কলকাতা: ‘এবার ঠিক করেছি শীতে শান্তিনিকেতন যাবো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মস্থানটা একবার ঘুরে দেখবোই।
উত্তর কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির কলকাতার যেকোনো প্রান্ত দিয়ে নানা উপায়ে যাওয়া যায়। তবে সবচেয়ে সহজ এবং সস্তার পথ মেট্রোরেল। ধরা যাক, কেউ পার্কস্ট্রিট দিয়ে যাবেন। মেট্রোয় দূরত্ব ১৫ মিনিটের মতো। নামতে হবে গিরিশ পার্ক। টিকিট ১৫ রুপি। স্টেশন থেকে বের হওয়ার পথে একবার চোখ বুলিয়ে নিতে হবে জোড়াসাঁকো কোন দিকে। সেখান থেকে ১০ মিনিট হাঁটা পথে ঠাকুরবাড়ি। অথবা পুলিশ, দোকানদার যে কেউ আপনাকে পথ চিনিয়ে দেবেন।
তবে জোড়াসাঁকোর ঠকুর বাড়ির কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় রবীন্দ্রনাথের পুর্বপুরুষ নীলমণি ঠাকুরের কথা। তিনিই তৎকালীন উত্তর কলকাতার চিৎপুর রোডের পুর্বদিকে মেছোবাজারে একটি বসতবাড়ি নির্মাণ করেন। সেদিনের মেছোবাজার আজ মেছুয়া নামে পরিচিত। এক সময়ের বড় মাছের বাজার আজ কলকাতার সবচেয়ে বড় পাইকারি ফলের বাজার। জোড়াসাঁকোয় ঠাকুরবাড়ি আয়তনে যত বেড়েছে ততই ছোট হয়েছে সেদিনের মেছোবাজার।
নীলমণি ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত বাড়িটিই আজকে গোটা বিশ্বের কাছে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি নামে পরিচিত। নীলমণি ঠাকুরের দ্বিতীয়পুত্র, রামমণি ঠাকুরের দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরের ঠাকুরদা দ্বারকানাথ ঠাকুর। বর্তমানে উত্তর কলকাতার রবীন্দ্রসরণি ও বিবেকানন্দ রোডের দক্ষিণের সংযোগস্থল দ্বারকানাথ ঠাকুর লেন। এই রাস্তায় লালরঙের কয়েকটি সারি সারি বাড়ি রয়েছে। বাইরে থেকে দেখে চট করে ঠাকুরবাড়ি কোনটা তা আলাদা করা যেত না। ফলে বাড়িটিকে আলাদা করে চিহ্ণিত করতে রবীন্দ্রভারতী দুটি তোরণ নির্মাণ করেন।
বর্তমানে ঠাকুর বাড়ি একটি প্রদর্শনিশালা বা মিউজিয়ামে পরিণত হয়েছে। সোম থেকে শুক্র সপ্তাহের ৫ দিন, সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা আর শনিবার দুপুর ১টা পর্যন্ত দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। রোববার সাপ্তাহিক বন্ধ। প্রবেশ মুল্য ২০ রুপি। এখানে রয়েছে ঠাকুর পরিবারের বিভিন্ন ব্যক্তিত্বদের ব্যবহার করা এবং ঐতিহাসিক সামগ্রী। বাড়ির দ্বিতীয় তলা থেকেই জাদুঘর শুরু। প্রধান দর্শনীয় ঘরের নাম -রবীন্দ্র প্রয়াণকক্ষ। শান্তিনিকেতন থেকে এসে এই ঘরেই বিছানাতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সেই বিছানা ঘেরা রয়েছে কাঠের বেষ্টনীতে।
এই বাড়িতেই কবির সঙ্গে থাকতেন কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী। রয়েছে কবিপত্নীর ব্যবহৃত দুটি ঘর। সেখানে রাখা আছে তার ব্যবহৃত আসবাব। একটি লম্বা পালঙ্ক, বই রাখার তাক। কাঁচের বাক্সে রাখা আছে পানের ডাবা ও ব্যবহৃত টুকিটাকি গহনা।
রয়েছে বেতের চেয়ার-টেবিল। যেগুলো ব্যবহার করতেন ঠাকুর পরিবারের সদস্যরা। পরের ঘরটিতেই রাখা আছে কবির ব্যবহৃত পোশাক ও তার নানান বয়সের ছবি। নিজের তৈরি আশ্রম শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ক্লাস নিচ্ছেন এমন একটি একটি স্থির চিত্র রয়েছে। সেই স্থিরচিত্রে কবিগুরু একজন শিক্ষক।
এছাড়াও ঠাকুর বাড়ির পাকঘর দেখারও আগ্রহ সবার। ঠাকুর বাড়ির সেই হেঁসেল যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করা রয়েছে। ঠাকুরবাড়ির রান্নাঘর, খাওয়ার ঘর ও চালডাল মজুত করার ভাঁড়ার ঘর -সবকিছুই। পাক ঘরের মেঝেতে উনুন এবং দেওয়ালে আটকানো রয়েছে চীনামাটির ও পাথরের বাসনপত্র। খাওয়ার ঘরে গেলেই দেখা যাবে সে সব চেয়ার টেবিল। যেখানে বসে ঠাকুরবাড়ির সদস্যরা খেতেন।
যারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন নিয়ে চর্চা করেছেন তারা এই ঠাকুরবাড়ির দক্ষিণের বারন্দার কথা অবশ্যই জানেন। প্রশস্ত এই বারান্দাটির সঙ্গে কিশোর রবীন্দ্রনাথের জীবনের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সেই বারন্দাটিও সুন্দরভাবে সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে। ঠাকুরবাড়ি ঘুরতে ঘুরতেই চোখে পড়বে কবির আঁতুর ঘর। মা সারদা দেবী ওই ঘরেই ভূমিষ্ঠ করেছিলেন ছোট্ট রবিকে। দোতলার একটি ঘরের নামকরণ করা হয়েছে -বংশপঞ্জি কক্ষ। এখানে ঠাকুর পরিবারের বংশপঞ্জি, পরিবারের সদস্যদের তৈলচিত্র ও কিছু বইয়ের প্রথম সংস্করণ সযত্নে রাখা আছে। ঠাকুরবাড়ির তিন তলাটিও সংরক্ষিত। সেখানে রয়েছে দ্বারকানাথ ঠাকুর, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ভাইপো শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত বিভিন্ন জিনিস।
বাড়ির পাশেই বিচিত্রা ভবন। কবিগুরু এই বিচিত্রা ভবনে বসেই বহু সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। এছাড়া জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির অন্যতম আকর্ষণ তিনটি আর্ট গ্যালারি। আছে বাংলাদেশ-সহ কয়েকটি দেশের গ্যালারি। সে সব গ্যালারিতে ঠাঁই পেয়েছে সংশ্লিষ্ট দেশে কবির স্মৃতি বিজড়িত বহু জিনিস। প্রতিটিতেই রয়েছে কবিগুরুর স্পর্শ।
আপনি যখন ভবন ঘুরে ঘুরে দেখছেন। তখন প্রতিটা ঘর থেকে কানে ভেসে আসবে রবীন্দ্রসঙ্গীত। ঠাকুরবাড়ি ঘুরতে ঘুরতে কখন যেনো মনে হবে সেই পরিবারের আপনিও একজন সদস্য।
কলকাতায় এলে একবার ঘুরে দেখতে পারেন বিশ্ব কবির জন্মস্থান, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি।
বাংলাদেশ সময়: ১৩০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৪, ২০২১
ভিএস/এসআইএস