ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পর্যটন

ভোলার প্রাচীনতম স্থাপনা বিদ্যা সুন্দরীর দিঘী

ছোটন সাহা, ডিস্ট্রিক্ট ককরেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০২১
ভোলার প্রাচীনতম স্থাপনা বিদ্যা সুন্দরীর দিঘী

ভোলা: সংরক্ষণের অভাবে বিলুপ্তের পথে ভোলার প্রাচীনতম স্থাপনা বিদ্যা সুন্দরীর দিঘী। কয়েক শ’ বছর আগে সামন্ত রাজা কন্দক নারায়ন এ দিঘীটি খনন করেন।

তার রাজ্যের নাম ছিল কচুয়া। যেটি পটুয়াখালীর বাউফল এবং ভোলার বোরহানউদ্দিনের একটি অংশ নিয়ে ছিল।

সুবিশাল এ দিঘীকে ঘিরে রয়েছে অনেক ইতিহাস-ঐতিহ্য। রয়েছে অনেক রূপকথার গল্প। দিঘীটি ইতিহাসের ওকটি অংশ হলেও  নতুন প্রজন্মের কাছে তা  অজানা। ভোলা জেলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার দেউলা ও সাচড়া ইউনিয়নের তেঁতুলিয়া পাড় ঘেঁষে অবস্থিত ‘বিদ্যা সুন্দরীর দিঘী’। এক সময়ে দিঘীটি দর্শনীয় স্পট হিসেবে বেশ পরিচিত ছিল। এটি দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসতেন  মানুষ। পর্যটকদের কাছে একটি জনপ্রিয় স্থান ছিল এই দিঘী। একে ঘিরে মানুষের  আগ্রহের যেন কমতি ছিল না। দিঘীর সৌন্দর্য উপভোগ করে মুগ্ধ হতেন তারা।

জেলার অন্যতম প্রাচীনতম স্থাপনা হিসেবে বেশ পরিচিতি ছিল দিঘীটির। কিন্তু বর্তমানে অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে। তেঁতুলিয়ার ভাঙনে বিলীন হয়েছে দিঘীর এক পাড়। ঘাটলাটিও ভেঙে গেছে। দিঘীতে পানি নেই, শুকিয়ে  গেছে।   স্থানীয়রা সেখানে  ফসলের আবাদ করছেন। অন্য দুই পাড়ে গড়ে উঠেছে বসতি।

স্থানীয় জানান, প্রায় ৪/৫ শ’ বছর আগে ৩০ একর জমির উপর  বিদ্যা সুন্দরীর দিঘীটি খনন করা হয়েছিল। এরপর থেকে দিঘীতে পানি প্রবাহ ছিল। তবে, কখন কীভাবে দিঘীর পানি শুকিয়ে গেছে তা কারো জানা নেই। বছরের পর বছর সংরক্ষণের অভাবে দিঘীটির অস্তিত্ব আজ বিলীনের পথে।

প্রায় ৫শ’ বছরের প্রাচীন এ অনন্য স্থাপনাটির সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে অনেকেই জানেন না। দিঘী সম্পর্কে জানতে চাইলে সুশিল সমাজের প্রতিনিধি, ভোলার সিনিয়র সাংবাদিক অ্যাডভোকেট নজরুল হক অনু বলেন, ১৯৯৪ সালের দিকে জাতীয় জাদুঘরের ইতিহাসের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আমি প্রথমবারের মত বিদ্যা সুন্দরীর দিঘী দেখতে গিয়েছিলাম।   দ্বিতীয়বার দেখতে গিয়েছি গত ২৩ ডিসেম্বর।

দিঘীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস সম্পর্কে তিনি জানান, কয়েক শ’ বছর আগে এখানে  কন্দক নারায়ন নামে এক রাজা ছিলেন। তার রাজ্যের নাম ছিল কচুয়া । এটি ছিল পটুয়াখালীর বাউফল এবং বোরহানউদ্দিন উপজেলার একটি অংশ নিয়ে। সেই রাজ্য বহু বছর আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তার  দুই মেয়ে ছিল। একজন কমলা সুন্দরী, অপরজন বিদ্যা সুন্দরী। তিনি দুই মেয়ের নামে দুটি দিঘী খনন করেছিলেন। একটি পটুয়াখালীতে অপরটি ভোলার বোরহানউদ্দিনে। বোরহানউদ্দিনের দিঘীটির নামকরণ করেছিলেন বিদ্যা সুন্দরির নামে। এটি এখন ভোলার ইতিহাসের একটি অংশ। বর্তমানে দিঘীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে। দিঘী পাড়ে গড়ে উঠেছে বসতি। উত্তর-দক্ষিণ এবং পশ্চিম পাড়ে বসতি গড়ে উঠেছে।   মাঝ খানে ফসলের ক্ষেত।

তিনি বলেন, এই দিঘীটি ভোলার একটি ইতিহাস, তা জেলার অনেকেই জানেন না। অনেকেই আবার ভুলে গেছেন। দিঘিটি বিলীনের পথে, চারদিকে বসতি গড়ে উঠেছে, একটি মাত্র পাড় অবশিষ্ট আছে। তবুও ভোলার মানুষ সুবিশাল এ দিঘীটিকে মনে রেখেছে সেটিও কম কথা নয়। বিদ্যা সুন্দরীর দিঘী নামে এখনও পরিচিতি এটি।

তিনি বলেন,  যদি এই দিঘীর এলাকাটিকে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে ধরে রাখা যেত তাহলে দ্বীপজেলার যে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য রয়েছে, ইতিহাস রয়েছে, আগে যে এখানে রাজারা ছিলেন, রাজ কর্ম ছিল- সে সম্পর্কে নতুন প্রজন্ম জানতে পারতো। যদিও এর বিস্তারিত জাতীয় জাদুঘরের রয়েছে। আজকে মানুষ এ দিঘী বা রাজ্যের সব স্মৃতি চিহ্ন ভুলতে বসেছে। এ অবস্থায় প্রাচীনতম এ স্থাপনাটি সংরক্ষণের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি।

এদিকে স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা বহু বছর (৪-৫শ বছর) আগে থেকে দিঘীর কথা শুনেছেন, বয়স্কজনদের মুখে দিঘী বা  তার পাড়টির কথা শুনছেন, তবে অনেকেই পূর্নাঙ্গ দিঘী দেখেননি, দিঘীর সঠিক কোন ইতিহাসও তাদের জানা নেই। দিঘীর পাড়ের জমি কিনে বসতি গড়েছেন অনেকে, কেউ বা দিঘীর জায়গায় চাষাবাদ করছেন।

দিঘীকে ঘিরে  রূপকথা: জনশ্রুতি আছে রাজা নারায়ন যখন দিঘীটি খনন করেন, তখন সেখানে কোনো পানি ওঠেনি।   রাজার মেয়ে বিদ্যা সুন্দরী একদিন স্বপ্নে দেখেন তিনি যদি দিঘীতে নামেন তাহলে পানি ওঠবে। এরপর তিনি দিঘীতে নামার সঙ্গে সঙ্গে পানি উঠতে শুরু করে। কিন্তু তিনি ওই দিঘী থেকে আর উঠে আসতে পারননি। পানিতে ডুবে যান। তিনি (বিদ্যা সুন্দরী) নিজের জীবন দিয়ে দিঘী তৈরি করে গেছেন।

কারো বিয়ে হলে এ দিঘী থেকে  ভেসে আসতো স্বর্ণের থালাবাটি এবং নৌকা। মানুষ তখন ওই থালাবাটি ব্যবহার করতো। কিন্তু একদিন এক অসৎ ব্যাক্তি একটি থালা চুরি করে নিয়ে যায়। এরপর থেকে আর কারো বিয়েতে থালাবাটি ভেসে আসেনি। এ রকম অসংখ্য রূপ কথার গল্প রয়েছে এ দিঘীকে ঘিরে।

যেভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে সরাসরি লঞ্চে ভোলা নামতে হবে। এরপর রিকশা, ইজিবাইক বা অটোরিকশায় করে ভোলা বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল বাস টার্মিনালে নামতে হবে। সেখান থেকে বাসে চড়ে বোরহানউদ্দিন বাস টার্মিনালে নেমে রিকশা, অটোরিকশা, মাইক্রোবাস, মটরসাইকেল বা অন্য কোন ছোট বাহনে দেউলা নেমে যে কাউকে বিদ্যা সুন্দরীর দিঘীর নাম বললে দেখিয়ে দেবে। তবে কিছুটা পথ হেঁটে যেতে হবে।

যা দেখা যাবে সেখানে: পাহাড়ের মত উঁচু সুবিশাল দিঘীর পাড়। মাটির টিলা, দিঘীর ঘাটলার কিছু অংশ। বাহারি প্রজাতির গাছপালা, নির্মল বাতাস। মনোরম পরিবেশ। তেঁতুলিয়া নদী, ছোট গ্রাম, বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত এবং প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য।

বাংলাদেশ সময়: ১৩১২ ঘণ্টা, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২১
এমএমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।