নৌকায় দু’তিন মিনিটের ব্যাপার। পারে আরো খানিকটা উঠলে বিখ্যাত বারিক্কাটিলা।
মোটরসাইকেলের আরোহী হয়ে চললাম সে পথে। শিমুল বাগান যেতে হলে দু’টি উপায়ই আছে। হেঁটে না হয় মোটরসাইকেলে। ওপার থেকেই আমরা দুটো মোটরসাইকেল নিয়ে নিয়েছি। মোটরসাইকেলের চালক ছাড়াও আরো দুই আরোহী যেতে পারে। তবে এই রাস্তার কথা বিবেচনা করলে একজন আরোহী যাওয়াই নিরাপদ।
এখানে রাস্তার কোনো শ্রী নেই। কখনো এবড়ো থেবড়ো, কখনো ভাঙা, কখনো পুরো বালির উপর দিয়ে যেতে হয়। তাই সাবধান থাকতে হবে প্রতি মুহূর্তে। মিনিট দশেকের ভেতর আবার চোখে পড়লো শিমুল বাগানের রঙের ছটা। আমরা প্রায় চলে এসেছি। তাহিরপুর উপজেলার উত্তর বাদাঘাট ইউনিয়নের মানিগাঁও গ্রামে এই শিমুলবাগান। বাদাঘাট ইউনিয়নেরই সাবেক চেয়ারম্যান জয়নুল আবেদীন প্রায় একশো বিঘা জমিতে তিন হাজার শিমুল গাছ রোপণ করেছিলেন। কালের পরিক্রমায় এটিই এখন দেশের সবচেয়ে বড় শিমুল বাগান।
ঢোকার মুখে রীতিমতো বাঁশ দিয়ে ঘিরে শুরু হয়েছে দোকানসহ নানা ব্যবসা। মোটরসাইকেল রাখতে হলে দিতে হবে দশ টাকা করে। শোনা গেলো বাগানে ঢোকার জন্য নাকি কয়েকদিন পর থেকে টিকিট ব্যবস্থা চালু করা হবে। দোকান থেকে এক ফালি তরমুজ মুখে দিতেই এতক্ষণের সব ক্লান্তি উধাও। হলফ করে বলছি এতো মিষ্টি তরমুজ অনেক কাল খাইনি। আসার পথে প্রচুর তরমুজের বাগান চোখে পড়েছে। বালি মাটি হওয়ার কারণে এ অঞ্চলে প্রচুর তরমুজ জন্মে। স্বাদ ও মানে এসব তরমুজ অনন্য। সেই স্বাদ মুখে দিয়ে চোখ আর মনের তৃষ্ণা মেটাতে আমরা ঢুকে গেলাম শিমুল বাগানে। আহা কি তার রূপ। যতদূর চোখে যায় রক্তরঙা শিমুল ফুলের মেলা। একেবারে লাইন করে গাছেরা পিটির মতো করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। মাঝখান দিয়ে ‘আহা আজই এ বসন্তে’ গানটি গেয়ে কোনো হলুদ পেড়ে শাড়ি পরা চপলা কিশোরীর অপেক্ষায় যেন তারা। একবার কল্পনা করুন আকাশ ছোঁয়া সবুজ পাহাড়ের পটভূমিতে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে গাছে গাছে এমন রঙের মেলা। বসন্ত যখন দ্বারে এসে দাঁড়ায় সে তো শুধু রঙই নিয়ে আসে না, গোটা প্রকৃতির ভোল বদলের একটি প্যাকেজ নিয়ে আসে।
এখানে এই শিমুল বাগানে শেষ মাঘের বেলায় দাঁড়িয়ে মনে হলো সত্যিই বসন্ত দেব তার ভাড়ার উজাড় করে আমাদের দ্বারে দাঁড়িয়ে আছেন। পাখিরা এসে ভিড় করেছে। শালিকের আধিক্য বেশি। সবচেয়ে ভালো লাগতো টিয়াদের দেখলে। তাদের আর দেখা গেলো না। তবে মনুষ্য টিয়া ময়নার রঙে সোভিত যুগলদের দেখা মিললো। এ যেন কুঞ্জবন। হরেক মানুষের মেলা বসেছে। শুধু একটু রং কত দূর-দূরান্ত থেকে কত মানুষকে টেনে নিয়ে এসেছে।
কোট-টাই পরা গম্ভীর মানুষদের দেখলাম নিচে পরে থাকা ফুল দিয়ে হৃদয় আকৃতির মালা বানিয়ে তার মাঝে বসে ছবি তুলছে। আমাদের বর্ণহীন জীবনে রঙেরই বোধহয় প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি এখন। হৃদয়ের শীতল মনোভূমিতে ভালোবাসার উষ্ণতা ঢেলে দিতে পারে এই রং। শিমুল বাগানে না এলে এমন অনুভূতি হতো না। জাকির ভাইয়ের সৌজন্যে বাগানের এক কোণে মালিকপক্ষের নির্মিত ঘর খুলে দেওয়া হলো।
এখান বসলে জাদুকাটার আবারিত বাতাস প্রাণ জুড়িয়ে দেবে। কিছুদূর গেলেই নদী। শিমুল গাছের নিচে বেঞ্চে বসে জাদুকাটা আর মেঘালয়ের পাহাড় দেখার শান্তি আস্বাদন করতে হলেও অন্তত একবার এখানে আসা উচিত। গ্যারান্টি দিচ্ছি আসার পথ কষ্ট এবং অর্থ দুই-ই উসুল হবে। কিছুক্ষণ নীরবে বসে রইলাম। সারাদিন বসে থেকে দিনটি কাবার করতে মন চাইছিলো। কিন্তু উঠতে হলো শেষ পর্যন্ত লোভে পড়ে। আরো দুটো জায়গায় যেতে হবে যে। আমরা একটু ঘুরপথে নেমে গেলাম। পেছন পানে আমি আর ইচ্ছে করেই তাকাইনি। যে রং একবার মানস পটে আকাঁ হয়ে গেছে তার আর ভিন্ন ছবি আঁকা হোক তা চাই না। যেভাবে যাবেন: শিমুল বাগানের ফুল দেখতে হলে নির্দিষ্ট সময়র ভেতরেই যেতে হবে। সবচেয়ে ভালো সময় পহেলা ফাল্গুনের মধ্যেই চলে যাওয়া। ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জের পথে চলে শ্যামলী, হানিফ, এনা পরিবহন। ভাড়া ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকার মধ্যে। সুনামগঞ্জ শহর থেকে বেশ কয়েকভাবে যেতে পারেন শিমুল বাগান। সুরমা ব্রিজের কাছ থেকে ভাড়ায় মোটরসাইকেল এবং সিএনজি দুটোই পাবেন। মোটরসাইকেল ছয়শো থেকে আটশো টাকা। সিএনজি সারাদিনের জন্য জাদুকাটা নদীর ঘাট পর্যন্ত ১২শ থেকে ১৫শ টাকা। এক সিএনজিতে পাঁচজন যেতে পারবেন। তবে সেক্ষেত্রে নদীর ঘাট থেকে জনপ্রতি ১০০ টাকা করে বাগান পর্যন্ত মোটরসাইকেলে যেতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৯
এএ