মেঘনার বুক থেকে: যে নদীর পানি শীতল ও লক্ষ্মী, তারই নাম শীতলক্ষ্যা। এ লক্ষ্মী নদীর বিশুদ্ধ পানির খ্যাতি একদা ছড়িয়ে পড়েছিলো জগতজুড়ে।
নারায়ণগঞ্জ বরফকল ঘাটে নদীর কাছে ঘেঁষতে না ঘেঁষতেই পানির পচা দুর্গন্ধের দাপুটে উপস্থিতি বেশ টের পাওয়া গেলো। শ্যালোচালিত ট্রলারে মাঝ নদীতে নোঙর ফেলে অপেক্ষায় থাকা সুন্দরবনগামী জাহাজ অবসরে ওঠার পরও গন্ধটা রইলো।
ফেব্রুয়ারি আর মার্চ মাস এ নদীর সবচেয়ে শুকনো মৌসুম। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসেবে, এখন প্রতি সেকেন্ডে মাত্র শ’দুয়েক ঘনমিটার পানি বয়ে যাচ্ছে শীতলক্ষ্যার বুক চিরে।
এ পরিমাণ সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ প্রবাহের মাস আগস্টে প্রবাহিত পানির চেয়ে প্রায় আড়াই হাজার ঘনমিটার কম। গভীরতা এখন ভরা মৌসুমের ১৪ মিটার থেকে নেমে এসেছে মাত্র পাঁচ মিটারে।
নরসিংদীর শিবপুরে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র ও বানার নদীর মিলনস্থল থেকে বেরিয়ে গাজীপুর পেরিয়ে নারায়ণগঞ্জ সদরে ধলেশ্বরীতে পতিত শীতলক্ষ্যার পাড় ভাঙার দুর্নাম নেই। তবুও উন্নয়নের জোয়ারে পাড় খোয়া যাচ্ছে লক্ষ্মী নদীর।
মাত্র দু’দিন আগে হয়ে গেছে অমাবস্যা, শ্মশানকালির পূজা। মাঘী পূর্ণিমা আসতে আরও দিন বারো বাকি। আকাশে এখনও অমাবশ্যারই ছায়া। তীর দখল করে গড়ে ওঠা কারখানার নানারঙা আলো শীতলক্ষ্যার বুকে প্রতিফলিত হয়ে ভেংচি কাটছে যেনো।
একটু পর পানি ক্রমশ স্বচ্ছ হতে শুরু করলো। ধলেশ্বরীর মোহনা চলে এলো প্রায়।
আট নটিক্যাল মাইল গতিতে ছুটছে অবসর। এই নৌযান একনাগাড়ে একটানা ১৬ ঘণ্টা ছুটতে পারে। এরপর পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা বিশ্রাম দিতে হয় ডিজেলচালিত ইঞ্জিনকে। এর সর্বোচ্চ গতি ১২ নটিক্যাল মাইল বলে জানালেন দুই যুগের অভিজ্ঞ নাবিক জাহিদুল ইসলাম। এ জাহাজের মাস্টার তিনি।
তার গল্পের মাঝখানে হাওয়া শুরু হলো। দক্ষিণ থেকে আসছে। তার মানে উত্তুরে হাওয়ার দাপট শেষ। এখন দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর কব্জায় যাচ্ছে প্রকৃতি।
তবে কুয়াশা এখনও ভালোই ভোগাচ্ছে রাতে চলাফেরা করা নৌযানগুলোকে। কোনোদিন রাত তিনটায়, কোনোদিনবা দশটাতেই নদীর উপরে জেঁকে বসছে কুয়াশা। কখনও থাকছে রাত জুড়ে।
হুইল ঘোরাতে ঘোরাতেই জাহিদুল বললেন, ধলেশ্বরী হয়ে মেঘনায় পড়বে জাহাজ। তারপর হিজলার কিছু অংশ বেয়ে ঢুকবে বরিশালের কীর্ত্তনখোলায়। এরপর ঝালকাঠিতে সুগন্ধার মুখ হয়ে পার হবে বাংলার সুয়েজ খ্যাত গাবখান চ্যানেল। তারপর সন্ধ্যা নদীর মুখ হয়ে কচা, বলেশ্বর, বগি খাল হয়ে কাল বিকাল নাগাদ পৌঁছে যাবে বড় কটকায়।
দেখতে দেখতে অবসর চলে এলো ধলেশ্বরীর বাঁকে। এই ধলেশ্বরীর চর নিয়ে শব্দের বুননে জাহানারা আরজু লিখেছেন, ‘আমার পাতার ঘর/ধলেশ্বরীর বাঁধ ঘেরা স্রোত মুখে/ যেথায় জেগেছে চর’।
এদিকটার পানি স্বচ্ছ। চোখের ওপর চাপ ফেলতে থাকা কারখানার আলো নেই এদিকটায়। দূরে নদীর পাড় জুড়ে কালচে সবুজাভ অন্ধকার। নিশাচর জেলে নৌকাগুলো নদীর পানিতে জীবন সংগ্রামের গল্প পেতেছে।
একসময় জেলে নৌকাও কমতে শুরু করলো। দক্ষিণ থেকে আসা বাতাস মেঘনার বুকে দুলুনি বাড়িয়ে দিয়েছে। জাহাজের বুকে ধাক্কা মারছে নদী।
টাঙ্গাইল সদরে যমুনা থেকে বেরিয়ে মুন্সীগঞ্জ সদরে মেঘনায় পড়েছে ধলেশ্বরী। পেরিয়ে এসেছে মানিকগঞ্জ, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ। ভরা মৌসুমে সর্বোচ্চ গভীরতা ছয় মিটার। কম প্রবাহের এই মৌসুমে সেকেন্ডে মাত্র ২০ ঘনমিটারের মতো পানি বয়ে যাচ্ছে ধলেশ্বরীর বুক বেয়ে। গভীরতা নেমে এসেছে তিন মিটারে। নদীর বুকে তাই আঁধার ফুঁড়ে সতর্ক চোখ মাস্টার আর সুকানির।
ওদিকে উপরের তলার লাউঞ্জে নৈশভোজের পর আসর বসেছে গানের। আমন্ত্রিত সাংবাদিক অতিথিরা তো বটেই, আয়োজক প্রজ্ঞার কর্মীরাও বুঁদ হয়ে গেলেন গানে। তাই প্রতি গানের শেষে হাততালি আর ওয়ান মোর ওয়ান মোর দাবি উঠলো গায়ক পান্থ’র কাছে। অনুরোধের আসরে তার কণ্ঠে একে একে আসতে থাকলেন হেমন্ত, মান্না দে, কিশোর কুমার, জগজিৎ সিংসহ তাবৎ শ্রোতাপ্রিয় শিল্পীরা।
রাতের তৃতীয় প্রহরের মাঝামাঝিতে গানের আসর যখন ভাঙলো, অবসর তখন মেঘনার বুক চিরে ছুটছে। এই মেঘনা নদীর দু’টি ভাগ। উজানের অংশটুকু আপার মেঘনা, ভাটিরটুকু লোয়ার মেঘনা।
আপার মেঘনার শুরু কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে কালনী নদী থেকে। চাঁদপুরের মতলবে যেখানে আপার মেঘনা শেষ, সেখান থেকে শুরু হয়েছে লোয়ার মেঘনা। আপার মেঘনা পেরিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িযা, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ। এর দৈর্ঘ্য ১৫০ কিলোমিটার। চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ও ভোলা পেরিয়ে চরফ্যাশনে সাগরে পতিত লোয়ার মেঘনা ১৮০ কিলোমিটার লম্বা। এ নদীরই এক স্থানে ইঞ্জিন থামালো অবসর। আশপাশে আরও নৌযান নোঙর ফেলে রয়েছে। পানির বাহন তো পানিতেই বিশ্রাম নেবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৬৪৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৬
জেডএম/এসএস