যথাসময়ে ক্রিস ফেয়ারভিউ হোটেলে হাজির। হোটেল কর্তৃপক্ষের কাছে সে বড় প্লাস্টিকের ব্যাগ চাইলে তারা জানালো প্লাস্টিক ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়ায় তাদের কাছে এ ধরনের ব্যাগ নেই।
সাজানো-গোছানো নাইরোবি ছেড়ে একটু বের হতেই শহরতলী। এলোমেলো গড়ে ওঠা পুরনো বহুতল ভবনে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত মানুষের গাদাগাদি বাস। টাউন হল বাজারের মতো ছোট ছোট বাজারে মানুষ গিজগিজ করছে। চারদিকে দারিদ্র্যের ছাপ। নাইরোবি বাদে পুরো কেনিয়াই অনগ্রসর ও দরিদ্র। দূরপাল্লার রাস্তায় যানবাহন খুবই কম। মাঝে মাঝে ঢাকার লোকাল বাসের মতো বাস চলছে। দূরে যাওয়ার মূল বাহন যাত্রীতে ঠাসা লক্কড়ঝক্কড় মাইক্রোবাস।
তবে রাস্তা চওড়া ও মসৃণ। দু’পাশে মাইলের পর মাইল এলাকা খালি পড়ে আছে। এখানকার মাটি লাল, যথেষ্ট উর্বর, কিন্তু পানির অভাবে ৫ লাখ বর্গ কিলোমিটারের বেশি আয়তনের কেনিয়ার অধিকাংশ এলাকা এরকমই পড়ে থাকে। পুরো রাস্তায় একটুকরো জলাশয়ও চোখে পড়েনি। মাঝে মাঝে রাস্তার দু’ধারে পানিহীন নদী বালি আর পাথরে ধু ধু করছে।
সন্ধ্যার দিকে মসৃণ মহাসড়ক ছেড়ে প্রবল ঝাঁকুনি খেতে খেতে আর ধূলার আস্তরে ঢেকে থাকা ক্যাকটাস আর রোদে জ্বলে যাওয়া গাছের কঙ্কাল দেখতে দেখতে আমরা শুষ্ক অঞ্চলে প্রবেশ করলাম। ছড়ানো ছিটানো কয়েকটা সিমেন্টের বাড়ি, ছোট্ট বাজার, গভীর অন্ধকার আর নিঃশব্দতা- এই নিয়ে কিউসো শহরতলী। ইলেক্ট্রিসিটি আছে, তবে আমরা যে কোম্পানির মোবাইল সিম কিনেছি সেগুলো একদিনও কাজ করেনি।
আমার আর নাজিয়ার থাকার জায়গা হলো ভিসা গেস্ট হাউজে। একতলা ছোট্ট পাকা দালানের এই লজ বাংলাদেশে মফস্বলে ভালো এনজিওগুলো কর্মীদের জন্য যে থাকার ব্যবস্থা রাখে অনেকটা সেরকম। সবচেয়ে বড় কথা কলে পানি আছে, আমার পূববর্তী দলের সহকর্মীদের মূল কিটুই শহরে ভালো হোটেলে দাঁত মাজার পানি না পাওয়ারও অভিজ্ঞতা আছে!
কিউসোতে আমরা তিন রাত ছিলাম। এখানকার খাবার বিষয়ে না বললেই নয়। প্রথম রাতে আমাদের একটি বারসহ লজে নিয়ে যাওয়া হলো। ছায়াপথ স্পষ্ট ফুটে থাকা আকাশের নিচে লাল-নীল বাতি জ্বালানো, বিকট শব্দে গান বাজতে থাকা বারটিকে ভীষণ বেমানান মনে হচ্ছিল। ভিতরে পা দিতেই প্রথমে রান্নাঘর, সেখানে গরুর মস্ত বড় রান ঝুলিয়ে রাখা। কাঁচা মাংসের প্রচণ্ড গন্ধে গা গুলিয়ে উঠলো। যে লোকটা অর্ডার নিতে এলো তার গা থেকেও মাংসের গন্ধ বের হচ্ছে।
সে একাই মাংস কুটে, রান্না করে এবং খাবার পরিবেশন করে! কোনোমতে বমি চাপলাম। গরু ও মুরগি এখানকার মানুষের প্রধান খাবার। মসলাবিহীন রন্ধনকৃত মাংস গন্ধময়, অর্ধসিদ্ধ এবং শক্ত। মাংসের সঙ্গে তারা কেনিয়ার ঐতিহ্যবাহী উগালি (ভুট্টা দিয়ে তৈরি স্বাদহীন ভর্তা জাতীয় খাবার) খায়। এছাড়াও খাদ্য তালিকায় আছে ভাত, বিচি জাতীয় খাবার ও পালং শাক।
খাবার যে কত বৈচিত্র্যহীন হতে পারে, তা কিউসো না গেলে জানা হতো না। মনে পড়ে গেলো ক্রিসের সঙ্গে খাদ্যবিষয়ক কথোপকথন, সে বলছিল ‘আমরা প্রতিবেলা একই খাবার খাই। ’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘বিয়ে বা অন্য উৎসবে কী কর?’ ‘তখনও একই খাবারই রান্না হয়, তবে একটু বেশি পরিমাণে’।
ভাগ্য ভালো যে এখানে পরোটা খুব জনপ্রিয় আর কলা পাওয়া যায়। পূর্ববতী দলের সহকর্মীদের খাদ্য বিষয়ক অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে গিয়েছিলাম ইন্সট্যান্ট নুডলস, বিস্কুট, চিপস, কেক ইত্যাদি। অধিকাংশ দুপুর কলা, পরোটা আর শুকনো খাবার দিয়েই চালিয়ে নিলাম। চা ও কফি- দু’টোর জন্যই কেনিয়া বিখ্যাত। সকালবেলা ওরা এক মগ কফি আর ঐতিহ্যবাহী মান্দাজি (ময়দা দিয়ে তৈরি একধরনের পিঠা) খায়। এই একটি খাবারই কিউসোতে মজা করে খেয়েছি। তবে প্রতি রাতেই কেয়ার ইন্টারন্যাশনালের আতিথেয়তা রক্ষা করতে স্থানীয় রেস্তোরাঁর খাবার গলদ্ধকরণ করতে হয়েছে!
এবারের যাত্রায় কিউসো ও আশপাশের এলাকার বৈরী প্রকৃতি এবং মানুষের জীবনসংগ্রাম খুব কাছ থেকে দেখেছি। সেই গল্প রেখে দিলাম পরের পর্বের জন্য ।
***এক টুকরো আফ্রিকা (পর্ব-১)
উপমা মাহবুব
উন্নয়ন কর্মজীবী
বাংরাদেশ সময়: ১৬০৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৭
এএ