সাবরাং, টেকনাফ থেকে ফিরে: দেশের সবচেয়ে দক্ষিণের ইউনিয়নটির নামই ‘সাবরাং’। কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার মায়ানমারের সীমান্তবর্তী প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমী এ সাবরাং।
তবে দিনে দিনে অবস্থা বদলেছে। অনগ্রসর ও দারিদ্র্য পীড়িত এ জনপদের মানুষ লবণ, পান, নারিকেল-সুপারি চাষ, সমুদ্রে মাছ ধরা বাদ দিয়ে হঠাৎ ‘বড়লোক’ হওয়ার পথে পা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা মানবপাচার ও ইয়াবা চোরাচালানীদের তালিকায়ও সবচেয়ে বেশি সাবরাংবাসীর নাম।
তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের দাবি অনুযায়ী কেবল তালিকাভুক্তরাই নয়, এখানকার প্রায় সব মানুষই কোনো না কোনোভাবে ইয়াবাপাচার বা মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত। এক বছর আগেও কোনো অপরিচিত মানুষ এখানে বেড়াতে আসলে তাকে জোর করে ট্রলারে তুলে থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়া পাঠিয়ে দিয়ে মুক্তিপণ আদায় করা হতো। কিন্তু প্রশাসনিক নজরদারিতে বর্তমানে মানবপাচার বন্ধ থাকলেও থামেনি ইয়াবাপাচার। সবমিলে অনেক বছর ধরেই সাগরপাড়ের সবশেষ ইউনিয়নটি হয়ে উঠেছে অপরাধের অভয়াশ্রম।
তবে দিনবদলের সময় হয়তো এসেছে। স্থানীয়দের ধারণা, বিকল্প আয়ের সুযোগ না থাকায় অপরাধের পথে যায় মানুষ। এখন হয়তো সেই ধারণার পরিবর্তন হবে। সাবরাংয়ের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে কাজে লাগাতে এখানে সরকার গড়ে তুলছে ‘এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক ট্যুরিস্ট জোন’। এখানেই হবে বিদেশিদের জন্য বিশেষ পর্যটন পল্লী। যাতে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে স্থানীয়দের। অনেকের মতে, ‘নিকষ আঁধারের বুকে আলোর রেখা’।
চৈত্রের কাঠফাঁটা রোদ্দুরের শরীর ঝলসানো দুপুরে যখন সাবরাং বাজারে পৌঁছালাম তখন গণগণে সূর্য মাথার ওপর। গত ২২ মার্চ অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের রেশ যেনো তখনো বিদ্যমান। নির্বাচনের দিন সংঘর্ষে এখানে তিনজন নিহত হওয়ায় পরিবেশটাও থমথমে। কেমন যেনো ভূতুড়ে।
সব মিলিয়ে মূল রাস্তা ছেড়ে অটোচালক ভেতরের দিকে যেতে রাজি হলো না। প্রায় ৪ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে যখন সরকারের নির্ধারিত বিশেষ পর্যটন পল্লীতে এসে পৌঁছাই তখন ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত শরীরও যেনো জেগে উঠলো সাগড় পাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য দেখে। সত্যিই অপরূপ সাবরাং। সাগর পাড়ের রাজকন্যা! এখানকার ফেনিল জলের রং কক্সবাজারের সৈকতের মতো ঘোলাটে নয়, নীল। বিচের গড়নও ঢালু নয়, সমুদ্র বিস্তৃত। বাতাসও একটু বেশি শীতল।
প্রকল্প এলাকায় কেবল ঝাউসারি আর সুনীল জলের সাদা ফেনার রাশিই নয়, এর পাশাপাশি বিচের একটু পরপরই চোখে পড়ে জেলে নৌকার নজরকাড়া সমাবেশ। এর আরো একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, প্রকল্পটির একপাশে যেমন সাগর, অন্যপাশে নাফ নদী।
সাগর পাড়ে যেমন রয়েছে ঝাউবন তেমনি নদীর পাড়ে রয়েছে ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের উপস্থিতি ও লবণ খেত পর্যটকদের মন কাড়বে। নদী তীরে দাঁড়ালেই চোখে পড়বে মায়ানমারের সুউচ্চ পাহাড় সারি। এখানকার পুরো এলাকাই লবণ, পান, সুপারি ও নারিকেলের জন্য প্রসিদ্ধ।
স্থানীয় সমাজসেবক মোজাম্মেল হোসেন যেমন বলছিলেন, ‘সাবরাং বিশেষ পর্যটন অঞ্চল বা স্পেশালাইজড ইকোনোমিক জোন’, এ অঞ্চলের মানুষের জন্য আশীর্বাদ হয়েছে এসেছে। এখানকার কিছু মানুষ সাধারণত পান, লবণ ও সুপারি চাষের সঙ্গে জড়িত। তবে বেশিরভাগেরই জীবিকা সাগরে মাছ ধরা। কিন্তু নতুনপ্রজন্ম সাগরে মাছ ধরতে যেতে চায়না। ফলে এ অঞ্চল পরিণত হয়েছে অপরাধের অভয়াশ্রমে।
তিনি বলেন, পর্যটন পল্লীকে কেন্দ্র করে সরকারের উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ এখনো শুরু না হলেও অপরাধপ্রবণ এবং অনগ্রসর ও পশ্চাৎপদ এ জনপদে এরইমধ্যে প্রকল্পকে ঘিরে ব্যাপক চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। আশা করি টেকনাফের সব বদনাম এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে দূর হবে।
প্রকল্পটির ‘ক্ষুরেরমুখ ঘাট’ এলাকায় গিয়ে দেখা গেলো প্রকল্প এলাকায় পর্যটকদের নিশ্চিন্তে পৌঁছানোর জন্য কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভকে সম্প্রসারিত করা হয়েছে প্রকল্প পর্যন্ত। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে কয়েকটি ঠিকাদারি গ্রুপ দ্রুতগতিতে মেরিন ড্রাইভ তৈরির কাজ করছে। চলছে সে কর্মযজ্ঞ। জানা গেলো ভবিষ্যতে মেরিন ড্রাইভ নাকি শাহপরীর দ্বীপ ঘুরে নাফ নদীর বেড়িবাধেঁর ওপর দিয়ে গিয়ে মিশবে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে। প্রকল্প এলাকার ভূমী উন্নয়নের চিত্রও চোখে পড়লো।
স্থানীয় ব্যবসায়ী সাইফ উদ্দীন বলেন, সাবরাং ট্যুরিস্ট জোনের কারণে পুরো টেকনাফেই এক নতুন চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। প্রকল্পের কারণে দ্রুত মেরিন ড্রাইভ নির্মাণের কাজ চলছে। বাইরের বিনিয়োগকারীরা দল বেধেঁ টেকনাফে আসছেন। প্রকল্প এলাকার বাইরে তারা জমি কিনছেন। এক বছর আগেও এক কানি (৪০ শতাংশ) জমির দাম যেখানে ৫/৬ লাখ টাকা ছিল, তা এখন ২০/২৫ লাখে বিক্রি হচ্ছে।
তিনি বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে, বিকল্প কর্মসংস্থানের ফলে মানুষ ইয়াবা পাচার, মানবপাচারের মতো কাজ থেকে সরে আসবে।
সাবরাং এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোনের জন্য এরইমধ্যে ১৩৫ একর সৈকতসহ আশপাশের অতিরিক্ত আরও এক হাজার ১৬৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ২০১৫ সালের ২৭ আগস্ট অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় এ প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রায় হাজার কোটি টাকা ব্যায়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্যমতে, নিরাপদ ও দ্রুত বিশেষ পর্যটন পল্লীতে যাতায়াতের জন্য সড়কসহ নানা অবকাঠামো তৈরি করা হবে। পর্যটকের নিরাপত্তা জোরদার করা হবে। পর্যটন পল্লী স্থাপিত হলে স্থানীয় লোকজনের ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে কয়েকগুণ। সাবরাং সৈকতসহ পর্যটন এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দাদের যাতায়াত সংরক্ষিত রাখা হবে। এটি শুধু বিদেশিদের জন্যই সংরক্ষিত থাকবে।
বিদেশি পর্যটকের থাকা-খাওয়া, বিনোদনের আধুনিক সুবিধা সবই এ পল্লীতে থাকবে। সৈকত ঘেঁষে তৈরি করা হবে তারকামানের একাধিক হোটেল, মোটেল ও কটেজ। সৈকতের বালুচরে বিচ ভিলা, ওয়াটার ভিলা, নাইট ক্লাব, কার পার্কিং, সুইমিংপুল, কনভেনশন হল, বার, অডিটোরিয়াম, বিনোদন পার্ক, ক্রাপট মার্কেট, ল্যান্ড স্কেপিং, অ্যামিউজমেন্ট পার্কসহ বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। এর অর্থায়ন করবে ইসলামী ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি)।
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের ৩০ জুন বিশ্বমানের বিশেষ পর্যটন পল্লী তৈরির জন্য অর্থ সহায়তার ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে আইডিবির চুক্তি হয়। এরপর বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন উখিয়ার মনখালী ও মহেশখালীর সোনাদিয়ায় পৃথক দু’টি বিশ্বমানের পর্যটন পল্লী তৈরি প্রকল্প হাতে নেয়। কিন্তু ২০১০ সালে আইডিবি প্রকল্পের বিপরীতে অর্থায়নে অপারগতা প্রকাশ করে।
এরপর ২০১১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যটন সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় মনখালী ও সোনাদিয়া প্রকল্প বাতিল করে টেকনাফের সাবরাং সৈকতে বিশেষ পর্যটন পল্লী স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে আইডিবি সম্মতি দেয়।
বেসরকারি বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এ বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, সাবরাং ট্যুরিস্ট জোন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রায় এক হাজার ১৬৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, যার মধ্যে ৯৩৭ একর সরকারি খাসজমি। আইনি বাধ্যবাধকতা মেনে সমুদ্র সৈকতের ১৩৫ একর জমি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে সরকার।
বাংলাদেশ সময়: ১২১২ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৫, ২০১৬
আরএম/জেডএস