সেন্টমার্টিন থেকে ফিরে: আগে কখনও সেন্টমার্টিন দ্বীপে যাওয়া হয়নি। গল্প শুনে এবং খবর পড়ে সেন্টমার্টিনের একটি ছবি মানসপটে গেঁথে ছিল।
৬ এপ্রিল (বুধবার) আমাদের বহনকারী জাহাজটি তখন সেন্টমার্টিন কাছাকাছি। দূর থেকে দু’চোখ ভরে দেখছিলাম সেই অপরূপ সৌন্দর্য। সারি সারি নারিকেল গাছ, কিছু কেওড়া ও ঝাউগাছ। নীলাভ পানি মনকে উদ্বেলিত করে তুলছিল। জাহাজের অনেকেই তখন মোবাইলে ছবি তোলায় ব্যস্ত।
যতই তীরের দিকে কাছাকাছি আসছিলাম ততোই মুগ্ধ হচ্ছিলাম। ভাটার টান থাকায় সৈকতটিও তখন অনেক বিস্তৃত। আর শুকনো বালির ওপর সূর্যের আলো অন্যরকম ভালোলাগায় শিহরিত করছিলো।
নীল শীতল জলে পা ভেজানোর তর সইছিলো না। কিন্তু এখানে কিছুটা বিপত্তি দেখা দিল। সরাসরি জেটিতে নামার কোনোই সুযোগ নেই। দু’শ গজ দূরে জেটির সিড়িতে যেতে হবে ট্রলারে করে।
ট্রলারে ওঠাও এক রকমের যুদ্ধই বলা চলে। জাহাজের গায়ে লাগানো ট্রলারটি বিশাল বিশাল ঢেউয়ের ধাক্কায় সব সময়েই দুলছিল দোলনার মতো। জনা তিনেক ব্যক্তি মোটা নাইলনের রশি দিয়ে প্যাঁচ দিয়েও দুলুনি থামাতে পারছিল না।
এ রকম জেটি আর কোথাও দেখিনি। মাঝনদীতে গিয়ে আটকে থাকা ব্রিজের মতো। এক মাথা ডাঙায়, আরেক মাথা সাগরের পানিতে গিয়ে শেষ হয়েছে। অসমাপ্ত ব্রিজের মাঝনদীতে কিছুই থাকে না। কিন্তু এখানে শেষ মাথায় চারিদিকে কংক্রিটের রেলিং দেওয়া।
আর তীর থেকে সাগর পর্যন্ত যেতে দু’টি পয়েন্টে ঢালু পথ গিয়ে মিশেছে পানির সঙ্গে। যখন সে লেভেলে পানি থাকে তখন সেই ওয়ার্ক ওয়েতে গিয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করে ট্রলারগুলো।
ট্রলারগুলোতে ওঠা-নামাটা করতেও সীমানা প্রাচীর ডিঙানোর মতোই কসরত প্রদর্শন করতে হয়। কারণ ট্রলারগুলির গলই থেকে পাটাতন কমপক্ষে ৫ ফুটের মতো নিচুতে। দাঁড়ানো যাত্রীর পুরো শরীর গিলে খায় ট্রলারগুলো। দূর থেকে শুধু মাথাই দেখা যাবে, যদি আপনি প্রমাণিত উচ্চতার অধিকারী হন।
ভয়ঙ্কর কসরত করে নামতে হলো ডাঙায়। কারো সাহায্য ছাড়া নতুন কারো পক্ষে এতে ওঠা-নামা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। মাঝির হাত ধরেই একে একে ওয়ার্ক ওয়েতে নামছিলেন যাত্রীরা। স্থানীয়রা অবশ্য ব্যাঙের মতো হাতে ভর দিয়ে লাফিয়ে নামছিলেন।
কেউ একজন নামতে বিলম্ব হচ্ছিল। ট্রলারের কর্তা যুবক বিরক্তি প্রকাশ করে বলে ওঠেন, তাড়াতাড়ি করেন। ট্রলারে লোকজন যখন নামছিলেন, জাহাজটি তখন জেটির শেষ মাথায় নোঙর করা। জাহাজ ও জেটির মধ্যে ব্যবধান ৩ ফুট। জাহাজ যেন জেটিতে ধাক্কা দিতে না পারে সেজন্য জেটির পাশে বিদ্যুতের খুঁটির মতো মোটা গাছ দিয়ে বেড়া তৈরি করা হয়েছে।
একদিকে যেমন ব্যবধান রয়েছে। অন্যদিকে জাহাজের ডেক থেকে প্রায় ৭ ফুট উঁচুতে জেটি। কেউ কেউ ট্রলারের অপেক্ষায় না থেকে গাছের গুড়ির বেড়ায় ভর দিয়ে ঝুঁকি নিয়েই জেটিতে পা রাখছিলেন। একজনের দেখাদেখি অন্যরাও সাহসিকতা দেখাতে সেদিক দিয়েই নামছিলেন।
অনেক কসরত করে জেটিতে নামার পর মনের মধ্যে প্রশান্তির আবহ ছড়িয়ে যাবে। পূর্বে যতদূর চোখ যায়, শুধু নীল পানি আর পানি। পশ্চিমে মানসপটে আঁকা সেন্টমার্টিন দ্বীপ। যাকে অনেকে আদর করে নারিকেল জিনজিরা বলে ডাকেন। যাত্রাসঙ্গী অনেকেই তখন সেলফি তোলায় ব্যস্ত। কেউ কেউ আবার উপদলে ভাগ হয়ে গ্রুপ ছবি তুলছিলেন।
পেছন থেকে সহকর্মী মবিনুল ইসলাম তাড়া দিলেন, চলেন দ্রুত রুমে যাই, ব্যাগেজ রেখে বেরিয়ে পড়তে হবে। কথা ছিল বিকেলে ছেঁড়া দ্বীপ যাওয়ার। সে কথাও মনে করিয়ে দিলেন। জেটি থেকে লম্বা একটি ফুটব্রিজ পশ্চিমে সেন্টমার্টিন বাজারের প্রধান সড়কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
জেটি ধরেই হাঁটছিলাম, তখন পর্যন্ত মানসপটে আঁকা সেন্টমার্টিন হুবহু মিলে যাচ্ছিল। সবকিছুই ছবির মতো মনে হচ্ছিল। কিন্তু বাজারের কাছাকাছি আসতেই প্রথম নজরে আসে ময়লার ভাগাড়। পেছনে থাকা কয়েকজন বিদেশি পর্যটকের দিকে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম তাদের অভিব্যক্তি কেমন। মনে মনে লজ্জাও পাচ্ছিলাম, এরা দেশে ফিরে গিয়ে কী বলবে বাংলাদেশ সম্পর্কে!
বাজারের প্রবেশদ্বারে হাতের বামে প্রথমেই পড়বে টিকিট কাউন্টার ও যাত্রী ছাউনী। টং ঘর টাইপের কক্ষটি কংক্রিটের পিলার দিয়ে নির্মিত। নিচের ফাঁকা স্থানে পুরোপুরি ময়লার ভাগাড়। সেই ময়লা ছড়িয়ে রয়েছে অনেকদূর পর্যন্ত। বিস্কুট ও পলিথিনের কাগজের ময়লাই বেশি দেখা গেল। দেখা গেল বাজারের বর্জ্যও।
স্বপ্নভঙ্গের শুরু যেন এখান থেকেই। এরপর যতই পা বাড়াচ্ছিলাম, ততই যন্ত্রণা বাড়ছিল আট বর্গ কিলোমিটারের এ দ্বীপটি ঘিরে।
সেন্টমার্টিনকে জানতে পড়ুন- ‘সেন্টমার্টিন দেখতে কেমন (পর্ব-২)’
চলবে...
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৮, ২০১৬
এসআই/এসএইচ
** কুকুর যখন ‘টুনা’ শিকারি
** ‘পর্যটন মৌসুম শব্দটি বিলীন হয়ে যাচ্ছে’
** তৈরি হচ্ছে ‘বিচ ডাটাবেজ’
** সেন্টমার্টিনে সৈকত জুড়ে কাঁকড়ার আল্পনা
** সেন্টমার্টিনে বাজার সদাইয়ের সংগ্রাম (ভিডিওসহ)
** সৈকতের আল্পনাশিল্পীদের করুণ মৃত্যুগাথা
** সেন্টমার্টিন যেভাবে যাবেন
** তৃতীয় ধাপে চট্টগ্রাম টিম এখন কক্সবাজারে
** কক্সবাজারে বাংলানিউজের দ্বিতীয় টিম
** বছরজুড়ে দেশ ঘুরে: কক্সবাজারে বাংলানিউজ