কক্সবাজার: ২০১৫ সালের ১৯ মার্চ কক্সবাজার সদর থানার পেছনের রোডের যমুনা গেস্ট হাউজ থেকে এক ধর্ষিতা তরুণীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই ঘটনার এক বছর অতিবাহিত হলেও জানা যায়নি নিহত তরুণীর প্রকৃত পরিচয়।
এরও আগে, ২০১৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর কলাতলীর ফয়সাল গেস্ট হাউসের ১০৬ নম্বর কক্ষ থেকে এক অজ্ঞাতনামা ধর্ষিতা তরুণীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই দিন রাতে পুলিশ বাদী হয়ে কক্সবাজার সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। এরপর কেটে গেছে এক বছর চার মাস। কিন্তু পরিচয় মেলেনি সেই হতভাগা তরুণীর। চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি হত্যাকারীদের।
শুধু ওই দু’জন তরুণীর বেলাতেই ঘটনা শেষ নয়। বিগত ছয় বছরে এরকম এক ডজন হত্যাকাণ্ডের ঘটনার রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া হোটেল-মোটেল জোনে প্রতিনিয়ত ঘটা নানা অঘটনের হোতারা থেকে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পর্যটকদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। পর্যটন জোনে বেড়েছে চুরি, ছিনতাইসহ ইভটিজিং প্রবণতা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর পর্যটন এলাকা কিংবা সৈকত শহরগুলোতেও এ ধরনের অপরাধ নতুন নয়। তবে কক্সবাজারের হোটেল-মোটেল জোনে অবস্থিত হোটেলগুলোর বেশিরভাগেরই নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ার কারণে এসব অপরাধ ঘটলেও তা প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না।
অন্য দেশগুলোর পর্যটন নগরী ও সৈকত শহরের মতো কক্সবাজারের পর্যটন জোনকে যদি সিসিটিভির আওতায় আনা যায়, তবে অপরাধ প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে মতামত দিয়েছেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে কক্সবাজার সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসলাম হোসেন বাংলানিউজকে জানান, শহরে আবাসিক হোটেলে সংঘটিত অধিকাংশ হত্যাকাণ্ডেরই রহস্যজট খোলা সম্ভব হয়নি। হোটেল রেজিস্টারে থাকা নিহত ও খুনির পরিচয় ভুল থাকায় এবং হত্যাকারীর কোনো ছবি না পাওয়ায় ওইসব মামলা নিয়ে বেকায়দায় রয়েছে পুলিশ।
তবে যদি আবাসিক হোটেল, মোটেল ও কটেজে সিসি ক্যামেরা থাকতো, তাহলে খুব সহজেই খুনিকে আটক করা সম্ভব হতো।
এ বিষয়ে ট্যুরিস্ট পুলিশের কক্সবাজার সহকারী পুলিশ সুপার রায়হান কাজেমী বাংলানিউজকে জানান, যদি হোটেল-মোটেল জোন, কটেজ পল্লীতে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা যায়, তবে শুধু হত্যা কেন অনেক ধরনের অপরাধ প্রবণতা লোপ পাবে। এজন্য এ বছরের শুরুতে টু্রিস্ট পুলিশের পক্ষ থেকে হোটেল, মোটেল ও কটেজ মালিকদের সিসিটিভি বসানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, সমুদ্র শহর কক্সবাজারে প্রায় সাড়ে ৪শ হোটেল, মোটেল ও কটেজ রয়েছে। এর মধ্যে তারকামানের হোটেলসহ প্রায় ৮০টি হোটেলে সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে। এদের মধ্যে অধিকাংশ হোটেলে ক্যামেরা থাকলেও ওইসব ফুটেজ সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। এছাড়া ক্যামেরা থাকলেও নেই সিসিটিভি।
সরেজমিনে হোটেল-মোটেল জোন পরিদর্শন করে দেখা যায়, সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সামনের কটেজপল্লীতে শতাধিক কটেজ রয়েছে। কিন্তু কোনো কটেজেই সিসিটিভি ক্যামেরা নেই।
এ বিষয়ে কটেজ মালিক সমিতির সভাপতি কাজী মোস্তাক আহমেদ শামীম বাংলানিউজকে জানান, মাস তিনেক আগে পুলিশের পক্ষ থেকে প্রতিটি কটেজে সিসিটিভি স্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু কটেজ মালিকরা রাজি না হওয়ায় তা আর বাস্তবায়ন হয়নি। তবে কটেজ মালিকদের পক্ষ থেকে খুব শিগগিরই কটেজ জোনে কমপক্ষে ৪টি সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হবে।
তিনি আরও জানান, যদি হোটেল, মোটেল, রেস্তোরা ও কটেজ মালিকরা একত্রিত হয়ে ট্যুরিস্ট জোনকে সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনেন, তবে সব ধরনের অপরাধ শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে।
এদিকে, কলাতলী রোড়ের রাস্তার পূর্বপাশে জিয়া গেস্ট ইন থেকে কলাতলী মোড় পর্যন্ত তিন শতাধিক হোটেল থাকলেও সিসিটিভি রয়েছে মাত্র অর্শতাধিক হোটেলে। এসবের সিসিটিভি অধিকাংশই বিকল। কোনো হোটেলে নেই আর্চ ওয়ে ও মেটাল ডিটেকটর। ফলে পর্যটকদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে।
এ বিষয়ে কক্সবাজার হোটেল মোটেল মালিক সমিতির সভাপতি ওমর সুলতান কোম্পানি নাগু বাংলানিউজকে জানান, তার সংগঠনের অধীনে অর্ধশতাধিক হোটেল রয়েছে। এসব হোটেলে আর্চ ওয়ে ও মেটাল ডিটেকটরের ব্যবহার না করা হলেও সিসিটিভি রয়েছে।
তবে তিনি আরও জানান, যদি পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয় তবে প্রতিটি হোটেলে সিসিটিভি বসাতে হবে।
কলাতলী রোড়ে পশ্চিম পাশে রয়েছে প্রায় ২০টি তারকা মানের হোটেল। প্রতিটি হোটেলে সিসি ক্যামেরা থাকলেও নেই আর্চ ওয়ে। ব্যবহার করা হয় না মেটাল ডিটেকটর। এছাড়া তারকা মানের কোনো হোটেলেই নেই স্ক্যানিং মেশিন।
এ বিষয়ে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফেরদৌস আলী বাংলানিউজকে জানান, তারকা মানের হোটেলে সিসিটিভি, আর্চ ওয়ে, মেটাল ডিটেকটিভ ও স্ক্যানিং মেশিনসহ অন্য হোটেল, মোটেল ও কটেজগুলোতে সিসিটিভি এবং আর্চ ওয়ে নিশ্চিত করা গেলেই পর্যটন এলাকার অপরাধ শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ বাংলানিউজকে জানান, পুলিশ পাহারা বাড়িয়ে পর্যটকদের নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়। উল্টো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে দেখলে পর্যটকরা বিব্রত হবেন। কাজেই পর্যটকদের নিরাপত্তার পাশাপাশি তাদের ভ্রমণকে আনন্দময় করতে হলে এগিয়ে আসতে হবে পর্যটন ব্যবসায়ীদের। আগত অতিথিদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা করতে হবে হোটেল মালিকদের।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৮, ২০১৬
আরআই/এসএনএস