সুন্দরবন থেকে ফিরে: কুমিরের বসতবাড়ির ওপর দিয়ে ধীর গতিতে ভেসে চললো মজিবর শিকদারের নৌকা। নোনা পানির কুমিরের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত কটকা খাল উত্তর থেকে এসে এখানেই পতিত হয়েছে বঙ্গোপসাগরে।
জলে কুমির আর ডাঙ্গায় বাঘ ছাড়াও বিপদ লুকিয়ে আছে কটকা মোহনা আর সৈকতের ভাঁজে ভাঁজে।
মহীসোপান এখানে অগভীর। অনেকটা একই সমতলে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। তারওপর কটকা খালের ঘোলা জলে মিশে প্রতিনিয়তই পলি এসে জমছে এই মোহনায়। ভাটার সময়ে জোয়ারের জল নেমে গেলে তাই খালি চোখে মহীসোপানকে মনে হয় দিগন্ত বিস্তৃত কাদার মাঠ। আর ওই মাঠের কোথায় যে চোরাকাদার মৃত্যুফাঁদ তৈরি হয়ে আছে বোঝা মুশকিল।
এখানকার সাগর মানুষ খায় বলে দুর্নামও নেহায়েত কম কুড়ায়নি। ২০০৪ সালের মার্চ মাসে এখানে, এই বিপদজনক মোহনায় একযোগে মৃত্যু হয় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যবিদ্যা বিভাগের ৯ এবং বুয়েটের ২ জন ছাত্র-ছাত্রীর। ২০০৭ সালের নভেম্বরে আর সব উপকূলীয় এলাকার চেয়ে এখানে তুলনামূলক বেশি আক্রোশে আছড়ে পড়ে সিডর।
তবুও মানুষ আসে এখানে সৌন্দর্যের টানে। কটকা খালের দৃষ্টিনন্দন পতিত মুখ, দু’পাশে ঘনবনের বিচিত্র রূপ, কুমির, বাঘ আর চিত্রা হরিণের বিচরণ এবং দিগন্ত বিস্তৃত সৈকতে সূর্যাস্তের অবিস্মরণীয় দৃশ্য পর্যটকদের ঠিকই টেনে আনে ভয়ংকর এই সৌন্দর্যের মোহনায়।
খালের পশ্চিম পাড়ে সুন্দরবনের শেষ সীমানার ওপরে ঝুলে থাকা সূর্যটাও অবর্ণনীয় সৌন্দর্যের আধার হয়ে ধরা দিলো নৌকায় বসা অপেশাদার পর্যটকদের চোখে। হালকা কুয়াশামোড়া পড়ন্ত বেলায় সূর্যটা অনেকটাই তেজহীন। তবুও কটকার মোহনায় যুগ যুগ ধরে জমে থাকা পেলব পলিতে চিকচিকে রোদ।
নৌকার ঢেউয়ে কাঁপা কাঁপা জলের বুকে সূর্যটাও দুলছে। যেনো সিঁদুরে বলয়ের ভেতরে জ্বলতে থাকা রূপালী সূর্যটা পানিতে নেমে এসে হাসছে।
তার নিচে মাথা উঁচু করে সভ্যতার জানান দিচ্ছে নি:সঙ্গ এক মোবাইল টাওয়ার। এখান থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে সাগরের বুকে জেগে থাকা দুবলার চরকে ঘিরে যেসব জেলে জীবিকার জাল ফেলে তাদের জন্যই এখানে মোবাইল টাওয়ার বসিয়েছে টেলিটক। ফেলে আসা সুপতি আর কটকা খালের অধিকাংশ স্থানে তাই মোবাইল নেটওয়ার্ক না পাওয়া গেলেও এখানে দিব্যি কাজ করছে জিডিটাল ডিভাইস।
ওই টাওয়ার বরাবর কটকা জেটির দিকে একটু এগুতেই কাদা ফুঁড়ে মাথা উঁচু করে থাকা মরা গাছের গুঁড়িগুলো নজরে এলো। সিডরের ঘূর্ণিতে মুচড়ে ভেঙ্গেছে উপরের অংশ। পানির নিচে থাকতে থাকতে মরা গুঁড়িগুলোর রঙ হয়ে গেছে কালো। ভাটার টানে পানি নেমে যাওয়ায় পলিতে গেঁথে ভেংচি কাটছে যেনো। বুঝি বলছে, এখানে আমার জীবন ছিলো। এখন জীবন নেই। তবু আমি আছি। আমার বড্ড সাধ ছিলো তোমাদের মতো বাঁচার।
মরা এই গুঁড়িসারির পাশে কটকা জেটি। মোবাইল টাওয়ারকে ডানে আর বন বিভাগের অফিসকে বাঁয়ে রেখে সোজা এগিয়ে গেছে বনের দিকে। মূল ভূমিতে গিয়ে যেখানে জেটি শেষ, সেখান থেকে শুরু হয়েছে কয়েক ফুট উঁচু পায়ে হাঁটা এক কাঠের প্লাটফর্ম। বর্ষা মৌসুমে জোয়ারের পানিতে ডুবে যায় এ এলাকাটা। দর্শনার্থীদের জন্য তাই এই উঁচু প্লাটফর্মের ব্যবস্থা। অনেকটা ক্যানোপি টাইপ।
দু’পাশে গেওয়া আর কেওড়ার বন। ভেজা মাটিতে বিছিয়ে আছে শ্বাসমূল। দূরে গাছের ফাঁকে হরিণের পাল চরছে।
কাঠের প্লাটফর্ম থেকে নেমে ডান দিকে খানিক দূর যেতেই কান খাড়া করে কিছু বোঝার চেষ্টা করলো হরিণের পাল। কৌতুহলী চোখে দেখছে। এগিয়ে যেতে দেখে কি বুঝলো কে জানে, কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আগন্তুকদের আরো পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বোধ হয়। এই আগন্তুকরা তাদের ক্ষতির কারণ কি না বোঝার চেষ্টা করছে।
হরিণের দলকে পিছু হটতে দেখে সৈকতের দিকে চলে গেলো পর্যটক দল। এ এলাকায় প্রায়ই বাঘ এসে হানা দিয়ে যায় বলে একা ঘোরা বারণ। কিন্তু হরিণের পালকে নির্ভয়ে চরতে দেখে বোঝা গেলো, এখন কোনো বাঘ নেই এ এলাকায়। থাকলে হরিণের পাল এমন নির্ভার থাকতো না। কিন্তু কি করে আরো কাছে আনা যায় হরিণগুলোকে?
এখানকার মাটিতে ঘাস নেই। কেওড়া গাছের ডালগুলোও উঁচুতে। হরিণের পক্ষে ওই ডালের পাতা নাগালে পাওয়া সম্ভব নয়। শেষ পর্যন্ত তাই হরিণের পালের কাছে পাতাকেই টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হলো। কেওড়া গাছের কয়েকটা ডাল পাতা সমেত ছিঁড়ে মাটিতে বিছিয়ে দিলেন বনরক্ষী মোজাহারুল ইসলাম।
কিছুক্ষণ কিছুই ঘটলো না। কোনো নড়াচড়া পড়লো না হরিণের পালে। কিন্তু একটু পর দ্বিধা জয় করে এক পা দু’পা করে এগিয়ে আসতে থাকলো তারা।
তারপর দ্রুত এসে ফেলে রাখা কেওড়া পাতা খাওয়ায় মন দিলো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সব পাতা খেয়ে ফেললো হরিণের পাল। কঙ্কালের মতো পড়ে রইলো ডালগুলো।
বেলা পড়ে আসছে বলে হরিণের পালের সঙ্গে আর ভাব জমানো হলো না। সূর্য ডোবার আগেই ফিরে যেতে হবে। তার আগে এখানকার সাগর সৈকতটা অবশ্যই দেখা দরকার।
পা চালিয়ে তাই কয়েক মিনিটেই হরিণের চারণভূমি থেকে সাগর সৈকতে। সিডরের তাণ্ডবের চিহ্ন আরো বেশি এদিকটায়। সারি সারি গোড়া এখনো টিকে আছে মাটির ওপরে। দুর্দমনীয় সিডর যে সেগুলোর শরীরকে মুচড়ে ভেঙ্গে নিয়ে গেছে তারই স্মৃতি বইছে যেনো। কতোগুলো গাছ শেকড়শুদ্ধ উপড়ে পড়লেও এখনো প্রাণের গান গাইছে। বেলাভূমিতে পড়ে থাকা কাণ্ড থেকে বেরিয়ে এসেছে নতুন পাতা-শাখা। নতুন জীবনের গান গাইছে যেনো।
সৈকতের কাছাকাছি শ্বাসমূলের সংখ্যাও বেশি এদিকটায়। একেকটা গাছ যেনো শেকড়ে শেকড়ে বিছিয়ে রেখেছে নিজেকে।
সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত কংক্রিটের প্লাটফর্মের একাংশে বসে খোলা সাগরের দিকে তাকিয়ে আছেন ইনডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর সুলতানা রহমান। নিজের মনেই আওড়ালেন, মনটা খারাপ লাগছে। সিডরের আগে এখানে এসেছিলাম। কি জায়গা কি হয়ে গেলো!
তার চোখের সামনে পলিকাদার মাঠের ওদিকটায় টুপ করে সূর্য অস্ত গেলো। ওদিকে আরো দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে আছে দুবলার চর।
আর মাত্র ১০ কি ১১ দিন পর মাঘী পূর্ণিমায় রাসমেলা বসবে সেখানে। সাগরের বুকে উৎসবে মাতবে সাগরজীবী মানুষ।
ফিরতি পথে শাখা দুলিয়ে বিদায় জানালো ঝাউবন। আঁধার জেঁকে বসছে কটকার মোহনায়। সেই আঁধারের চাদর গায়ে মেখেই ফের পানিতে ভাসলো মজিবর
শিকদারের নৌকা। পাড়গুলোকে এখন আবছা দেখাচ্ছে। পেছনে সরে যাচ্ছে কটকার মোহনা। হু হু বাতাসে মনটাও যেনো উড়ে গিয়ে ভাসতে থাকলো ওই মোহনার নোনা জলে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৫
জেডএম/
** পায়ের ছাপ রেখে গেছে বাঘ
** পাত্তা দিলো না পানির রাজা
** বিষখালীর বাঁকে মরে আছে ধানসিঁড়ি
** বরিশাল ছুঁয়ে সুগন্ধার পথে
** নদীর বুকে আলোর ভেংচি