সুন্দরবন থেকে: উবু হয়ে কিছু একটা পরীক্ষা করছেন কোয়ার্টার মাস্টার ফারুক হোসেন। কাছে যেতেই আঙুল তাক করে বললেন, বাঘের পায়ের ছাপ।
বলে না দিলে আনাড়ি চোখে হয়তো কিছুই ধরা পড়তো না। কিন্তু তার কথা শুনে বালির ওপরে স্পষ্ট হয়ে ধরা দিলো বাঘের থাবা, নখের গর্ত। শিরদাঁড়ার ওপরে একপ্রকার শিরশিরানি ঠিকই টের পাওয়া গেলো।
কয়েক হাত দূরে আর একটা ছোট ছাপ দেখিয়ে ফারুক বললেন, ওটা ছিলো ছোটো বাঘ।
গোটা দলটা তখন বেশ এগিয়ে গেছে। পেছনে আর কেউ নেই। দ্রুত পা চালিয়ে এগিয়ে যাওয়ার তাগাদা দিলেন ফারুক হোসেন।
বাঁয়ে বঙ্গোপসাগর আর ডানে সুন্দরবন রেখে এবার একটানা পশ্চিমে এগিয়ে যাওয়া। মাথার উপরে সূর্য জ্বলছে। উত্তরে ঘাসঝোপের পেছনে বাইন, খইলস্যা, গেওয়া গাছের ঘনবন। সুন্দরী গাছ কম এ দিকটায়। দক্ষিণের বেলাভূমিতে এসে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মাথায় জোয়ারের বার্তা।
কচিখালীতে নামার পর খুব বেশি সময় যায়নি, জোয়ারের তোড়ে শিগগিরই শুরু হলো ঢেউয়ের গর্জন। এমনিতেই কচিখালী থেকে কটকা পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার সমুদ্র সৈকতকে বিপদজনক হিসেবে চিহ্নিত করেছে বনবিভাগ। নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সাগরে নামার ব্যাপারে। জোয়ারে ভর করে ফুঁসতে থাকা সাগর যেনো সেই সতর্কবাণীকেই প্রমাণ করতে থাকলো।
বন আর সাগরের মাঝখানে যে মিটার পঞ্চাশেক বেলাভূমি সেটাও পানিতে তলিয়ে যায় বর্ষা মৌসুমে। এটা ফেব্রুয়ারি মাস বলে পানি এ পর্যন্ত আসছে না, তবে সৈকতটা স্যাঁতসেঁতে হয়েই আছে। আর তাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে মানুষের ফেলে যাওয়া নানা ধরনের উচ্ছিষ্ট।
পানি, তেল ও বিভিন্ন ওষুধের প্লাস্টিক আর কাঁচের শিশি, পেস্ট, সেভিং ক্রিম আর বিভিন্ন মলমের টিউব, ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের স্যান্ডেল, প্লাস্টিক জগ, মশার স্প্রে, জুস এবং কোল্ড ড্রিংসের ক্যান ও বোতল, জর্দা ও মাজনের কৌটা, ছাতার ডাটি, কলম, এমনকি নানা রঙ ও আকৃতির বাল্বও।
বনবিভাগের নিষেধ অমান্য করে বন দেখতে আসা মানুষ এগুলো সাগরে ফেলে দিয়েছে। আর অভিমানী সাগর সেগুলো ঢেউয়ের আগায় ভাসিতে নিজের বুক থেকে সরিয়ে দিয়েছে সৈকতে। যেখানে শুকাতে থাকা কচুরিপানার বিছানায় আরো আছে গোলপাতা গাছের গুঁড়ি, গোলফল। তালের মতো সাদা শাঁস সেগুলোর ভেতরে। মাঝেমধ্যেই ঢেউয়ে ডুবে ফের জেগে উঠছে সিডরে ভেঙ্গে যাওয়া গাছের ছোট ছোট গুঁড়ি। পুরো সৈকত জুড়েই কাঁকড়ার সরু সরু গর্ত। বছরের এ সময়টায় কাঁকড়া ধরা বন্ধ থাকে।
একটা গর্তের ভেতরে উঁকি দিয়ে লুকিয়ে থাকা কাঁকড়া দেখালেন বনরক্ষী মোজাহারুল ইসলাম। বাড়ি তার সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায়। একবার তো এক ক্ষুধার্ত বাঘিনীর সামনেই পড়ে গিয়েছিলেন তিনি।
মাস দুই আগের ঘটনা। সুপতি ফরেস্ট অফিস এলাকায় গোলপাতা কুণ্ড নামক স্থানে নোঙর ফেলেছিলো তাদের বোট। দুপুরে খালে নেমে কাপড় কাচছিলেন তিনি। গোসল সেরে পাড়ে উঠতেই বুকের রক্ত হিম হয়ে গেলো। বড়জোর ২০ গজ দূর থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে এক বাঘিনী। পেছনে দুটো বাচ্চা।
মোজাহারুল বললেন, যদি নদীতে নামি, বাঘ তাহলে লাফিয়ে ধরে ফেলবে। সঙ্গে রাইফেল নেই। এমন অসহায় অবস্থায় কখনো পড়িনি। বুকের ভেতরে হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে। মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা কঠিন হয়ে উঠলো। মনের সব জোর এক করে বাঘের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইলাম। যতোটা সম্ভব গলাটা স্বাভাবিক রেখে অন্য বনরক্ষীদের ডাক দিলাম।
কি হলো কে জানে, অন্যরা আসার আগেই বাচ্চা দুটি নিয়ে বাঘটা চলে গেলো। কিন্তু আমার সঙ্গীরা এসে আমার কথা আর কিছুতেই বিশ্বাস করে না। শেষে বাঘের পায়ের ছাপ দেখে ওরা বিশ্বাস করলো আমার কথা।
ঘণ্টাখানেক পরে কোস্টগার্ডের খবর এলো, বাচ্চা দিয়েছে বাঘ। সতর্ক থাকতে হবে।
গত ৪ বছরে অন্তত ২০ বার বাঘের দেখা পেয়েছেন, দাবি করলেন মোজাহারুল। যেগুলোর ওজন আনুমানিক ৫ কেজি থেকে ৯৫ কেজি পর্যন্ত।
দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যায় কয়েক কিলোমিটার পথ। কটকা সৈকতের স্থানীয় নাম জামতলা বিচ। এখানে সাগর যেনো গর্জাচ্ছে। গাছপালার গোড়ায় এসে আছড়ে পড়ছে বড় বড় ঢেউ। পেছনে ঢেউয়া বন। বনের একটা অংশ কিছুটা এগিয়েই গেছে সাগরের ভেতরে। তাই সাগরের তীর ধরে আর এগুনো সম্ভব নয়।
এরপর গেওয়া বন পেরিয়ে একটু এগুতেই বোঝা গেলো, এ এলাকার নাম কেন জামতলা। এখানে হাজার হাজার জাম গাছ যেনো গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। এতো বড় জাম বন বোধ করি, বাংলাদেশের আর কোথাওই নেই।
জামবন পেরিয়ে বনঘেরা বিস্তৃত এক তৃণভূমি। কোমর সমান ঘাসবনের মাথার ওপর দিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত দৃষ্টি চলে। তারই মাঝে এক চিলতে সরু পথ। কোথাও কোথাও কিছুটা চওড়া। মাঝে মধ্যে একটা দু’টো তাল, ঝাঁকড়া বরই গাছ।
হঠাৎই সামনে দেখা গেলো, হরিণের দল চরছে। কিছুক্ষণ কৌতূহলী চোখে দেখলো। তারপর বনের ভেতরে সরে গেলো হরিণের পাল। একটা গাছ থেকে দুপদাপ করে নেমে হরিণের দলের পেছন পেছন গেলো এক গাদা বানর।
হরিণ আর বানরের সঙ্গ ছেড়ে আর একটু এগুতেই বর্গাকৃতি একটা পুকুর। একটু দূরে সবুজ জমিনে সাদা বালুর ঢিবি।
বনরক্ষী খুরশিদ মিয়া জানালেন, বাঘের পানি খাওয়ার জন্য এমন অনেক পুকুর কাটা হয়েছে কটকা রেঞ্জে। বাঘ ছাড়াও এখানে পানি খেতে আসে হরিণসহ আরো সব প্রাণী। জোয়ার বেশি হলে পশুদের আশ্রয় নেওয়ার জন্য বালির ঢিবিগুলো তৈরি করা হয়েছে।
বাঘের পুকুর পেরিয়ে কয়েক মিনিট হাঁটতেই তিন তলা সমান উঁচু ওয়াচ টাওয়ার। কাঠের খাড়া সিঁড়ি বেয়ে সেখানে উঠতে একটু কষ্ট হলো বটে, কিন্তু উঠেই মনটা ভালো হয়ে গেলো। এখান থেকে সুন্দরবনের একটা বার্ডস আই ভিউ পাওয়া যাচ্ছে। দু’দিকে সাদা সরু ফিতার মতো ফুটে আছে বনের ট্রেইল।
কয়েক ঘণ্টা সময় লেগে গেলো সাড়ে ছ’কিলোমিটার বুনোপথ পাড়ি দিতে। অবশেষে পা পড়লো কটকা জেটিতে। নিচের খালে কুমিরের বসবাস।
বাংলাদেশ সময়: ১৯২৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৬
জেডএম/
** পাত্তা দিলো না পানির রাজা
** বিষখালীর বাঁকে মরে আছে ধানসিঁড়ি
** বরিশাল ছুঁয়ে সুগন্ধার পথে
** নদীর বুকে আলোর ভেংচি