রাজশাহী: প্রাচীন জনপদ ‘রাজশাহী’। বলা হয়, দেশের মধ্যে সবুজ ও নির্মল বায়ুর শহর এটি।
প্রাচীন স্থাপত্য নিয়ে গঠিত দেশের অন্যতম এই ছোট্ট শহরের বিষয়টিই আলাদা। পদ্মার তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা বিভাগীয় এই শহরটি তার রেশম, আম, লিচু এবং সবুজ-পরিচ্ছন্ন প্রকৃতির জন্য প্রসিদ্ধ। রেশমীবস্ত্রের কারণে রাজশাহীকে রেশমনগরী নামে ডাকা হয়। রাজশাহী শহরে উল্লেখযোগ্য এমন অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে যার অনেকগুলোর খ্যাতি আজ দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়েছে।
দেশের অন্যতম বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও নামকরা সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য রাজশাহী শহর শিক্ষানগরী নামেও সমান পরিচিত। রাজশাহী শহর এবং এর আশেপাশে বেশ কিছু বিখ্যাত ও ঐতিহাসিক মসজিদ, মন্দির ও উপাসনালয় তথা ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে। যেগুলো দর্শনে ভিড় থাকে বছরজুড়েই। কখনও যদি আপনার মনে হয় যে, এই ব্যস্ত নাগরিক জীবনের কোলাহল আর সুউচ্চ অট্টালিকার জঞ্জাল থেকে বেরিয়ে কোনো শান্ত শহরে ক’টা দিন নিরিবিলিতে কাটাবেন। তাহলে রাজশাহীর জুড়ি নেই সে কথা নিঃসন্দেহে বলাই যায়। কারণ রাজশাহী তেমনই একটি শহরে। ঈদের ছুটিতেই তাই ঘোরার জন্য আদর্শ স্থান হতে পারে দূষণ কমানোয় বিশ্বসেরা এই রাজশাহী। বুক ভরে পদ্মা নদীর নির্মল বাতাস নিতে রাজশাহী মহানগরের লালন শাহ পার্কে প্রতিদিন বিকেলে লাখো মানুষ ভিড় করেন। শহরের ভেতরেও বেশ পরিচ্ছন্ন একটা চেহারা চোখে পড়ে। সড়ক বিভাজকজুড়ে সবুজের বেষ্টনীসহ সব মিলিয়ে রাজশাহী এখন নির্মল বাতাসের শহর। এখানে একদম হাতের কাছেই রয়েছে সব নাগরিক সুবিধা। ইচ্ছে হলেই পাওয়া যাবে প্রয়োজনীয় সবকিছু। কেবল থাকবে না কোনো কোলাহল, ধুলো-বালি বা কালো ধোঁয়ার অসহ্যতা, বাস-ট্রাকের অবিরত হর্ন, থাকবে না শিল্প-কারখানার বর্জ্যদূষণের অবিরাম নিঃসরণ।
থাকবে না নিরন্তর জ্যামে বসে থেকে সময়কে অসময়ের হাতে ছেড়ে দেওয়ার অনিচ্ছাকৃত মন খারাপ। ঠিক এমন করেই যদি কোনো বেড়ানোর জায়গা পেতে চান তো নির্দ্বিধায় চলে যেতে পারেন এক রাজসিক রাজশাহীতে। চলুন আজ সেগুলো একটু একটু করে জেনে নিই। প্রথমেই শুরু করতে হয় আমের কথা বলে। রাজশাহীর আম বলে কথা, সুখ্যাতি তার দেশজুড়ে। এবারের ঈদ ভ্রমণে আপনার আনন্দ দ্বিগুণ হতে পারে আমকে ঘিরেই। ছোট-বড় কার না পছন্দ আম? এক কথায় বলতে গেলে সবারই। আর এবারের ঈদুল ফিতর আমের বারতা নিয়েই এসেছে।
জৈষ্ঠ্য মাস শুরু না হওয়ায় হয়তো পাকা আমের স্বাদ নেওয়া যাবেনা। তবে কাঁচা আম খাওয়া যাবে। এছাড়া প্রাণ খুলে বেড়ানো যাবে আমের বাগানে। এরই মধ্যে রাজশাহীর বাগানগুলোতে থোকায় থোকায় আম ধরেছে। আর কদিন পরেই সেখান থেকে নানান জাতের সুস্বাদু আম ভাঙা শুরু হবে।
রাজশাহী শহরের আয়তন ৯৬ দশমিক ৭২ বর্গ কিলোমিটার। শহরের পুরোটাই পদ্মা নদী ঘেঁষা। তাই শহরে জীবনের যারা মাঝেই যারা নদীর অবিরাম বয়ে যাওয়া কলকল ধ্বনি শুনতে চান তারা আসবেন এই শহরে। পদ্মার তীরকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে সাজিয়ে তোলা হয়েছে অনেক আগেই। তাই সব সময়ই শহরের আই-বাঁধ, টি-বাঁধ ও বড়কুঠি এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে থাকে।
পদ্মায় পানি থাকুক আর নাই থাকুক নির্মল বাতাস আর বাঁধ ভাঙা আনন্দে মনটাকে যে ভাসাতে পারবেন তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। নদীর পাড়জুড়ে জেগে থাকা ছোট-বড় বালুচর আর রয়েছে ক্ষুদ্র বনভূমি। যেই তপ্ত বালুচরেও খুঁজে পেতে পারেন এক অন্য রকম ভ্রমণ আনন্দ। এই ঈদের ছুটিতে যা আপনাকে নিয়ে যাবে জীবনের ভিন্ন কোনো রোমাঞ্চকর স্মৃতিতে। কাটবে অনাবিল মুহূর্ত। শহরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। যেই ক্যাম্পাসটি বনভূমি আর অরণ্যে আচ্ছাদিত। অসম্ভব নান্দনিক সাজে সব সময় সেজে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোড। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের শুরুতেই সবুজের গালিচা-মোড়া জুবেরি ভবনের বিস্তীর্ণ মাঠ। সেই মাঠ পেরিয়ে কয়েক মিনিট হেঁটে ওপারে গেলেই স্বনামে খ্যাত প্যারিস রোড। যার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোথাও বাঁক নেই। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একদম সোজা। এই সড়কের দুই পাশে দাঁড়িয়ে আপনাকে স্বাগত জানাবে বিশাল বিশাল রেইন ট্রি, কেওড়া, কৃষ্ণচূড়া, দেবদারু আর পাতাবাহারের সারি। রাস্তার প্রতিটি সংযোগ সড়ক যা অন্যান্য ভবনের সঙ্গে সংযুক্ত ৯০ ডিগ্রি কোণে দুই পাশে দুটি কালভার্ট বা ছোট্ট ব্রিজ বসার জন্য।
প্রতিটি ভবনের সামনে আর পেছনে সুবিশাল আর সুস্বাদু আমের বাগান। প্যারিস রোডের একদম শেষে পৌঁছে ডানে গেলেই এক আধুনিক ভবন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবন। পাশেই মুক্তিযুদ্ধের স্বাক্ষর রেখে যাওয়া ভাস্কর্য সাবাস বাংলাদেশ স্বচ্ছ আর বিস্মৃত যার উন্মুক্ত মঞ্চ, ঝকঝকে সিঁড়ি, যেখানে রাত কাটে কতশত দুঃখ আর আনন্দমাখা মুখের হাজারো শিক্ষার্থীর। আছে অন্যতম কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তন, অনিন্দ্যসুন্দর লাইব্রেরি, বোটানিক্যাল গার্ডেন, নীরব আর নিরীহ রেললাইন আর তার পাশের চারুকলা। আছে অদ্ভুত সুন্দর এক পুকুর, যে পুকুর কাটা হয়েছে অবিকল বাংলাদেশের ম্যাপের অনুকরণে। ভীষণ আকর্ষণীয় একটা জায়গা এটি। কিছু দূর পেছনে গেলেই পাবেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বধ্যভূমি। যেখানে গেলে নিমিষেই মন ভালো ও খারাপ দুটোই হবে। এদিকে নাম না জানা অসংখ্য শহীদের আত্মত্যাগের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভটি। ১৯৭২ সালের ২৩ এপ্রিল আবিষ্কৃত একটি গণকবরের ওপর স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ করা হয়। সে সময় মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম এবং স্থানীয় ঠিকাদার জেবর মিয়া গণকবরটি খনন করেন। মৃত্যুকূপ থেকে বেরিয়ে আসে হাজারো মানুষের মাথার খুলি ও কঙ্কাল। মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ শামসুজ্জোহা হল ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটি।
৯ মাস ধরে পাকিস্তানি বাহিনী এবং রাজাকার ও আল-বদররা বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী কাটাখালি, মাসকাটা দীঘি, চৌদ্দপাই, শ্যামপুর, ডাশমারী, তালাইমারী, রানীনগর ও কাজলার কয়েক হাজার নারী-পুরুষকে এখানে ধরে এনে হত্যা করে। তাদের হাত থেকে রেহাই পাননি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ছাত্র, কর্মচারী এবং তাদের পরিবারের সদস্যরাও। এই হলের পেছনে এক বর্গমাইল এলাকাজুড়ে ছিল বধ্যভূমি।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন কাজলা এলাকা এবং রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় পাওয়া যায় আরও কয়েকটি গণকবর। এরপর ঘুরে আসতে পারেন পুঠিয়ার রাজবাড়ি। পুঠিয়া রাজবাড়ির দর্শনীয় দিকগুলো- পাঁচআনি জমিদারবাড়ি, রাজবাড়ী, গোবিন্দ মন্দির, বড় শিব মন্দির, জগন্নাথ/রথ মন্দির।
রাজশাহীর অন্যতম উপজেলা পুঠিয়া। প্রাচীনত্বের দিক দিয়ে পুঠিয়ার রাজবংশ বৃহত্তর রাজশাহী জেলার জমিদার বংশগুলোর মধ্যে তৃতীয়। পুঠিয়া রাজবাড়ির বিশাল চত্বরে রয়েছে নজরকাড়া প্রাচীন মন্দিরগুলো। এছাড়াও পুকুর-দিঘিসহ নানান প্রাচীন স্থাপনা রয়েছে। রাজশাহী শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার পূর্বে এবং রাজশাহী-নাটোর মহসড়ক থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত পুঠিয়া রাজবাড়ি। পুঠিয়ার রানি ভুবন মোহিনী দেবী ১৮২৩ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। পুঠিয়ায় অবস্থিত অধিকাংশ মন্দিরে পোড়ামাটির ফলক আছে। এখানকার পুরাকীর্তির মধ্যে পাঁচআনি রাজবাড়ী বা পুঠিয়া রাজবাড়ী, চারআনি রাজবাড়ী ও ১৩টি মন্দির রয়েছে। এর অদূরেই রয়েছে নাটোরের বিখ্যাত রাজবাড়ি। যেখানে বনলতা সেন আর তাঁর কবিতা, রয়েছে দেশজোড়া খ্যাতির কাঁচাগোল্লা, আমবাগানের স্বর্গের ছায়া, লিচুবাগানের আমন্ত্রণ। এছাড়া রাজশাহী শহর থেকে পশ্চিমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ গেলেই দেখতে পাওয়া যাবে প্রাচীন সোনা মসজিদ। এই মসজিদটি সুলতান হুসাইন শাহর শাসনামলে ১৪৯৩ থেকে ১৫১৯ সালের মধ্যে নির্মাণ করা হয়। মসজিদের ৫০টি গম্বুজ মূল্যবান ধাতু দিয়ে খচিত থাকায় এটিকে ছোট সোনা মসজিদও বলা হত।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ও জাদুঘর বিভাগ মসজিদটির রক্ষণাবেক্ষণ করছে। আর ছোট সোনামসজিদ ‘সুলতানি স্থাপত্যের রত্ন’ বলে আখ্যাত। এটি বাংলার রাজধানী গৌড়-লখনৌতির ফিরোজপুর কোয়াটার্সের তাহখানা কমপ্লেক্স থেকে অর্ধ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এবং কোতোয়ালি দরজা থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। বিশাল এক দিঘির দক্ষিণপাড়ের পশ্চিম অংশজুড়ে এর অবস্থান। মসজিদের কিছু দূর পশ্চিমে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিপ্তর কর্তৃক কয়েক বছর আগে নির্মিত একটি আধুনিক দ্বিতল গেস্ট হাউস রয়েছে। আর রাজশাহী আসবেন অথচ বরেন্দ্র জাদুঘরে যাবন না তাই কী হয়?
বাংলাদেশের সব চেয়ে প্রাচীন প্রত্নসম্পদ সংগ্রহশালা রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘর। বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক এই জাদুঘর বাংলার ব-দ্বীপ অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক কোষাগার হিসেবে পরিচিত। পাল ও সেন আমলের প্রতিমা ভাস্কর্যের জন্য জাদুঘরটির খ্যাতি সারা বিশ্বে। খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দ থেকে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালের বহুবিধ প্রত্ননিদর্শন এ জাদুঘরে সংগৃহিত রয়েছে।
প্রত্ন নিদর্শনগুলো প্রধানত প্রস্তর, স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র, পিতল, ব্রোঞ্জ, লৌহ, কাষ্ঠ, মৃন্ময় ইত্যাদি দ্বারা নির্মিত। জাদুঘরে মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন, সুলতানী ও মুঘল আমলের অমূল্য সব প্রত্ন নিদর্শন রয়েছে। এগুলোর মধ্যে কিছু কিনে আনা হয়েছে, আবার অনেকে স্বেচ্ছায় দান করেছেন। ১৪টি গ্যালারিতে এগুলো সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এখানে মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, ময়নামতির অনেক অমূল্য প্রত্নসম্পদ সংগৃহীত রয়েছে। জাদুঘরের বৌদ্ধ গ্যালারিতে পঞ্চম শতাব্দীর একটি বেলে পাথরের মূর্তি রয়েছে। এ ধরনের মূর্তি বাংলাদেশ চারটি রয়েছে। তার মধ্যে বরেন্দ্র জাদুঘরে দুটি। বাকি দু’টির একটি কুমিল্লা জাদুঘর ও অপরটি চট্টগ্রাম জাদুঘরে রয়েছে। ৩য় ও ৫ম শতাব্দীর হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি রয়েছে। জাদুঘরে বিভিন্ন যুগের প্রায় ৬ হাজার মুদ্রা রয়েছে। স্বর্ণমুদ্রা রয়েছে ৩৮টি।
এছাড়াও রয়েছে দেখার অনেক কিছু। তো ঈদের ছুটিতে ঘুরে আসবেন নাকি একবার এই সবুজ রাজশাহীতে?
বাংলাদেশ সময়: ২১৩৪ ঘণ্টা, মে ০৩, ২০২২
এসএস/এএটি