সেন্টমার্টিন থেকে: খাঁজ খাঁজ পাহাড় সারির উপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ। নাফ নদী পেরিয়ে মায়ানমারের আকাশই বুঝি গন্তব্য মেঘদলের।
দমদমিয়া ছাড়ার পর সেন্টমার্টিনগামী জাহাজটি ১২২ ডিগ্রি দক্ষিণ-পূর্বে ছুটতে শুরু করলো। নিমিষে উবে গেলো ড্যান্সিং বাসে নাকাল হওয়ার কষ্ট। কক্সবাজার ছাড়ার পর ঘণ্টা আড়াইয়ের টানা ঝাঁকি শরীর বিষিয়ে তুলেছিলো। কিন্তু বঙ্গোপসাগরের মাতাল হাওয়ার আদুরে পরশে সব কষ্ট উধাও।
মৌসুম পরিবর্তনের সময় বলে এখনো গতিপথ স্থির হয়নি বাতাসের। মৌসুমী বায়ু এই দক্ষিণ-পূর্ব তো এই দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে ছুটে আসছে। আবার হয়তো পরক্ষণেই ছুটে আসছে সোজা দক্ষিণ থেকে।
কেওড়া বন ছাড়িয়ে নাফের মাঝামাঝি আসতেই হাতের বাঁয়ে নজরে এলো মায়ানমারের পাহাড় সারি। মেঘের ছায়ায় শুয়ে খাঁজ কাটা শরীরে এগিয়ে গেছে দক্ষিণ অভিমুখে। ডানে মায়ানমারের আকিয়াব বন্দরের অবস্থানটা ঠিক ঠাহর করা গেলো না।
এমন পরিবেশে নীচতলার ডেকে রেলিং ধরে ঝুঁকে পানির সঙ্গে প্রেমে মত্ত নরসিংদীর বেলাবো থানার আব্দুর রহমান বাদল। আলাপ জমাতেই স্মৃতির ঝাঁপি মেলে ধরলেন তিনি। বললেন, ১৯৯৬ সালে প্রথম সেন্টমার্টিন যাই ইঞ্জিন বোটে। ভাড়া ছিলো ৩০ কি ৪০ টাকা। এখন যাচ্ছি অত্যাধুনিক জাহাজে। সেই ৪০ টাকার ভাড়া এখন সাতশ’ হয়েছে।
আর একটু এগোতেই ডানে পড়লো দেবতার পাহাড়। তারই কোলে শুয়ে পানির কিনারায় ঝুলে টেকনাফ শহরের দিকে এগিয়ে গেছে পাহাড়ি পাকা রাস্তা। বাঁয়ে অনেক দূরে নদীটিকে যেনো বেড় দিয়ে রেখেছে মায়ানমারের পাহাড় শ্রেণী। নদীর মধ্যিখানে বৃত্ত রচনা করে জাল ফেলেছে গোটা দশেক জেলেনৌকা।
জাহাজের কর্মকর্তা শাহ আলম নিয়ে গেলেন মাস্টার ব্রিজে। মাস্টার দেলোয়ার হোসেনের বাড়ি যশোর। ২৫ বছরের নাবিক জীবন তার। জানালেন, টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে ডুবোচর বাড়ছে। ভাটার সময়ে প্রায়ই ঠেকে যাচ্ছে জাহাজের তলা। গেলো সপ্তাহেও ডুবোচরে আটকা পড়েছিলো এমভি কুতুবদিয়া।
কোনো ভাটার সময়ে ডুবোচরে জাহাজ আটকে গেলে পরবর্তী জোয়ার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় তাদের। তবে সে সময় ট্যুরিস্টদের মধ্যে তৈরি হয় আতঙ্ক। তাদের সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। জাহাজ চলাচলের নির্ধারিত রুটে জেলেদের ফেলা জালও বেকায়দায় ফেলে তাদের।
তবে মাত্র সাত ফুট পানি পেলেই জাহাজ চলতে পারে বলে জানান তিনি।
তার জাহাজের ওয়ারলেস কাজ করে ৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত। অবস্থান জানার জন্য আছে জিপিএস এর মতো আধুনিক প্রযুক্তি, অত্যাধুনিক রাডার।
৮.৯ নটিক্যাল মাইল গতিতে ছুটছে ১২ নটিক্যাল মাইল ক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজ। ইকো সাউন্ডারে গভীরতা দেখাচ্ছে ৫.৭৮ থেকে ৫.৮০ মিটার।
সমুদ্র পথের দূরত্ব বুঝতে নটিক্যাল মাইল বিষয়টি বুঝে ওঠা খুব বেশি দরকার। বিষয়টি সবচেয়ে ভালো বোঝা যায় বিষুবরেখাকে বৃত্ত ধরে। পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে এটি ৩৬০ ডিগ্রি কোণ তৈরি করে। বিষুবরেখার দৈর্ঘ্যকে ৩৬০ দিয়ে ভাগ করলে প্রতি ডিগ্রি কৌণিক দূরত্ব পাওয়া যায়। একে ৬০ দিয়ে ভাগ করলে পাওয়া যাবে এক মিনিট কৌণিক দূরত্ব। এটাই নটিক্যাল মাইল। এই নটিক্যাল মাইলের ধারণাটা অবশ্য আরো পুরনো।
প্রাচীনকালে জাহাজের গতি বের করার জন্য সমদূরত্বে গিট্টু (নট) বাঁধা দড়ি ব্যবহার করা হতো। দড়ির এক মাথায় একটি কাঠের খণ্ড বেঁধে চলন্ত জাহাজ থেকে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হতো। দড়ির আরেক মাথা থাকত জাহাজের নাবিকের হাতে। জাহাজ চলত আর তিনি দড়ি ছাড়তেন। কত সময়ে কয়টি নট পার হচ্ছে তা গণনা করে জাহাজের গতি বের করা হতো। এই এক নটিক্যাল মাইলে ১৮৫২ মিটার বা ১.১৫১ মাইল।
আর এক মাস্টার মনির হোসেনের বাড়ি নেত্রকোনা। আঙুল তুলে দেখালেন, একটা বয়াও নেই নাফ নদীতে। কাজটা সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের। তারা কাজটা ঠিকঠাক করলে জাহাজ চলাচল নিরাপদ হতো। কিন্তু সেটা তো আর করছে না তারা। আর কোনো জাহাজ দুর্ঘটনায় পড়লে দোষ হচ্ছে নাবিকের। বলা হচ্ছে-অদক্ষ নাবিকের কারণেই দুর্ঘটনা ঘটছে।
টেকনাফ পেছনে ফেলে সাবরাং বরাবর চলে এলো জাহাজ। উল্টোদিকে মায়ানমারের মংডু। ওখানকার বৌদ্ধ জাদি হলুদ রং নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রংটা জাহাজ থেকেও স্পষ্ট ঠাহর করা যায়।
সাবরাং ছাড়িয়ে এগোতেই ডানে বাংলাদেশের অবিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডের শেষ প্রান্ত শাহ পরী দ্বীপ। সরু সরলরেখার মতো নদীর দিকে এগিয়ে এসেছে শাহ পরী জেটি। মায়ানমার থেকে ছেড়ে আসা মালবাহী জাহাজ টেকনাফে খালাস হওয়ার আগে এখানে চেক হয় বিজিবি জওয়ানদের হাতে। নদী থেকে মায়ানমারের কাঁটাতারের বেড়া বেশ নজরে আসছে। গভীরতা এখানে বেড়ে সাড়ে ৯ মিটার হয়েছে। সর্বোচ্চ ১৯ মিটার গভীরতা পড়বে পথে। নদী ছুঁয়ে থাকা মায়ানমার সীমান্তে এখন নাইক্ষ্যংদিয়া।
সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ মাস্টার দেলোয়ার হোসেন জানালেন, বেলা ১২টা নাগাদ সেন্টমার্টিন পৌঁছুবে তার জাহাজ। ঠিক তখনই দুলুনি বেড়ে গেলো জাহাজের। গভীরতা বেড়ে ১০ মিটার ছাড়ালো। এতোক্ষণে নজরে এলো গোটা তিনেক গাঙচিল।
নাফ নদীতে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ গাঙচিলের দল আজ উধাও। কোথা থেকে আসা গাঙচিল তিনটাও জাহাজের সামনে কিছুক্ষণ উড়ে চলে গেলো মায়ানমার সীমান্তের দিকে। একটু পরই ছোট্ট শরীর তিনটি হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো যেনো।
ডানে পেছনে পড়ে রইলো শাহ পরীর সবুজ রেখা। বাঁয়ে নাইক্ষ্যংদিয়া শেষ হতেই গভীরতা বেড়ে হলো ১৭ মিটার। ১৭.৮ মিটারে উঠে কাঁপতে থাকলো ইকোসাউন্ডারের ছোট্ট মনিটর। ১০, ১১, ২২ ও ২৪ সেন্টিমিটার আকৃতির ৪টি মাছের অবয়ব ফুটে উঠলো ৫ থেকে ১০ মিটার গভীরতার মধ্যে।
মোহনায় এসে ১৭৮ ডিগ্রি দক্ষিণ-পূর্বে ঘুরে গেলো জাহাজের নাক। শাহ পরী দ্বীপের দক্ষিণে কয়েক কিলোমিটার লম্বা ডুবো চরে বাধা পেয়ে ফেনা তুলছে উত্তাল সাগর স্রোত। নাফ নদীর বুক বেয়ে ৩০ কিলোমিটার জলপথ এরইমধ্যে পেরিয়ে আসা গেছে। আর মাত্র ১০ কি ১২ কিলোমিটার সাগর পথ আছে সামনে।
কক্সবাজার জেলার সর্ব দক্ষিণ-পূর্ব কোণ দিয়ে প্রবাহিত প্রলম্বিত খাঁড়ি সদৃশ নাফ নদী মায়ানমারের আরাকান থেকে কক্সবাজার জেলাকে বিভক্ত করেছে। ১.৬১ কিলোমিটার থেকে ৩.২২ কিমি প্রস্থবিশিষ্ট এই নদী আরাকান ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তের অন্যান্য পাহাড় থেকে উৎপন্ন এই সীমান্ত নদী বাংলাদেশ ও মায়ানামারকে পৃথক করে এগিয়ে পতিত হয়েছে বঙ্গোপসাগরে।
সেই নাফের মোহনায় হঠাৎ ভয়ঙ্করভাবে দুলে উঠলো জাহাজ। তারপর দুলতেই থাকলো। সাগর যেনো জাহাজটিকে নিয়ে খেলছে। ডেকের উপরে হাঁটাচলা তো দূরের কথা, দাঁড়িয়ে থাকাই দায় হয়ে উঠলো। হঠাৎ কেঁপে উঠে রিডিং শূন্য হয়ে পড়লো ইকোসাউন্ডার। প্রবল স্রোত আর ঢেউয়ের কারণে খেই হারিয়ে ফেলেছে।
সাগরযাত্রায় অনভ্যস্ত অনেকেই পেটের খাবার উগরে দিলেন এ সময়। গোটা জাহাজে যেনো আতঙ্ক আর আনন্দ একসঙ্গে ভর করেছে। এ যেনো এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। মিনিট পনেরো দুলুনির পর কিছুটা কমে এলো দুলুনি। কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ হলো না।
ঘোলা জলের সীমানা ফেলে জাহাজ পড়লো নীল জলের সীমানায়। চোখের সামনে স্পষ্ট হলো বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের অবয়ব। দূর থেকে কালচে সবুজের রেখাকে গাছের সারি বলে নিশ্চিত হওয়া গেলেও কোনটি কোন গাছ তা ঠাহর করা গেলো না।
শিগগিরই জাহাজ এসে ভিড়লো সেন্টমার্টিন জেটিতে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪০ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৭, ২০১৬
জেডএম/
** সেন্টমার্টিন যেভাবে যাবেন