অন্যদিকে আমাদের দেশে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। তারপরও আমাদের বুড়িগঙ্গার দিকে তাকালে বুকের মধ্যে হু হু করে ওঠে।
ঢাকা যখন তার প্রাণভোমরা বুড়িগঙ্গাকে গলাটিপে হত্যা করছে সাংহাই কিন্তু ঠিক উল্টো। চীনের বাণিজ্যিক রাজধানীখ্যাত সাংহাই শহরকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেওয়া এই নদীকে কনে সাজানোর মতো সাজিয়ে তুলেছে। তাইতো বছরে ৬৭ লাখ পর্যটক ছুটে আসে সেই কনেকে দেখার জন্য। দুই পাড় শান দিয়ে বাঁধানো। সেখানে রয়েছে বিনোদনের নানান আয়োজন।
আকার আকৃতিতে ঠিক বুড়িগঙ্গার মতোই হবে। বুড়িগঙ্গা যেমন অন্য নদীর সওয়ার হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে, হোয়াংপু কিন্তু একইভাবে ইয়াংজি নদীর ঘাড়ে সওয়ার হয়ে পূর্ব চীন সাগরে গিয়ে পতিত হয়েছে। ১১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদীটি প্রস্থে বুড়িগঙ্গার সমান প্রায়। গভীরতার দিক থেকে বুড়িগঙ্গাই এগিয়ে রয়েছে। হোয়াংপুর গড় গভীরতা মাত্র ৯ মিটার।
আকার-আকৃতিতে এক হলেও যোজন যোজন ফারাক দু’টি নদীর মধ্যে। হোয়াংপু সাংহাইয়ের পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ। সাংহাই যাবেন কিন্তু রিভারক্রুজে যাবেন না এমনটা হওয়ার সুযোগ নেই। আর সব বাদ গেলেও নৌ বিহার নাকি থাকতেই হবে- জানালেন ট্যুরিস্ট গাইড ন্যান্সি।
আর বুড়িগঙ্গায় ভুলেও কেউ ঘুরতে যায় বলে মনে হয় না। ঘুরতে যাবে কীভাবে! নদীর তীরে মানুষ যায় বুক ভরে শ্বাস নিতে। কিন্তু বুড়িগঙ্গার তীরে গন্ধে টেকা যায় না, নাক চেপে পার হতে হয়। বাধ্য হয়ে সদরঘাটে নৌ-বিহার শুরু করলেও কতক্ষণে বুড়িগঙ্গা পার হবেন সে জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকেন ভ্রমণকারীরা।
হোয়াংপুর দিনের দৃশ্য এক রকম, রাত আরও মোহনীয়। রাতে দু’পাড়ের সুরম্য অট্টালিকার আলোক ঝলকানিতে অন্যরকম দৃশ্যপটের অবতারণা হয়। কাচের দেয়ালগুলো ভরে ওঠে বর্ণিল বিজ্ঞাপনী সাজে। অনেক রাত পর্যন্ত চলে সেই আলোক ঝলকানি উপভোগ, আর প্রমোদতরীগুলোর আনাগোনা।
এখানে ভবনগুলো যেনো আকাশ ছোঁয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। বেশির ভাগ সময় ভবনগুলোর মাথা থাকে মেঘে ঢাকা। উপরে ওঠার প্রতিযোগিতার সঙ্গে নান্দনিকতায় কেউ কারো চেয়ে কম যান না, একটির চেয়ে আরেকটি সুন্দর। বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভবন সাংহাই টাওয়ারও (১২০ তলা) এর পাশেই বলা চলে।
এই নদীর পাড়েই রয়েছে অনেক ভারি শিল্প। তারও কিন্তু হোয়াংপুকে গলাটিপে ধরেনি। তারাও আলতা-মেহেদি দিয়ে রাঙিয়ে তুলেছে। পানি দেখলে একবার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করবে।
শুধু কি হোয়াংপু! আমরা যখন বেইজিংয়ে অবস্থিত বিশ্বখ্যাত অলিম্পিক স্টেডিয়াম বার্ড নেস্ট পরিদর্শন করি ঠিক তখনই দমকা হাওয়া শুরু হয়। মনে হচ্ছিল এই বুঝি উড়িয়ে নিয়ে যাবে। ঢাকায় বৃষ্টির আগে এমন বাতাস শুরু হলে নানা রকম ময়লা-আবর্জনার সঙ্গে পলিথিনের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু অবাক হতে হলো, দু-চারটি সেঞ্চুরি গাছের ঝরাপাতা ছাড়া কিছুই পরিলক্ষিত হলো না।
অথচ বেইজিংয়ের পথে পথে অনেককে দেখেছি পলিথিনের ব্যাগে শপিং করে বাসায় ফিরছেন। অর্থাৎ, আমরা যেখানে সেখানে পলিথিনের ব্যাগ ফেললেও তারা কিন্তু ঠিকই নির্দিষ্ট স্থানে ফেলছে। যে কারণে তাদের হোয়াংপু যেমন সুন্দর রয়েছে তেমনি বেইজিং থেকে সাংহাই, গুয়াংজু সবগুলো শহরেই অনেক পরিপাটি ও গোছানো।
এর আগে বাংলানিউজের কল্যাণে মস্কো শহরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত মস্কোভা নদীতে ঘোরার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেই নদীটিও বুড়িগঙ্গার মতোই। ক্রেমলিনের কোলঘেঁষা এই নদীকে তারাও পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণে পরিণত করেছে। অথচ সৃষ্টির আর্শিবাদ বুড়িগঙ্গাকে আমরা কেউ গলা চেপে, কেউ আবার বুক চেপে, কেউ পায়ে রশি বেঁধে রেখেছি, আবার কেউ অনবরত বিষ ঢালছি তার মুখে।
অনেক স্বপ্ন, অনেক পরিকল্পনার কথা শুনি। আশায় বুক বাঁধি, আশা নিয়েই বাঁচি, একদিন হোয়াংপু ও মস্কোভা নদীর মতো আমাদের প্রিয় বুড়িগঙ্গাও হয়ে উঠবে যুবতী চঞ্চলা। সেদিন ইবনে বতুতার উত্তরসূরিরা ছুটে আসবে বাংলাদেশে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৫ ঘণ্টা, জুলাই ২০, ২০১৮
এসআই/এএ