মহেশখালী ঘুরে: ফুলে উঠেছে বয়সের ভারে কুঁচকে যাওয়া গাল। ছোট্ট ফুঁ গগণবিদারী আওয়াজ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সরু থেকে ক্রমশ প্রশস্ত হয়ে ওঠা শিঙ্গার মুখ থেকে।
বাড়ি তার মহেশখালী চ্যানেলের পূর্ব পাড়ে, চকোরিয়ায়। সেই শিব চতুর্দশীতে (ফালগুনের মাঝামাঝি) এসেছেন এখানে। তারপর রয়েই গেছেন মৈনাক পাহাড়ের মাথায়। তার মাথার ওপরে ছায়া দিচ্ছে বিরল প্রজাতির এক পারিজাত গাছ। এটিকে দেবরাজ ইন্দ্রের রাজসভার ফুলগাছ বলে বিশ্বাস করেন ভক্তরা। গাছের ডালে ডালে ঝুলছে নানা ধর্মমতের মানুষের বেঁধে যাওয়া মানতের সুতো।
ঠিক পেছনেই নকশাকাটা কাঠের দরোজা আর টাইলসে মোড়ানো ঝকঝকে এক মসজিদ। মসজিদের উত্তর-পূর্ব কোণায় আর একটু উঁচু চত্বরে ঐতিহাসিক সেই আদিনাথ মন্দির। ভিন্ন ধর্মের এ দুই উপাসনালয় ছাড়াও বৌদ্ধ মঠও রয়েছে এই পাহাড়ের চূড়ায়। একটি উপাসনালয় আর একটির এতোটা কাছে যে, উচ্চস্বরে প্রার্থনার শব্দ নির্বিরোধে চলে যায় এক গৃহ থেকে আর এক গৃহে।
সব মিলিয়ে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান আর রাখাইন সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে এখানে। অসাম্প্রদায়িকতার এমন অনন্য নজির আর কোথায় কেইবা কখন দেখেছে? মানবতা যেনো ধর্মের গণ্ডি ছাড়িয়ে সার্বজননীন কালজয়ী রূপ পেয়েছে এই মৈনাক পর্বত চূড়ায়।
পুরান আদিতে বলা আছে, মৈনাক পর্বত হিমালয়ের শাখা। পুরাকালে ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম, আরাকান, ব্রহ্মদেশ, মালদ্বীপ ও পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ ছিলো সমসূত্রে গাঁথা। বর্তমান সময়ের নিম্নবঙ্গ ছিলো সাগরগর্ভে। এই অঞ্চলকে বলা হতো পূর্ব সাগর। তখন মগধের পরেই ছিলো সমুদ্র। আর এই মৈনাকের অবস্থান ছিলো লবণ সমুদ্রে।
সেই মৈনাক পাহাড় চূড়ায়ই এখন আদিনাথ মন্দির। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা প্রায় ৮৫ মিটার। মূল মন্দিরের দৈর্ঘ্য ১০.৫ মিটার, প্রস্থ ৯.৭৫ মিটার। উচ্চতা প্রায় ছয় মিটার। ভেতরের দেওয়াল ১.০৫ মিটার। বাইরের দেয়াল .৬০ মিটার।
বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীতে এই মন্দিরটির উত্তরের অংশ সবচেয়ে পুরনো। এখানে বর্গাকার দু’টি কক্ষে বাণলিঙ্গ শিবমূর্তি ও অষ্টভূজা নারী বিগ্রহ রয়েছে। অষ্টভূজাকৃতি স্তম্ভে আছে কলস, লতাপাতার নকশা।
এই অষ্টভূজা নারী মূর্তির কারণেই শারদীয় দুর্গা উৎসব আর পালন করা হয় না মহেশখালীতে।
মূল মন্দিরের সামনের প্রবেশ পথ ধনুকাকৃতির। এর পশ্চিম অংশে পুষ্পকলি এবং পশ্চিম অংশে ত্রিশুলের অলংকরণ। ইটের গাঁথুনি তুলে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে উত্তর ও দক্ষিণের প্রবেশ পথ। পূর্ব ও পশ্চিম দেওয়ালে দু’টি জানালা, দক্ষিণ দেওয়ালে দু’টি কুলুঙ্গি। মন্দির কক্ষের উপরে গম্বুজ। গম্বুজের উপরে ফুটন্ত পদ্ম, কলসচূড়া, চক্র।
কখনও শিবমূর্তি, কখনও অষ্টভূজা নারী মূর্তিতে আগত ভক্তদের মন্ত্রপাঠে সহায়তা করছেন পুরোহিত অভিজিত চক্রবর্তী। বিলাচ্ছেন প্রসাদ। মাত্র ২২ বছর বয়স তার। জন্ম চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে। জানালেন, এ মন্দিরে চার বছর ধরে পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। আরও চারজন পুরোহিত রয়েছেন এ মন্দিরে। পর্যটন মৌসুম না হওয়ায় ভক্তদের ভিড় কম এখন।
আদিনাথ মন্দির চত্বর থেকে দেখা যায়, উপকূল রক্ষা কার্যক্রমের আওতায় রোপিত ক্যাওড়া বনের বুক চিরে মহেশখালী চ্যানেলের বুকে এগিয়ে গেছে আদিনাথ জেটি। ভাটার টানে শান্ত পানি রোদ পড়ে চিকচিক করছে। নিস্তরঙ্গ জলে ঢেউ তুলছে ইঞ্জিনবোট, ট্রলার।
২১৭ একর জায়গা জুড়ে গড়ে ওঠা মন্দির কমপ্লেক্সটির পূর্ব দিকের অনেক জায়গা এরই মধ্যে নদী গর্ভ হারিয়ে গেছে। কেওড়া বন রোপনের পর ভাঙন ঠেকানো গেলেও মৈনাক চূড়ার পূর্বপাশে এখনও গাছ-লতাহীন উদোম মাটি। অঙ্গ হারানোর স্মৃতির বইছে যেনো।
একটু উত্তরে এই মহেশখারী চ্যানেলেরই মুদিরছড়ার কাছে ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে ব্রিটিশ জাহাজ এমভি ম্যালকম ডুবে যায়। অনেকের সঙ্গে সপরিবারের সলিল সমাধি হয় কক্সবাজার মহকুমায় সদ্য বদলি হয়ে আসা ম্যাজিস্ট্রেটের। প্রখ্যাত রম্যসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাই সৈয়দ মুস্তফা আলীর এক মেয়ে ছিলেন ওই ম্যাজিস্ট্রেটের সহধর্মিণী। এখানেই সলিল সমাধি হয় তাদের।
আদিনাথ মন্দিরের পাশে পশ্চিমের পাহাড়টায় ধাপে ধাপে উঠে গেছে বাঁধাই সিঁড়ি। উপরের ছোট্ট মালভূমি যেনো বহুভূজের শেপ নিয়েছে। এরই এক বাহুতে পরিত্যক্ত এক বৌদ্ধ মঠ। আনিন্দসুন্দর স্থাপত্যশৈলীর চিহ্ন বইছে।
মঠের ঠিক পেছন থেকে পাহাড়ি শিরা ধরে উত্তরে এগিয়ে গেছে পায়ে চলা সরু পথ। নিচে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে ছোট ছোট উপত্যকায় পানের বরজ। মন্দির আর মঠের মধ্যবর্তী সিঁড়ির গোড়ায় পাওয়া গেলো পানের বরজের এক মালিক মিলন কান্তিকে। কাঠের বোঝা মাথায় বরজেই যাচ্ছিলেন তিনি। জানালেন, এখানকার পাহাড়ি ভাঁজের ভেতরে গড়া পানের বরজে লতা টেকে বেশিদিন। পানও পাওয়া যায় বেশী।
নামার সময় সিঁড়িতে দেখা হয়ে গেলো খগেন্দ্রনাথের সঙ্গে। গত ২০ বছর ধরে আদিনাথ মন্দির কমিটির সেক্রেটারি তিনি। অবসরপ্রাপ্ত এই শিক্ষক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারও।
আঙুল তুলে পাহাড়ের নিচে গড়া স্থাপনাগুলো দেখিয়ে বললেন, তীর্থ ভ্রমণে এসে যাদের মৃত্যু হয় ওগুলো তাদের সমাধি। সঙ্গে বধ্যভূমিও আছে। ১৯৭১ সালে এখানে নিরীহ রাখাইনদের ওপর চালানো গণহত্যার সাক্ষী ওগুলো।
উল্টোদিকে পাহাড়ের গা কেটে জমি বের করে বসানো হয়েছে রাখাইন তাঁতের সারিবদ্ধ দোকান। স্থানীয় তাঁতে তৈরি বস্ত্র কিনতে খদ্দেরদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন চন্দন মেখে মেখে দর্শনীয় ত্বকের অধিকারী হয়ে ওঠা রাখাইন তরুণীরা।
কথিত আছে, নেপালের এক রাজা স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে ভারতবর্ষের পাঁচ স্থানে ৫টি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এগুলো হলো- নেপালের পশুপতিনাথ, কাশীতে বিশ্বনাথ, পাকিস্তানে ভূতনাথ, মহেশখালীর আদিনাথ ও সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ।
কয়েক হাজার বছর আগে ত্রেতাযুগে আদিনাথ মন্দিরের গোড়াপত্তন হয় বলে লিখে রাখা হয়েছে মন্দিরের সামনের পরিচিতি স্তম্ভে। তবে বর্তমান কাঠামোটি ষোড়শ শতকের বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
রামায়ণে বলা হচ্ছে, ত্রেতাযুগে রাম-রাবণের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে রামকে পরাজিত করতে শিবের উপাসনা করে অমরত্ব কামনা করেন রাবণ। শিব তাকে বর দিয়ে শর্ত দেন, কৈলাস থেকে শিবরূপী শিবলিঙ্গ মাথায় করে লংকায় নিয়ে পূজা করতে হবে। পথে কোথাও রাখা যাবে না। রাখলে তা আর ওঠানো যাবে না। সেই স্থানেই অবস্থান নেবেন শিবলিঙ্গ। শর্ত মেনে নিয়ে মহাদেবকে মাথায় করে নিয়ে রওয়ানা হন রাবণ। পথে এই মৈনাক পাহাড়ে এসে শিবলিঙ্গটিকে নামিয়ে রেখে প্রাকৃতিক কর্ম সারেন তিনি। কিন্তু পরে শিবলিঙ্গটিকে মাটি থেকে ওঠাতে ব্যর্থ হন। অনেক বছর পর জায়গাটি তীর্থস্থান হয়ে ওঠে।
আরও পরে হিন্দুদের এই তীর্থস্থানটি বিশেষ মর্যাদা পায় নুর মোহাম্মদ নামে এক মুসলমানের হাতে। তিনি একটি মন্দির নির্মাণ করে শিবলিঙ্গটিকে সেখানে স্থাপন করেন।
পরে ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে অষ্টভূজা নারী মূর্তিকে হিমালয়কন্যা নেপালের রাজার দরবার থেকে গোপনে এখানে নিয়ে আসেন গোরক্ষনাথের ভক্তরা। পরে পাহাড়ের কাছেই এলাকাটার নাম হয়ে যায় গোরকঘাটা।
পরে প্রতিষ্ঠত হয় ভৈরব মন্দির, রাধা-গোবিন্দ মন্দির ও শনি মন্দির।
নবাব আলীবর্দি খার শাসনামলে দেওয়ান বজ্র কিশোর লালা কানুনগোর প্রতিনিধি দেওয়ান কালিচরণ নয় বছরের বালক শরৎচন্দ্রসহ দ্বীপটি তৎকালীন শাসকের কাছ থেকে কিনে নেন। গোরক্ষনাথের সংস্পর্শে এসে সেই সম্পত্তি আদিনাথের নামে দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে দান করেন তিনি। ১৯১১ সালে সীতাকূন্ড শ্রাইন কমিটির অধীনে চলে যায় আদিনাথ মন্দির।
নাথ সম্প্রদায়ের প্রথম গুরু মীননাথের শিষ্য গোরক্ষনাথের আবির্ভাব কাল হিসেবে একাদশ শতাব্দীকে ধরা হয়। তার রচিত ‘গোরক্ষ বিজয়’ প্রকাশ হয় ষোড়শ শতাব্দীতে। নাথ সম্প্রদায়ের চার গুরু- মীননাথ, গোরক্ষনাথ, কাহ্নপা ও হাঁড়িপার প্রভাব বাংলাদেশের অনেক স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। ধারণা করা হয়, এই নাথ সম্প্রদায়েরই কোনো শিষ্য মহেশখালীতে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। দিনাজপুর, ঝিনাইদহ ও বগুড়া অঞ্চলের মতো দেশের দক্ষিণাঞ্চলে এই গোরক্ষ মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। মন্দিরের অদূরে গোরকঘাটা বাজারের নামের সঙ্গে এই গোরক্ষনাথের নামের মিল পাওয়া যায়। গোরক্ষ বিজয়ে ফয়জুল্লাহ ও সুকুর মাহমুদসহ অনেক মুসলমানের নামও পাওয়া যায়।
প্রতিবছর ফালগুন মাসের শিব চতুর্দশীতে এখানে জমে আদিনাথ মেলা। অন্তত সপ্তাহ দু’য়েকজুড়ে চলা এ মেলায় পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে বসে নাটক, যাত্রা, সার্কাস আর পুতুল নাচের আসর। জমে ওঠে মাটির হাঁড়ি-পাতিল-কলসি, বাঁশ-বেতের আসবাব, লোহার দা-বটির বিকিকিনি।
মন্দিরের নিচে রাখাইন পাড়া। ঠাকুরতলা বৌদ্ধ বিহার।
তৃষ্ণাকাতর পর্যটকরা ডাব কিনে খাচ্ছেন মৈনাক পাহাড়ের নিচে। পাশ দিয়ে যাওয়া এক যুবক তার সঙ্গিনীকে বলছেন, ওই দেখো, ওরা বাংলানিউজের সাংবাদিক। কাল তো এদেরই স্টোরি পড়লাম।
কথা বলে জানা গেলো, ভ্রমণপ্রেমী ওই যুবকের বাড়ি টাঙ্গাইল। কাজ করেন গুলশানের এক ফিন্যান্স কোম্পানিতে। নাম তার রাহিদ ইউসুফজাই। বাংলাদেশে ইউসুফজাই উপাধির পরিবার এখন কেবল তাদেরটাই।
সঙ্গে স্ত্রী জিন্নাতুন, ষষ্ঠশ্রেণি পড়ুযা ভাগ্নে আকিদুল ইসলাম আর দুই বছর বয়সী একমাত্র ছেলে আববার। গরমে শরীর ঠিক রাখতে লবণ পানি খাচ্ছেন তারা।
অভিভূত রাহিদ বললেন, বছরজুড়ে দেশঘুরে বিভাগে বাংলানিউজের আয়োজন তো এক্সিলেন্ট। আপনাদের ট্রাভেলার্স নোটবুক আর এভিয়াট্যুর বিভাগেরও ভক্ত আমি।
**মুখ ভরে যায় পানের রসে
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০১৬
জেডএম/এসএনএস