মহেশখালী ঘুরে: গভীর সাগরে রাতভর মাছ ধরে ফিরে আসছে জেলেনৌকাগুলো। আদিনাথ জেটির ওপরে খলুইয়ের ভেতরে তাদেরই ধরা লাক্ষ্যা, পোয়া, চাপিলা, আইড়সহ চেনা-অচেনা সামুদ্রিক মাছের রকমারি পসরা।
ছোট মহেশখালীর সুজন কান্তি দে ব্যাটারিচালিক অটোরিকশা নিয়ে হাজির জেটির ল্যান্ডিংয়ে। মৌসুম না হওয়ায় পর্যটকদের জন্য হাহাকার তার কণ্ঠে। দিনে একটা ট্রিপ পেলেই খুশি এখন।
প্রায় ৭শ মিটার লম্বা জেটিটার দু’পাশে যে বিস্তৃত কেওড়া বন তার মধ্যে জায়গায় জায়গায় অর্ধ বৃত্তাকারে গোলপাতার বাগান। পরীক্ষামূলকভাবে এখানে এই গোলপাতা বন গড়ার উদ্যোগ। গাছগুলোর এখনও শৈশব চলছে। পরিণত গোলপাতা গাছের যে পরিচিত চেহারা তা এখনো পরিস্ফুট হয়নি অবয়বে। তবে শেষ পর্যন্ত এ উদ্যোগ টিকে গেলে উপকূলজুড়ে ছেয়ে যেতে পারে সুন্দরবনের এই আইকন বৃক্ষ। অনেকটা হাতপাখার আদলে বিরাজমান গোলপাতা গাছ উপকূলের মাটি রক্ষায় যেমন কার্যকর, তেমনি ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে লড়াই করতেও সক্ষম।
জেটি পেরিয়ে হাতের বাঁয়ে গোটা কয়েক পানের বরজ। একই মাচায় নিচে পান আর উপরে লাউ চাষ করেছেন চাষিরা। ফুট ছয়েক উঁচু মাচার অর্ধেকটায় পেঁচিয়ে উঠেছে পানের লতা। এই লতা পেঁচিয়ে উঠবে বাঁশের কঞ্চির ডগা পর্যন্ত। তারপর ফের ঘুরিয়ে নিম্নমুখী করা হবে সেগুলোকে। এভাবে বছরভর বাড়তেই থাকবে পানের লতা। একটা লতায় বছরে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার পর্যন্ত পান পাওয়া যায় বলে জানালেন পানচাষি সমর দাশ ও কাজল দে। তারা বললেন, এগুলো মিষ্টি পান। বৃষ্টি হলেই সব পান পচে যাবে। সামনে বরষা বলে পানের চাষ কমে এসেছে।
সারি সারি পানলতার ভেতরে সরু সরু পথ অসাধারণ দৃশ্যের অবতারণা করেছে। মাচার ফাঁক গলে পান বরজে অদ্ভূত সুন্দর রোদ রেখার খেলা। মাটিতে সোঁদা গন্ধ। মাটি, তবু পানের বরজে খালি পায়েই প্রবেশ করলেন সমর আর কাজল। পায়ের চটি খুলে রাখলেন বরজে ঢোকার দরজার ওপাশে। তাদের কাছে পানের বরজ যেনো প্রার্থনা গৃহ।
এমন ভক্তি দেখে এই পান চিবুনোর জন্য মনটা আনচান করে উঠলো।
পরে বড় রাখাইনপাড়া বৌদ্ধ বিহার এলাকায় মহেশখালীর মিষ্টি পান খাওয়ালো কিশোর দোকানি মিলন দে। সঙ্গে জাগ দেওয়া সুপারি। মুহূর্তে রসে ভরে গেলো মুখ। যেমন মিঠা রস, তেমনি অতুলনীয় তার স্বাদ। অন্য যেকোনো অঞ্চলের চেয়ে এই পানের স্বাদ যে একেবারেই আলাদা সেটা বুঝিয়ে বলতে হবে না। আর যে কখনও এই পান খায়নি তার পক্ষে এর স্বাদ কল্পনা করাও সম্ভব নয়।
পান খেয়ে মনে পড়লো কালজয়ী সেই গানটির কথা। জননন্দিত কণ্ঠশিল্পী শেফালী ঘোষ গেয়েছিলেন, ‘বক্সির হাটের পানের খিলি তারে বানাই খাবাইতাম’ গানটি। পরে ‘বক্সির হাট’ এর বদলে ‘মহেশখালী’ শব্দটি বসিয়ে সাম্পানওয়ালা সিনেমায় গানটি ব্যবহার করেন আজিজুর রহমান। ফলে গানটি ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে।
প্রধাণত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং উপসাগরীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানুষ পান খায়। দক্ষিণ এশিয়ার অধিবাসীদের পান খাওয়ার অভ্যেস হাজার বছর আগের। মিথ বলছে, দেব চিকিৎসক ধন্বন্তরীর সহায়তায় আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকরা এটি আবিষ্কার করেন। কৃষ্ণেরও ছিলো পান খাওয়ার অভ্যাস। ভারতবর্ষের রাজা, সম্রাটদের অন্দরমহলেও ছিলো পানের প্রচলন। জাহাঙ্গীরের প্রিয়তমা স্ত্রী নুরজাহানের পান খাওয়ার অভ্যাস ছিলো।
বাংলার সুবেদার আশিম উশ শান পান চাষকে ‘সাউদিয়া খাস’ নামে একচেটিয়া রাজকীয় ব্যবসায় পরিণত করেন। ব্যবসাসফল পণ্য হওয়ায় এই পানের ওপর নজর পড়ে ব্রিটিশ বেনিয়াদের। বাংলার গভর্নর লর্ড ক্লাইভ পানকে পরিণত করেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসায়।
বাংলাদেশে এই পান সামাজিক শিষ্ঠাচার, লোকজ সংস্কৃতি আর অতিথি আপ্যায়নের উপাদান। এখনও পান ছাড়া বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সারা হয় না বাংলায়।
সার্বজনীন সংস্কৃতির এই উপাদান সাহিত্য আর সিনেমাতেও উঠে এসেছে অনেক বিশদভাবে। মধ্যযুগীয় কবি আলাওল তার পুঁথি সাহিত্যে পানের বর্ণনায় বলেছেন, ‘অধর রাতুর কৈল তাম্বুল রসে’। রাতুল অর্থ হলো লাল, আর পানের আরেক নাম তাম্বুল। পানের পিকের তামাটে রঙের দিকে খেয়াল রেখে সংস্কৃত তাম্র থেকে তাম্বুল শব্দটি এসেছে। তাই সংস্তৃত ভাষায় পানকে তাম্বুল বলা হয়। পরে আর্য ও আরবরা এই তাম্বুল শব্দটির ব্যাপক ব্যবহার করেন।
‘তবক দেওয়া পান’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থও রয়েছে রসিক কবি আসাদ চৌধুরীর। তবে ডন সিনেমায় অমিতাভ বচ্চনের লিপসিংয়ে ‘খাইকে পান বানারাস ওয়াল, খুল যায়ে বান্ধ আকাল তালা’ গানটি পান নিয়ে গাওয়া সব গানের রেকর্ড ভঙ্গ করে।
হিন্দু শাস্ত্রমতে- সুপারি, খয়ের ও চুন এক সঙ্গে হলে তাকে তাম্বুল বলা হয়। একসময় হিন্দু বিধবাদের জন্য পান নিষিদ্ধ ছিলো। যেহেতু পান আনন্দের প্রতীক, তাই বিধবারা পান চিবানোর অনুমতি পেতেন না।
নিঃশ্বাস সুরভিত হওয়ার পাশাপাশি জিভ-ঠোঁট রঙিন হয় পানে। সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে মাদকতা। পানের রসে প্রচুর মাত্রায় ক্লোরোফিল থাকে। তাই এটা ওষুধের মতো কাজ করে থাকে। সুপারি দিয়ে পান চিবানো অনেক ভালো। পানের রস স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। দাঁতের অ্যান্টিসেপটিক হিসেবে কাজ করে। পান সুপারি দাঁতের ক্ষয় রোধ করে। মুখের দুর্গন্ধ দূর করে। কর্মক্ষমতা বাড়ায়। কৃমিনাশক হিসেবে কাজ করে। হজম শক্তি বাড়ায়।
পান চাষ মহেশখালীর অতি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী পেশা। বর্তমানে সারা দেশের দুই-তৃতীয়াংশ মিষ্টি পান মহেশখালীতে হয়ে থাকে।
উপজেলার ছোট মহেশখালী, বড় মহেশখালী, হোয়ানক, কালামারছড়া, শাপলাপুর ইউনিয়নে যুগ যুগ ধরে পান চাষ হয়ে আসছে।
বাংলাদেশ সময়: ২২০৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০১৬
জেডএম/এসএনএস