শেষে হাবীবের গুগলম্যাপ এ যাত্রা বাঁচালো। হাদি ফকিরহাট বাজারের কুকুরেরাও বোধহয় পাহারার কাজ বাদ দিয়ে রেস্তোরাঁর বাইরের বন্ধ চুলোর কাছে ওম খুঁজছে।
আমাদের এবারের গন্তব্য সীতাকুণ্ড মিরসরাই এলাকার সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ট্রেইল সোনাইছড়ি। যেটি মিরসরাই উপজেলার হাদি ফকিরহাট এলাকার ওয়াহিদপুর থেকে শুরু হয়ে শেষ হয়েছে ফটিকছড়ির ত্রিপুরাপাড়ায়। প্রায় বারো কিলোমিটার দীর্ঘ এক ট্রেইল। মূলত জনমানবহীন বিশাল সব বোল্ডার, আঁধার ঘেরা বাদুইজ্জা কুম এর প্রথম চার কিলোমিটারের আকর্ষণ। এরপর কিছুদূর পাহাড়িপথের পর আবারও একটানা ঝিরি ধরে চলা। দীর্ঘ এ ঝিরিপথ বৃক্ষরাজির আধিক্যে ভরদুপুরেও সূর্যের আলো পৌঁছায় খুব ক্ষীণ। এ কারণেই সোনাইছড়ির আকর্ষণ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।
ইতোমধ্যেই আমরা আবার পেছনে হেঁটে এসে হাদি ফকিরহাট বাজারে খাওয়ার হোটেল খোলা পেয়ে গেলাম। এত সকালেও হোটেলে বেশ ভিড়। নামাজ সেরেই মুসল্লিরা খেতে চলে এসেছেন। এত সকালে আমার আবার খাবার মুখে রোচে না। তারপরও জোর করে খেলাম। আজ অনেকখানি পথ পাড়ি দিতে হবে। চকৎকার স্বাদের হালুয়া ছিল বলে রক্ষা। খাওয়া শেষে আমরা রেললাইন পার হয়ে চলে এলাম। সেখানেই দেখা স্থানীয় গাইড ফরিদ ভাইয়ের সঙ্গে।
তিনি এর আগেও কয়েকটি দলকে নিয়ে গিয়েছেন। হাবীব আগেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করে রেখেছিলো। এই ঠাণ্ডায়ও তার খালি পা। জানালো এটা কোনো বিষয়ই না। এভাবেই তিনি আমাদের সঙ্গে ফটিকছড়ি যাবেন আবার আজই ফিরে আসবেন। প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা এসব মানুষ আমাকে বরাবর অবাক করে।
গ্রাম্য বসতি ছাড়িয়ে আমরা একটি ঝিরি অনুসরণ করে আস্তে আস্তে নির্জনতায় ঢুকে যেতে লাগলাম। তখনও সূর্যের আলো ভালোভাবে পড়েনি। যে কোনো ট্রেকের শুরুতে আমার মধ্যে একটু আড়ষ্টতা কাজ করে। তার ওপর শীতটা এখনও ভালোই করছে। আরিফ ভাইয়ের ছবি তোলার হাঙ্গামায় তা আস্তে আস্তে কাটলো। এরই মধ্যে আমরা চলে এসেছি বড় পাথুরে বোল্ডার দঙ্গলের একেবারে গোঁড়ায়। ফরিদ ভাই জানালেন এখান থেকেই মূল ট্রেইল শুরু। সত্যি বলতে এ ধরনের অসংখ্য বোল্ডার ভরা ঝিরি বান্দরবানে পেরোনোর পরিপ্রেক্ষিতে অবাক হলাম না ঠিক, তবে সচকিত করলো। কারণ সীতাকুণ্ড মিরসরাইয়ের পাহাড়ি অঞ্চলে এর আগে এমন বোল্ডার ভরা ঝিরি পাইনি। এসব বোল্ডারের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে আমরা এসে একটু চড়াই ভেঙে একটি খাদের ধারে এসে উপস্থিত হলাম। ভেতরটা দেখা যাচ্ছে না। পুরো অন্ধকার। সেখান থেকে কিচির মিচির ধরনের শব্দ ভেসে আসছে। এটাই সেই বাদুজ্জা কুম। ভেতরে নাকি শত শত বাদুড়ের বাস। আমরা এর উপর দিয়ে উঠে এসেছি। নিচ দিয়ে গেলে কুমের ভেতরে ঢুকে যেতে পারতাম।
কিন্তু এর ভেতরে নাকি বাদুড়ের বিষ্ঠার বোটকা গন্ধ। ফরিদ ভাই ঢিল মেরে বাদুড়কূলকে তাদের গৃহ থেকে বের করে আনার খানিক চেষ্টা চালালেন। আমরাই তাকে নিবৃত্ত করলাম। এরপর আর না দাঁড়িয়ে আবার চলা শুরু। এরপর বেশ কিছু ছোট ছোট বিপজ্জনক পাথুরে অংশ পার হতে হলো। কেউ যদি রক ক্লাইম্বিং করেন সে বিদ্যা ইচ্ছা করলে এখানে কাজে লাগানো যায়। এ জায়গাটিতে আলো-ছায়া দারুণ খেলা করে। সেটি ব্যবহার করে ক্যামেরার শাটার চললো পুরোদমে। ততক্ষণে ভোরের সূর্য তার কিরণ ছড়াতে শুরু করেছে। অজানা অচেনা পাখির কূজন পুরো ট্রেইলজুড়ে। ট্রেইলের এমন ভোরকে আমার মনে হয়ে পাহাড় অরণ্যের দেবতার পক্ষে থেকে সাক্ষাৎ আশীর্বাদ। এমন আলো আলোয় রাঙা ভোরে হারিয়ে যেতে অন্তত আমার আপত্তি নেই। এর মাঝেই প্রায় শান বাঁধানো সমতল পাথুরে জমি পাওয়া গেলো খানিকটা। এখানে পাহাড়ের আশপাশ ভয়ংকর শুকনো। পড়ে থাকা ঝরা পাতায় গাইড একটু আগুন জ্বালাতেই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। তড়িঘড়ি নিভানো হলো। এক সময় আমরা ঝরনার কাছে চলে এলাম। শীতের এ সময়ে পানির ধারা খুবই ক্ষীণ। বর্ষায় এলে অবশ্য ভিন্নচিত্র দেখা যেতো।
খানিক বিশ্রামের পর আমরা পাহাড়ি চড়াই ধরে উঠতে শুরু করলাম। বেশ খানিকটা উঠে পাহাড়ের শীর্ষে চলে এলাম। গাছে পলাশফুল দেখে আসন্ন বসন্তের আভাস টের পাওয়া গেলো। দূরে বনমোরগের ডাক শোনা যাচ্ছে। বিদায় নিলো বোল্ডারময় ট্রেইল। এখান থেকেই অনেকে ফিরে যান আবার ওয়াহিদপুর। যাদের লক্ষ্য ফটিকছড়ি তাদের জন্য আসল পথচলা শুরু এখান থেকেই। একটানা শুধু নামা আর ওঠা। কখনো পথ গেছে শুকনো ঝিরিখাতের ভেতর দিয়ে, কখনো পথ হিম ঠাণ্ডা গোঁড়ালি সমান পানি পার হয়ে চলা। একসময় বিশাল এক উৎরাই নেমে পাওয়া গেলো ঝিরির পথ। এর সঙ্গে কেন জানি না আন্ধারমানিক শব্দটি খুব যায়। আশপাশে আর কোনো জনমানবের চিহ্ন নেই। নিস্তব্ধতার বাণ ডেকেছে। ফরিদ ভাই জানালো এর নাম হাতি ক্যানেল। কেন এমন কিম্ভুত নাম তার অবশ্য কোনো ব্যাখ্যা নেই।
পানিতে ছপছপ আওয়াজ তুলে চলতে লাগলাম। কিছু জায়গায় দু’পাশের পাথুরে দেওয়াল পথিককে চেপে ধরবার উপক্রম। পিচ্ছিল সব অংশ সাবধানে পার হতে হচ্ছিলো। আছাড় খাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। সঙ্গীরা ভালোভাবেই তা সামাল দিচ্ছে দেখে স্বস্তি হচ্ছিলো। ততক্ষণে আমাদের সাড়ে চার ঘণ্টার উপরে হয়ে গিয়েছে ট্রেইলে। একজন মানুষও চোখে পড়েনি। এতক্ষনে একজনকে দেখা গেলো উল্টো পথে আসতে। জানা গেলো তিনি আসছেন ফটিকছড়ি থেকে। ফটিকছড়ি থেকে মিরসরাইয়ের এ পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসকারী স্থানীয় মানুষেরা এটিকে চলাচলের জন্য ব্যবহার করে।
পথে আরেকজন ত্রিপুরা কিশোরের সঙ্গেও দেখা হলো। সেও চলেছে আমাদের গন্তব্যের পানেই। তার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলাম। প্রাণ, প্রকৃতি আর অফুরন্ত বন্য জীবনের গল্প। এই করতে করতে এক সময় সরু ঝিরি আস্তে প্রশস্ত প্রায় খালের রূপ নিলো। অভিজ্ঞতা থেকে বুঝে নিলাম গন্তব্য আর বেশি দূরে নয়। মনুষ্য উপস্থিতিও বাড়তে লাগলো। ততক্ষণে রোদ বেশ তেঁতে উঠেছে। এক জায়গায় নীলাভ জল দেখে স্নানের বাই উঠলেও অনেক কষ্টে তাকে নিবৃত্ত করলাম। ত্রিপুরা পাড়া সামনেই।
আমাদের পথচলা সাঙ্গ হলো। ঘড়ির কাঁটায় ততক্ষণে দেড়টা। মোবাইলের সফটওয়্যার বলছে আমরা বারো কিলোমিটার হেঁটেছি। সোনাইছড়ি সম্পর্কে প্রচলিত আছে এটি ২৮ কিলোমিটার। আসলে এই ঝিরিটি বড় খালে রূপান্তরিত হয়ে লোকালয়ের মধ্যদিয়ে গিয়ে ফটিকছড়ি বাজারের কাছে নদীতে মিলিত হয়েছে। সম্ভবত সেই হিসাব থেকেই ২৮ কিলোমিটার। এই ট্রেইলের মূল রোমাঞ্চ এই ত্রিপুরা পাড়া পর্যন্তই। শুরু করেছিলাম সকাল ৭টায়। গ্রামটি দেখে এখানে কয়েকটা দিন থেকে যাওয়ার খুব লোভ হয়েছিলো। এমন সরল নিস্তরঙ্গ সেখানকার জীবন। এই সরলতা মাখা জীবন আর ট্রেইলের গহীনতার খোঁজে আবার ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা রইলো, সঙ্গে আমন্ত্রণ যারা পড়ছেন লেখাটি তাদেরও।
মনে রাখবেন: ঢাকার বাসে এসে নেমে পড়ুন মিরসরাইয়ের হাদি ফকিরহাট বাজারে। সেখান থেকে অটো নিয়ে ওয়াহিদপুর রেল লাইন পর্যন্ত। এখানে গাইড পেয়ে যাবেন। দূরত্বভেদে দর নির্ভর করে। তবে ফটিকছড়ির ত্রিপুরা পাড়া পর্যন্ত আসলে গাইড খরচ সাতশো থেকে এক হাজার। আর অবশ্যই শুকনোর সময় আসবেন। বর্ষায় এই ট্রেইল হয়ে উঠে ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ।
বাংলাদেশ সময়: ১০৫৭ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০১৯
এএ