খাগড়াছড়ি থেকে ফিরে: ক্লান্ত পথিক ক্ষনেক বসিও
আলুটিলা বটমূলে।
নয়ন ভরিয়া দেখিও মোরে
চেঙ্গী নদীর কূলে।
আঁকা-বাঁকা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে আলুটিলার মূল ফটকের সামনের বটমূলে দাঁড়ালেই চোখে পড়বে কবিতার এ কয়টি পঙক্তি। জেলা প্রশাসন পঙক্তিগুলো দিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছে দূর-দূরান্তের পর্যটকদের। দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার পর ক্লান্ত পথিক প্রথমেই খানিক জিরিয়ে নেয় শতবর্ষী এই বটমূলে।
চেঙ্গী নদীর তীরে, আলুটিলার পাহাড় প্রকৃতির চিত্র আগে এক রকম থাকলেও এখনকার দৃশ্যপট পুরোটাই ভিন্ন। সম্পূর্ণ নতুন রূপে সাজানো হয়েছে এখানকার চারপাশ। বৌদ্ধ স্থাপত্যে গড়া দৃষ্টিনন্দন তোরণ পার হলেই দুই পাহাড় নিয়ে গড়ে ওঠা পর্যটনকেন্দ্রের শুরু থেকে গুহা সব খানে এসেছে নতুনত্ব ও নান্দনিকতার ছোঁয়া। পাহাড় প্রকৃতির নতুন এই রূপ দেখতে আগে যারা এসেছেন তারাও আবার ফিরে ফিরে আসছেন।
মূল ফটক পেরিয়ে নয়নাভিরাম হাঁটাপথ কিছুটা এগুতেই চোখে পড়লো অনিন্দ্য সুন্দর এক সেতু। এ পাশে পাহাড় ওই পাশে আরেক পাহাড় মাঝে গিরিখাত। সেতুটি সঙ্গম করিয়েছে দুই প্রান্তের পাহাড়কে। সেতুর ওপর থেকে তাকিয়ে নিচের দিকটা দেখলে গা যেন শিউরে ওঠে।
সেতুটি পার হতেই গোলচত্বর। কি ছিল! কি হয়েছে! আলুটিলার রূপ! শুভ্রতায় যেন চার পাশে ছড়িয়ে পড়ছিল। পাহাড়ের ধাপ কেটে তৈরি করা হয়েছে সিঁড়ি। তৈরি করা হয়েছে সুদৃশ্য বসার জায়গা। যেখানটায় বসে দর্শনার্থীরা এক সঙ্গে দেখছেন পাহাড় সেই সঙ্গে এক পলকে দেখে নিচ্ছেন চেঙ্গী নদী পাড়ের জনপদ খাগড়াছড়ি। একসময় প্রাকৃতিক গুহাটি আলুটিলার একমাত্র আকর্ষণ থাকলেও এখন দুই পাহাড়ের চারপাশে ছড়িয়ে আছে নান্দনিকতা। পুরো অঙ্গনে যেন মুগ্ধতা ছড়িয়ে আছে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী সজিব জানান, খাগড়াছড়ি শহর থেকে আট কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি সড়কের পাশে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬শ’ ফুট উঁচু পাহাড়ে আলুটিলা পর্যটনকেন্দ্রের অবস্থান। ২০০ একর জায়গাজুড়ে গড়ে উঠেছে এই পর্যটন কেন্দ্রটি। প্রতিদিন খাগড়াছড়ি শহর ও উপজেলাগুলো ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসে দর্শনার্থীরা। ছুটির দিন কানায় কানায় থাকে মানুষ।
আলুটিলা পর্যটনকেন্দ্রের টিকিট কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা পীযুষ কান্তি ত্রিপুরা বলেন, এখানে প্রবেশ মূল্য নেওয়া হয় ৪০ টাকা। শুক্র-শনিবার এখানে দর্শনার্থী হাজারের ওপরে থাকে। অন্য সময় প্রতিদিন চার থেকে ৫’শ দর্শনার্থী থাকেন।
এখানকার অন্যতম আকর্ষণ লাভ ব্রিজটি দুই পাহাড়কে যুক্ত করতে তৈরি করা হয়েছে ১৮৪ ফুট দীর্ঘ লোহার এই সেতু (ক্যাবল ব্রিজ)। এই সেতুতে আছে কাঁচের বারান্দা। কাঁচের বারান্দা দিয়ে নিচে তাকালে একদম নিচে পাহাড়ের অন্যরকম দৃশ্যের দেখা মেলে।
পাহাড়ের বাঁ দিকে সড়ক ধরে এগিয়ে গেলেই দেখা মিলবে প্রাকৃতিক গুহা ও ভিউ পয়েন্টের। আর ডান দিকের সড়ক ধরে এগোলেই দুই গজ দূরে নতুনভাবে তৈরি করা হয়েছে ভিউ পয়েন্ট কুঞ্জছায়া।
পরিবার, স্বজন ও বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে নন্দনকানন। কুঞ্জছায়া আর নন্দনকাননের শুভ্র গোলচত্বর আর বসার বেঞ্চ নজর কাড়ছে দর্শনার্থীদের। এখানে বসে ও দাঁড়িয়ে যেন পুরোটা সময় কাটিয়ে দেওয়া যায় আনায়াসেই। লাভ ভিউ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে নিচের জনপদকে দেখতে অসাধারণ লাগে। পুরো খাগড়াছড়ি শহরকে এখান থেকে যেন এক পলকেই দেখা যায়।
শীতল গুহা:
এতসব নতুন নান্দনিকতা যোগ হলেও এখনো এখানকার প্রধান আকর্ষণ হলো প্রাকৃতিক শীতল গুহাটি।
শীতল গুহার দায়িত্বে থাকা কিরণ ত্রিপুরা জানান, গুহাটির দৈর্ঘ প্রায় ৩৫০ মিটার। এখানে আসা প্রায় সবাই গুহাটি দেখে যান। কেউ ঢোকেন আবার কেউ সাহস করেন না। আমি কিছুটা সাহস করেই গুহায় ঢোকার চিন্তা করলাম। সঙ্গে থাকা স্থানীয় রামগড় এলাকার রনিকে নিয়েই গুহার দিকে এগুতেই থাকি আমরা।
পাহাড়ের ঢালে সিঁড়ি বেয়ে আমরা নামছি নিচের দিকে। নামছিতো নামছি পথ যেন শেষই হচ্ছে না। কিছুদূর যাওয়ার পর চোখে পড়লো একটি বিশাল বটগাছ। শিকড়-বাকল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চার পাশে। আরেকটু হাঁটার পর চোখে পড়লো এক পাহাড়ি কিশোর বসে আছে একটি লাঠি নিয়ে। তার কাছে জানতে চাইলাম গুহার সন্ধান সে বললো, চলেন- আমি নিয়ে যাচ্ছি। সঙ্গে থাকা রনি জানালো কিশোরটি এখানকার গাইড।
কিছু এগিয়ে দূর থেকে দেখা গেল আলুটিলার গুহামুখ। আগে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে হতো গুহামুখে। কাছে যেতেই গা যেন ছম ছম করে উঠলো। আমার সঙ্গে থাকা রনি এর আগে গুহায় ডুকলেও এটা আমার প্রথম। সাহস করে ঢুকে পড়লাম। মিনিট কয়েক হাঁটার পর অন্ধকার যেন আরো প্রকট হচ্ছিলো। মুখে হাসি থাকলেও মনের মধ্যে নানা ভয় বাসা বাঁধতে লাগলো। অন্ধকার সাপখোপের ভয়। আবার মনে হচ্ছিলো পাহাড় ভেঙে পড়বে নাতো।
যতদূর যাচ্ছি সারা শরীর যেন শীতল হতে লাগল। কোনো ধরনের সূর্যের আলো নেই গুহায়। ঘুটঘুটে অন্ধকারের পাথুরে গুহা। গুহার ওপর দিক থেকে টিপটিপ পানি পড়ছে; নিচ দিয়ে বইছে শীতল জলধারা। খুব সাবধানে পা ফেলে সামনে এগোচ্ছি। সুড়ঙ্গের তলদেশ খুব পিচ্ছিল। তাই খুব সাবধানে মোবাইলে ফ্লাশ লাইট জ্বালিয়ে পথ এগোচ্ছি। বুক ধুকধুক করছে, মনে নানান শঙ্কা। কয়েক মিনিট হাঁটার পর বাইরের সূর্যের আলো চোখে পড়তে শুরু করেছে। বুকে কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস এসেছে। প্রাণটা যেন ফিরে এসেছে। গুহা থেকে বেরিয়ে দেখি দুই পাহাড়ি কিশোর-কিশোরী শশা বিক্রি করছে। কথা বলে জানা গেল ওরা ভাই-বোন। ওদের থেকে দুটো শশা নিয়ে খেতে খেতে আবার সিঁড়ি বেয়ে ওঠে আসলাম। গুহার সেই কয়েক মিনিটের যাত্রাটি আমার কাছে দুঃসাহসিক যাত্রা মনে হয়েছে। আবার অনেকের কাছে এটি মামুলি ব্যাপার।
উন্নয়ন যজ্ঞ:
পর্যটন কেন্দ্রটির টিকিট কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা পীযুষ কান্তি ত্রিপুরা বলেন, এখানকার পরিবেশ আগে এতটা সুন্দর ছিল না। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক উন্নয়ন হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। পর্যটন কেন্দ্রটির সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাসের উদ্যোগে পর্যটন মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনের অর্থায়নে আলুটিলার উন্নয়নকাজ চলছে। ২০২০ সালে ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে তৈরি করা হয় ভিউ পয়েন্ট কুঞ্জছায়া। এরপর তৈরি করা হয়েছে তোরণসহ নানা স্থাপনা। এই কেন্দ্রে ৮৫ লাখ টাকা ব্যয়ে তৈরি করা হয়েছে লাভ ব্রিজ। আর এক কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে অ্যাম্ফিথিয়েটারের কাজ হয়েছে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অর্থায়নে চারতলার একটি গেস্ট হাউসের কাজও চলছে।
লোক কথা:
লোকমুখে শোনা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় খাগড়াছড়িতে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে এখানকার জনগণ এ পর্বত থেকেই বুনো আলু সংগ্রহ করে তা খেয়ে বেঁচে থাকতো। তারপর থেকে এ পর্বতটি আলুটিলা নামেই পরিচিতি লাভ করে। এখনও এখানে নাকি প্রচুর পরিমাণে বুনো আলু পাওয়া যায়।
স্থানীয় লোকজনের কাছে আলুটিলার এই গুহা ‘মাতাই হাকর’ নামে সুপরিচিত। ত্রিপুরা ভাষায় ‘মাতাই’ শব্দের অর্থ দেবতা আর ‘হাকর’ শব্দের অর্থ গুহা। মাতাই হাকর অর্থ দেবতার গুহা। পাহাড়ের পাদদেশে পাথর আর শিলা মাটির ভাঁজে গড়া এ রহস্যময় গুহা।
যেভাবে যাবেন:
আলুটিলার অবস্থান খাগড়াছড়ি শহর থেকে আট কিলোমিটার আগে। ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ি শহরে যাওয়ার আগে নেমে দেখে যেতে পারেন এই অনিন্দ্য সুন্দর পাহাড় প্রকৃতি। প্রতিদিন রাজধানীর সায়দাবাদ, কমলাপুর, গাবতলী, ফকিরাপুল, কলাবাগান ও টিটি পাড়া থেকে খাগড়াছড়ির উদ্দেশে হানিফ, শ্যামলী, সৌদিয়া, এস আলম, শান্তিসহ বিভিন্ন আরামদায়ক বাস ছাড়ে। এসব বাস যোগে খাগড়াছড়ি যাওয়া যায়। আর যদি ট্রেনে যেতে চান তাহলে নামতে হবে ফেনী। সেখান থেকে শান্তি, হিলকিং অথবা হিল বার্ড বাসে চড়ে খাগড়াছড়ি যাওয়া যায়। চট্টগ্রামের অক্সিজেন মোড় থেকেও বাসে খাগড়াছড়িতে যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে বাস ভাড়া পড়বে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। ফেনী থেকে ২০০ থেকে ২২০ টাকা। চট্টগ্রাম থেকে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২২
এসএইচডি/আরআইএস