দ্বিতীয়ার চাঁদখানি সাধারণ সমতল ভূমির চেয়ে খানিকটা উপরের আকাশে স্বর্ণালী আভা ছড়িয়ে ঝুলে আছে। চারিদিকে হালকা আঁধার।
সঙ্গী সহকর্মী মবিনুল ইসলাম বললেন, ‘দেখে মনে হচ্ছে চাঁদটিও যেনো এই মারমেইডের অংশ’।
চাঁদতো সবারই। কিন্তু গত ৯ এপ্রিলের সন্ধ্যা আকাশে ফুটে ওঠা দ্বিতীয়ার চাঁদটির সোনারঙ মারমেইডের রাতের রঙের সঙ্গে মিলে গিয়েছিলো। ফলে বলাই চলে চাঁদটি বুঝি এই বিচ রিসোর্টের নিজস্ব।
কতটা মুগ্ধ হলে এমন কথা বলা চলে!
এই মারমেইডে আপনি যখন ঢুুকবেন তার আগেই কক্সবাজারের সৌন্দর্য্য আপনাকে দখল করে নেবে। একদিকে পাহাড় রেখে সাগরের তীর ধরে, ঢেউয়ের আছড়ে পড়া দেখতে দেখতে কে না প্রকৃতির হাতে বন্দি হতে ভালোবাসে! এই সড়ক ধরে যেতে যেতে হঠাৎ যখন আপনার বাহনটি ডান দিকে মোচড় নিয়ে সবুজে ঢাকা একটি পথ খুঁজে নেবে, তখন প্রথমেই মনে হবে ছায়া সুনিবিড় শান্তির কোনও নীরে এসেছেন।
প্রথমেই ডাবের আপ্যায়ণে এখানকার মানুষগুলো আপনাকে গ্রীস্ম-দুপুরের সেরা প্রশান্তিটুকু এনে দেবে। দখিণ হাওয়া ঝাপটা দিয়ে গা জুড়ায়ে দিলে বলবেন- আহা!
এমন মধুর-মাতাল হাওয়া সাগর তীরের না হয়ে যায় না। আর তাই চোখ তুলতেই দেখবেন অদূরে অপার সমূদ্র।
মাথার ওপর ছনের আচ্ছাদন, চারিদিক খোলামেলা ঘরটিকে কুঁড়েঘর বলা যাবে না। মাঝখানে টেবিল পাতা লম্বা করে। তার চারিদিকে সাজানো চেয়ার আপনাকে বলেই দেবে কোনও এক বড় আন্তর্জাতিক মানের ডাইনিং হলেই আপনি বসে আছেন। এটা মারমেইড বিচ রিসোর্টের ডাইনিং স্পেসগুলোর একটি।
পাশেই রান্না ঘরটি ছনের ছাউনিঢাকা পথ দিয়ে আলাদা। সেপথ ধরেই খাবার আসে। খাবার মানে দেশি খাদ্য। মাছ মুরগী ভর্তা ডাল। আর কক্সবাজারের সেরা রূপচাঁদা ও শুটকি। স্বাদ ও মানে সেরা বলতেই হবে। খেয়ে কিংবা খাবার আগেই আপনি চাইলে একবার সবুজ ঘাঁষ আর কোথাও বালুমাটির মধ্য দিয়ে এগিয়ে নেওয়া কংক্রিটের পথ ধরে এগুলে পেয়ে যাবেন আরেকটি বড় ঘর। চারিদিকে কোনও বেড়া নেই মাথার ওপর একই ছনের ছাউনি। তাতে আরাম বড়। এটি সম্মেলন কক্ষ। এখানে অনেক টেয়ার টেবিল পাতা। সাধারণ তবে সুসজ্জিত। এখানে এই রিসোর্টে আয়োজিত অনুষ্ঠানাদি হয়।
৯ এপ্রিল ছিলো বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম’র আয়োজনে কক্সবাজারে পর্যটন শিরোনামে বিশেষ আলোচনা। যাতে পর্যটনমন্ত্রীরও ছিলো মুগ্ধ উপস্থিতি। সেই আলোচনাই যখন শেষ হলো তখন সমুদ্রের বুকে ডুবলো জ্বলজ্বলে দিনের সূর্য আর খানিক পরেই দেখা গেলো দ্বিতীয়ার চাঁদ। বাংলানিউজ টিমকে ততক্ষণে মারমেইড কতটা আপন করে নিয়েছে তা টের পাওয়া গেলো সহকর্মী মবিনুল ইসলামের ওই মন্তব্যে।
আসলে প্রকৃতিকে নিজের করে নিয়েই গড়ে ওঠা একটি বিচ রিসোর্ট এই মারমেইড। কিছুটা দূরে গিয়ে দৃষ্টিসীমায় রেখে মারমেইডকে দেখলে মনেই হবে না এখানে কোনও স্থাপনা রয়েছে। দূর থেকে সবচেয়ে বড় করে চোখে পড়বে একটি মহাজাগতিক কচ্ছপ যেটি নাকি সবুজ পৃথিবীতে ভ্রমণে এসেছে।
মারমেইড বিচ রিসোর্টে শিল্পী রনি আহমেদের তৈরি এটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় কচ্ছপমূর্তি। যা হয়তো গিনেসবুক অব ওয়ার্ল্ডে স্থান পেতে যাচ্ছে। কিন্তু শুধু কসমিক টার্টল নিয়ে কথা বলতে নয়, সব মিলিয়ে মুগ্ধ করে দেওয়া একটি বিচ রিসোর্ট মারমেইড নিয়ে বলাই এই লেখার উদ্দেশ্য। কচ্ছপ যার অবিচ্ছেদ্য অংশ। কারণ সেই কচ্ছপের পেটেও রয়েছে একটি বড় মিটিং রুম। যেখনে শ’খানেক মানুষ বসে মিটিং করতে পারবে।
সন্ধ্যার পরের মারমেইড আসলে দেখার মতোই শুধু নয় উপলব্দি করার মতো কিছু একটা হয়ে ওঠে। এটি ১৫ একর এলাকাজুড়ে তৈরি রিসোর্ট যাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কতগুলো ভিলা। দেখে মনে হবে একেকটা পাতার কুটির।
এখানে প্রকৃতিতে- এলোমেলো হাওয়া বয়, সারাবেলা কথা কয়। গাছের পাতার ফাঁক গলিয়ে চেয়ে থাকে আকাশ। চাঁদখানি হয়ে থাকে নিকট কুটুম।
মারমেইডের ম্যানেজার মাহফুজুর রহমান বলছিলেন, ভরা পূর্ণীমায় সেকি সুন্দর! সে কি সুন্দর!
দ্বিতীয়ার চাঁদেই যার সৌন্দর্য্য ধরা পড়ে পূর্ণীমায় তা যে শত বাহার ছড়াবে সে আর ভিন্ন কি?
কূটিরগুলো বাইরে থেকে যেমন অতি গ্রাম। ভেতরে গেলেই তেমন অতি আধুনিক। উন্নত বিশ্বমানের হোটেল কক্ষ। আয়োজনে, সুবিধায় এতটুকু কমতি নেই একেকটি ভিলায়। কিন্তু ভেতরেও এখানে ওখানে পাবেন বাংলাদেশকে। বাল্বটির ওপর বসিয়ে রাখা হয়েছে চালুনি। যার হাজার ফাঁক গলিয়ে যে মৃদুআলো ঠিকরায় তা আপনাকে স্বস্তি বিলোতেই থাকবে।
হঠাৎ কানে আসবে সাইকেলের ঘন্টির টুং টুং শব্দ। ভাববেন এখানে সাইকেলে চেপে এলো বুঝি কেউ। গ্রামের কোনও বাড়িতে কেউ এলে যেমন সাইকেলের ঘন্টি বাজায়। মারমেইডে এটাই আসলে কলিং বেল।
এমন অদ্ভুত, অভিনব শত-শত আইডিয়ায় ভরা মারমেইড। ঘরের বাইরে বাঁশের খোলের ভেতর লুকিয়ে থাকা পানির কল। সামনে চারি পাতা। তাতে ধরে রাখা পানিতে ভাসছে জবা, চাঁপা কিংবা শতাবতী ফুলের দল। পায়ে ঢালার পানিতেই এত আয়োজন।
দরজা খুললেই সমুদ্র সৈকত। আপনার চোখের জন্য এত আরামের আর কি হতে পারে। মনের জন্য ভালো করে দেওয়ার উপদান চারিদিকে এত এত ছড়িয়ে। ঘর থেকে বের হবে দোলনায় দোল খান, একটু এগিয়ে গিয়ে সাগরের আরও কাছাকাছি গিয়ে বসে পড়ুন খাটিয়ায় পাতা বিছানার ওপর কিংবা আরও এগিয়ে বিচ চেয়ারতো রয়েছেই।
এখানে এতটুকু পথেও কত বৈচিত্র, কতইনা সৌন্দর্য। ঝুলে থাকা ঝুমকো জবার পাঁপড়ি আপনার মাথার চুলে জড়িয়ে যাবে। কাঁঠাল চাঁপা নাকে গন্ধ বিলিয়ে বলবে, সমুদ্রে তীরে যাও ক্ষতি নেই। এখানেও থাকতে পারো... সুন্দরের পসরা আমরাও সাজিয়েছি যে!
সাগরের সৌন্দর্য আর মারমেইডের প্রকৃতিমাখা আয়োজন উপভোগ করতে করতে আপনি রাত কাটিয়ে দিতে পারবেন। আর যদি কোনও কারণে আপনাকে টেনে নেয় বিছানা, তাহলে সেও দেবে পাঁচ তারকা হোটেলের আরাম।
মারমেইডের এই আয়োজনের মূল যিনি তিনি আনিসুল হক চৌধুরী। প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজিং ডিরেক্টর। অতি সাধারণ ভাব ভঙ্গিমার এক যুবক। তরুণ বললেই সবচেয়ে সঠিক বলা হবে। আর তরুণ উদ্যোক্তা বললে কম বলা হবে। একজন সাহসী উদ্ভাবনী চিন্তাশক্তির তরুণ বলাটাই হবে সঠিক।
খুব সাধারণ ভঙ্গিমাতেই বলছিলেন, একটা স্বপ্ন শুরুর কথা। মারমেইড বিচ রিসোর্ট মূলত মারমেইড আর্ট ফাউন্ডেশনের একটি প্রতিষ্ঠান। এই ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু হয় কক্সবাজার সৈকত শহরে শিল্পীদের তুলির ছোঁয়ায়, হাতের কাজে একটি শৈল্পিক দৃশ্যপট তৈরি করার উদ্দেশ্য নিয়ে। আর তারই ধারাবাহিকতায় এই মারমেইড বিচ রিসোর্ট। প্রথমই তৈরি হয় সমুদ্র পারে মারমেইড ক্যাফে। এছাড়াও এখানেই তৈরি হয়েছে দেশের প্রথম বিচ আর্ট গ্যালারি আর মারমেইড ইকো রিসোর্ট।
বাংলাদেশি চিত্রকলা মননে ধারণ করে এই সবকিছু সাজানোর মূল কারিগর চিত্রশিল্পী রনি আহমেদ। তার হাতে তৈরি হয়ে মারমেইডে রয়েছে সমুদ্রের কচ্ছপ, ঝিনুক, শামুকেরা কোনও না কোনও বস্তু স্থাপনা বা ইনস্টলেশনের রূপ নিয়ে।
আর মৎস্যকন্যাদের দেখা পাওয়া যাবে টেবিল চেয়ারের কাঠামোয়, দেয়ালে দরজায়। হলফ করে বলতে পারি- মৎস্যকন্যার প্রেম আপনাকে টানবেই!
বাংলাদেশ সময় ১১৩৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০১৬
এমএমকে