঘরগুলো দেখা যাচ্ছে তাতে রক্ষা, অন্তত মানুষের অস্তিত্ব তো চোখে পড়ছে। কোনো দিকে না তাকিয়ে জোরছে হাঁটা দিলাম। অবশ্য বললেই কি জোরে হাঁটা যায়। একে তো ভয়াবহ বাতাস তার উপর এখন প্রায় পঁয়ত্রিশশো মিটারের কাছাকাছি। বেশি জোরে হাঁটলে হাফ ধরে যাচ্ছে। তার উপর অনেক জায়গায়ই চড়াই আছে।
তবে পাহাড়ি রাস্তায় একমনে হেঁটে গেলে অনেক সময় দূরত্ব কমে যায়। আমিও তার ফল পেলাম। চলে এলাম ফালুটের আগে শেষ চড়াইয়ের গোঁড়ায়। এখান থেকে ফালুটের লজ প্রায় দেড় কিলোমিটার। এই উচ্চতায় ২১ কিলোমিটার হাঁটা ডাল-ভাত নয়। মাংসপেশীগুলো জানাচ্ছে অতি সত্বর তাদের বিশ্রাম প্রয়োজন। আমাদের অনেক আগে সান্দাকফু থেকে রওয়ানা দিয়েছিলো এমন কয়েকজনকে দেখলাম সামনেই। জেদ চেপে গেলো। তাদের পেছনে ফেলতেই হবে। কোথাও না থেমে আস্তে আস্তে চড়াই ভেঙে যখন ফালুটের ট্রেকার হাটের সামনে নিজেকে আবিষ্কার করলাম তখন ঘড়ির কাঁটায় বিকেল প্রায় চারটা বাজে। রোদ এখনও ঝিকিমিকি করছে। আমাদের জায়গা হলো মূল ট্রেকার হাটের একটু নিচে নতুন লজে। এখানে বলে রাখি ফালুটে কিন্তু খুব বেশি মানুষের থাকার ব্যবস্থা নেই। ফলে সেখানে যাওয়ার আগে গাইড মারফত বা নিজেরাই বুকিং দিয়ে যেতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১০২৮ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০১৭
এএ
**পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ শৃঙ্গের চূড়ায়
**পাহাড়ি নেপালি গ্রাম কালাপোকরিতে
** ১০ হাজার ফুট উচ্চতায় খিচুড়ি-ডিমে ভোজ
** যে শহর অর্ধেক নেপাল, অর্ধেক ভারতের
** পিচঢালা রাস্তার ওপারেই নেপাল
** ভালোয় ভালোয় পার বাংলাবান্ধা সীমান্ত