সেন্টমার্টিন থেকে: যত না মানুষ তারচেয়ে বেশি রিসোর্ট। পুরো সেন্টমার্টিন চক্কর দিয়ে তা-ই দেখা গেলো।
পর্যটনে পরিমাপের একটি পদ্ধতি ইংরেজি অক্ষরে ‘টিসিসি’ যার মানে হলো ‘ট্যুরিজম ক্যারিং ক্যাপাসিটি’। পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করে কতসংখ্যক পর্যটক একটি এলাকায় গ্রহণ করা যায় সেই পরিমাপ পদ্ধতিকে পর্যটন বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন টিসিসি।
‘সেই হিসেবে সেন্টমার্টিন এখন ঝুঁকিতে আছে’- বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি বিভাগের অধ্যাপক ড. রাশেদুল হাসান।
বুধবার (০৬ এপ্রিল) দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হেঁটে যখন পুরো সেন্টমার্টিন পদক্ষিণ করছি তখন মুহূর্তে মুহূর্তে চোখে পড়ছে বাড়িঘরের আধিক্য আর ব্যাঙের ছাতার শত রিসোর্ট হোটেল ও কটেজ। কোথাও কোথাও ইট পাথরের দালানও গড়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। আর পর্যটন মৌসুমে এখানে সাধারণ মানের কোনো হোটেলের ভাড়া পড়ে ১৫০০ থেকে ২ হাজার।
অধ্যাপক ড. রাশেদুল হাসান বলেন, দেশে অভ্যন্তরীণ পর্যটন বেড়ে যাওয়ার কারণে এখন আমরা দিনে কতলোককে সেন্টমার্টিন যেতে দিব এটা হিসেব করার সময় এসেছে।
এ প্রসঙ্গে উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, ১০ বছর আগে সুন্দরবনের কটকাতে নামলে ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সমুদ্রে হেঁটে যাওয়া যেতো। এখন পুরো মাঠ ফাঁকা। এ অবস্থায় আরও ১০ বছর পর দেখা যাবে ওখান থেকে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে।
এখন টিসিসি করার উপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, সেন্টমার্টিনে যখন টিসিসি করা জরুরি হয়ে পড়েছে তখন বিভিন্ন সংগঠনকে সহযোগিতা করার জন্য চিঠি দিলেও তারা সাড়া দেয়নি।
শেষ পর্যন্ত কিছুদিন আগে নিজের টাকা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি বিভাগের কয়েকজন ছাত্রকে সেন্টমার্টিন পাঠিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।
সেই প্রতিবেদনের তথ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেন্টমার্টিনের লোকসংখ্যা এখন ১০ হাজারের কাছাকাছি। এটা ৩ থেকে ৪ হাজারে নামিয়ে আনতে হবে। বাকি জনসংখ্যা কোথায় নিয়ে গেয়ে পুনবার্সন করা হবে তা যাই হোক পরিবেশ প্রকৃতি আর সেন্টমার্টিন বাঁচাতে হলে এটা অবশ্যই করতেই হবে।
ঢাবির ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এখন সেন্টমার্টিনে যারা বসতি গড়েছে তাদের অর্ধেকের বেশি বাইরে থেকে আসা মানুষ।
সেন্টমার্টিনে এখন কতসংখক পর্যটক গ্রহণ করা যেতে পারে? এমন প্রশ্নে তিনি টিসিসির জরিপ ভিত্তিতে বলেন, খুব বেশি হলে দিনে আড়াই হাজার ট্যুরিস্ট গ্রহণ করা যেতে পারে কিন্তু কোনোভাবেই আড়াই হাজারের উপরে ট্যুরিস্ট গ্রহণ করা যাবে না।
কিন্তু সেন্টমার্টিন ঘুরে বাস্তব চিত্র একটু ভিন্ন তা জনা গেলো। স্থানীয় অধিবাসীদের মতে, শীতকালে দিনে পর্যটক আগমন ঘটে অন্তত ৫ থেকে ৬ হাজার। এখানে এ নিয়ে কোনো বাছ-বিচার নেই। যত ইচ্ছা যাচ্ছেন, থাকছেন।
পরিবেশ ও পর্যটন বিশেষজ্ঞদের আরেকটি আশংকা এখানকার হোটেল-মোটেল ও রিসোর্ট নিয়ে। তারা বলছেন, অবিলম্বে সেন্টমার্টিনে সব বড় অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। যা থাকবে তা হবে ইকোপদ্ধতিতে। যেমন ঘর হতে হবে কাঠের ছনের, অল্প কিছু টিন-ইট দেওয়া যেতে পারে।
কিন্তু এসব দেখার এখানে কেউ নেই-এমন অসহায়ত্ব পরিবেশ ও প্রকৃতিপ্রেমীদের।
পর্যটন করপোরেশনের ন্যাশনাল হোটেল ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ট্যুরিজম ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ পারভেজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, এক্ষেত্রে আমাদের পর্যটন পলিসি হতে হবে ভুটানের মতো। ভুটান যেভাবে সংরক্ষিত (রেস্ট্রিকটেড ট্যুরিজম) নিয়মে পর্যটন করে আমাদেরকেও সংরক্ষণ নিয়ম অনুসরণ করা উচিত। ম্যাস ট্যুরিজম (সবার জন্য উন্মুক্ত) সেন্টমার্টিনের বড় ক্ষতিসাধন করে দিচ্ছে বলে একই মত পারভেজ আহমেদ চৌধুরীর।
সেন্টমার্টিনের আদি অধিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের এখানে পর্যটক আগমন শুরু হয় ১৯৯৭ সালের দিকে। তার আগে সেন্টমার্টিনে পর্যটক যাতায়াত ছিলো প্রায় শূন্য। আর বাহন একমাত্র ইঞ্জিনচালিত নৌকা।
৯৭ সালে প্রথম সেন্টমার্টিন রিসোর্ট নামে একটি পর্যটক আবাসন গড়ে তোলা হয়। পরে ওই রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ ইঞ্জিনচালিত দুটো নৌকার সার্ভিস শুরু করে। একটি ডবল ইঞ্জিন, আরেকটি সিঙ্গেল ইঞ্জিনের। বড়টিতে ৪০ থেকে ৪৫ জন ও ছোট নৌকায় ২৫ থেকে ৩০ জনের মতো আসা-যাওয়া করতে পারতেন। টেকনাফ থেকে যাত্রা শুরু হতো সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে। পৌঁছতো বিকেলে। আবার পরের দিন ফেরা সকাল ৭টায়।
টেকনাফে ফিরতে ফিরতে দুপুর। সেন্টমার্টিনে সেই থেকে শুরু হয় বড় সংখ্যায় পর্যটক আগমন।
২০০০ সালের পর থেকে পর্যটকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ২০০৩ সালে টেকনাফ থেকে ঘাট সরিয়ে আনা হয় দমদমিয়ায়। এখানে কাঠের জেটি থেকে জাহাজে চেপে বসেন পর্যটকরা। এখন প্রতিদিন গড়ে ৫ হাজারের বেশি পর্যটক সেন্টমার্টিন যাতায়াত করে থাকেন। ৬টি জাহাজ সেন্টমার্টিনে যায়।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২২ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৭, ২০১৬
এসএ/এসআর
** ডাব-তরমুজেই পকেট ফাঁকা সেন্টমার্টিনে
** আতঙ্ক আর আনন্দ একযোগে ভর করলো সাগরে