সেন্টমার্টিন থেকে: ‘সাগরে বিমানের ছোঁয়া’ স্লোগান লেখা স্পিডবোটের গায়ে। যারা লিখেছেন তারা রসিক বটে।
জেটির নিচে কংক্রিটের পিলারগুলোর গায়ে লেপটে আছে ফি বছর জমতে থাকা শামুকের খোলস। স্তরে স্তরে শামুক জমে রূপ নিয়েছে অদ্ভুত এক ভাস্কর্য কর্মে।
পর্যটকদের অভ্যর্থনা জানাতেই যেনো জেটির গোড়ায় দাঁড়িয়ে সাগর বাতাসে মাথা দোলাচ্ছে ঠ্যাংঠেঙে গোটা বারো ঝাউ গাছ। তার উল্টোদিকে রাস্তার ওপরই ভ্যানে সাজানো আস্ত কোরাল মাছের শুটকি। এখান থেকেই শুরু সেন্টমার্টিনের একমাত্র বাজার। সব মিলিয়ে সোয়াশ’ দোকান। ইউনুস নামে বছর দশেকের এক ছেলে দ্বীপে উৎপাদিত বরবটি বিক্রি করছে ৪০ টাকা কেজি দরে।
জায়গাটার নাম উত্তরপাড়া। সবজি দোকান থেকে শুরু করে সস্তা-দামি রেস্তোরাঁ, বার্মিজ কাপড়, বাদাম-আচার, ফ্লেক্সিলোডের দোকান, তরমুজ-ডাব, আপেল-আঙুর ইত্যাদি যা কিছু পাওয়া যায় সবই এখানটায়। দ্বীপের অন্য প্রান্তে বড়জোর চা-পান আর শামুক-ঝিনুকের দোকান মিলতে পারে। দ্বীপবাসী জেলে বলেই বোধ হয় গোটা দু’তিন বয়ার দোকানও আছে বাজারে। তবে সব দোকানেই গলাকাটা দাম সেন্টমার্টিনে। ১৫ বছর ধরে সেন্টমার্টিনে মুদি দোকানের ম্যানেজারি করেন রশীদ মিয়া। তার দোকানে দু’টি মোরগ রাখা। প্রতিটির ওজন দু’কেজি করে। তবে এই দুই মোরগ বিক্রির জন্য নয়।
কক্সবাজারের ছেলে রুবেল হোসেন এখানে আছে ৫ মাস। মাঝারি সাইজের টুনা মাছ ভাজি বিক্রি করছে ৭০ টাকা পিস দরে। এখানকার বাজারের সব সদাই টেকনাফ থেকে আনতে হয়। দ্বীপের জমিতে কিছু ফসল ফলে বটে, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা একেবারেই অপ্রতুল। আছে ফুটবল, হ্যাট, সানগ্লাস আর ছাতার দোকানও। একটি দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা ‘যুগপযোগী পানের সম্রাট’। ঢাকা শহরের বিভিন্ন মহল্লা আর কক্সবাজারের ঝাউতলার মতো আল্লাহর দান নামে একটি হোটেল এখানেও চোখে পড়লো।
দক্ষিণপাড়া আর ছেঁড়াদ্বীপের মধ্যবর্তী সাগর থেকে মাছ ধরে সবে বাজারে এসে বসেছেন ওমর ফারুক নামে এক যুবক। দেড়শ’ টাকায় সুন্দরী ও টোনা এবং ১০০ টাকায় চান্দা আর পোয়া মাছ বিক্রি করছেন তিনি। চিংড়ি মাছ বিক্রি করছেন ৪০০ আর ৬০০ টাকা কেজি দরে। তার পাশেই স্থানীয় ঢেঁড়স বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫০ টাকায়।
উত্তরপাড়া ছাড়িয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের রেস্ট হাউসে যাওয়ার পথে হাতে বাঁয়ে এই দ্বীপের সবচে’ বড় মিঠা পানির পুকুর। লম্বায় দেড়শ’ ফুট হবে। ঘোলা হাঁটুজলে ভাসছে সবুজ কচুরিপানা। আর একটু সামনে হাতের ডানে ছোট্ট পুকুড়ের পাড় গাঁথা প্রবাল পাথরে পাথরে। পথের দু’পাশের নারিকেল বন আর বাঁশঝাড়ে শা শা বাতাস। অপরূপ প্রকৃতির কারণে দ্বীপটিকে বলা হয় বাংলাদেশের স্বর্গ। এই দ্বীপই দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ।
ঠিক কবে এই দ্বীপে প্রথম মানুষের পা পড়েছিলো তা সুনির্দিষ্ট করা যায় না। তবে জানা যায়, শত শত বছর আগে থেকেই পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগর আর চীন সাগর তীববর্তী দেশগুলো পেরিয়ে আরব বণিকরা আসতো বাংলাদেশের চট্টগ্রাম আর বার্মার আকিয়াব বন্দরে। বিশ্রাম নেওয়ার জন্য তারা নামতো এই প্রবাল দ্বীপে। তারা এই দ্বীপটির নামকরণ করে জিঞ্জিরা। ১৮৯০ সালে কিছু বাঙালি আর রাখাইন জেলে এসে বসতি গাঁড়ে এখানে। প্রথমে আসে মাত্র ১৩ পরিবার। তারা বেছে নেয় দ্বীপের উত্তরাংশ। পরে যা পরিচিতি পায় উত্তরপাড়া নামে। এরপর অনেক দিন এই উত্তর পাড়াতেই সীমাবদ্ধ থাকে দ্বীপের বসতি। সময়ের পরিক্রমায় দ্বীপটি পরিণত হয় বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায়।
আগে থেকেই ঝাউ আর কেয়া ঝোপ ছিলো এ দ্বীপে। মিঠার প্রয়োজনে পরে নারিকেল গাছ রোপণ করে জেলেরা। কালক্রমে পুরো দ্বীপটি নারিকেল প্রধান হয়ে পড়ে। দ্বীপের নাম হয়ে যায় নারিকেল জিঞ্জিরা। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ব্রিটিশ ভূ-জররিপ দল তাদের এক সাধুর নামে দ্বীপটির নাম রাখে সেন্টমার্টিন।
আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা নির্ধারণে বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক আদালতের রায় পাওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এই সেন্টমার্টিনই। সেন্টমার্টিনকে বাংলার উপকূল রেখায় ধরে এখান থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল এলাকাকে বাংলাদেশের সার্বভৌম সমুদ্রসীমা হিসেবে ঘোষণা করেছে ট্রাইব্যুনাল। ফলে চার হাজার বর্গকিলোমিটারেরও বেশি সার্বভৌম সমুদ্র পেয়েছে বাংলাদেশ। এরপর আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পেয়েছে আরো ২০০ নটিক্যাল মাইল বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ পেয়েছে বঙ্গোপসাগরের ১ লক্ষ ১১ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার কর্তৃত্ব। এই সেন্টমার্টিনের আয়তন কিন্তু মাত্র ৮ বর্গকিলোমিটার।
বাংলাদেশ সময়: ২১৪৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৭, ২০১৬
জেডএম/
** সেন্টমার্টিন যেভাবে যাবেন
** সমুদ্র আর সৈকতই ভরসা পর্যটন নগরীর
** দূর থেকে ভাসমান, কাছে গেলেই দৃশ্যমান ছেঁড়া দ্বীপ
**সৈকতের আল্পনাশিল্পীদের করুণ মৃত্যুগাথা
** রানওয়েতে কুকুর, বড় দুর্ঘটনার শঙ্কা
** ‘বাবা, গোয়া সৈকতের সঙ্গে যে দারুণ মিল’
** সূর্য ডোবে সাগরে
** নোনা দ্বীপে মিষ্টি পানি
** ছেঁড়া দ্বীপের মৌসুমী!
** পরিত্যক্ত অবস্থায় ছেঁড়া দ্বীপের একমাত্র মসজিদ
** সেন্টমার্টিনে বাজার সদাইয়ের সংগ্রাম (ভিডিওসহ)
** কক্সবাজারে বাংলানিউজের দ্বিতীয় টিম
** ১৮ কোটি টাকার মেরিন পার্ক ১০ বছরেই ‘মৃত’
** সেন্টমার্টিনে সৈকত জুড়ে কাঁকড়ার আল্পনা
** পঁচা মাছে নষ্ট হচ্ছে সেন্টমার্টিনের সৌন্দর্য
** সেন্টমার্টিন হারিয়ে যাবে!
** ডাব-তরমুজেই পকেট ফাঁকা সেন্টমার্টিনে
** আতঙ্ক আর আনন্দ একযোগে ভর করলো সাগরে
** কেয়া আর নারকেল গাছ সেন্টমার্টিনকে করেছে অপরূপা
** প্রবাল পাথরের ভাঁজে ভাঁজে মাছের খেলা
** সেন্টমার্টিনের বাহন ‘ভ্যানগাড়ি’
** বয়া ছাড়াই জাহাজ চলছে টেকনাফ-সেন্টমার্টিনে
** ‘লাইফ লাইনে গণ্ডগোল’
** খেলায়-হেলায় সমুদ্র সৈকতকে আঘাত
** বাংলানিউজ, ওয়েলকাম টু কক্সবাজার
** কেয়ারি সিন্দবাদে দোল খেতে খেতে সেন্টমার্টিন
** ১২ মাস কক্সবাজারকে ব্যস্ত রাখতে চায় মারমেইড
** তৈরি হচ্ছে ‘বিচ ডাটাবেজ’
** ড্যান্সিং বাসে কক্সবাজার টু টেকনাফ
** ‘পর্যটন মৌসুম শব্দটি বিলীন হয়ে যাচ্ছে’
** তথ্যহীন পর্যটন তথ্য কেন্দ্র!
** ঘোড়া চলে ঘুষ দিয়ে !
** সৈকতের প্রহরী, সাগরের যোদ্ধা
** হাওয়া অফিস খাঁ খাঁ, ঐতিহ্যের শরীরে টাইলস আগ্রাসন
** লাবনী-সুগন্ধা নয়, পুরো সৈকতে উপযোগী পরিবেশ দরকার
** বয়সটা কম, তবুও কাঁধটা ‘বড়’ তাদের..
** প্রশাসনের ছত্রছায়ায় চলছে ঝুঁকিপূর্ণ ‘জেট স্কি’
** অব্যবস্থাপনায় সৌন্দর্য হারাচ্ছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত
** উত্তাল সাগর, উপচে পড়া রূপ
** কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন-সুন্দরবন ঘিরে নানা পরিকল্পনা
** নতুন পরিকল্পনায় সাজছে কক্সবাজার
** আখেরি স্টেশন দোহাজারী, কক্সবাজারে রেল কবে?
** মেঘের সাগরে আয়েসি উড়াল
** বছরজুড়ে দেশ ঘুরে: কক্সবাজারে বাংলানিউজ