ঢাকা, বুধবার, ২৮ কার্তিক ১৪৩১, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

প্রতি ঢেউয়েই সাগর নামে সোনাদিয়ায়

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০১৬
প্রতি ঢেউয়েই সাগর নামে সোনাদিয়ায় ছবি: সোহেল সরওয়ার-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সোনাদিয়া ঘুরে: প্রতি ঢেউয়েই সোনাদিয়ার শরীর থেকে অন্তত ফুট খানেক করে নেমে যাচ্ছে পানি। ক্রমশ বড় হচ্ছে সৈকত লাগোয়া কিঞ্চিত ঢালু মহীসোপান।

হঠাৎ যেনো সাগর নেমে গেলো ঝপ করে। দ্বীপের ঢালু সৈকত হঠাৎ করেই খাড়া হয়ে গেলো যেনো। ভাটার টানে দুর্বল হয়ে পড়া ঢেউ বালুর কার্নিশের নিচে পিছলে নেমে অসহায় আবেগে ফুঁসছে।

এ কেমন ভাটার রূপ সোনাদিয়ায়! মাত্র মিনিট পাঁচেকের মধ্য অন্তত ১০ ফুট সরে গেছে সাগরের পানি। প্রখর রোদের নিচেও তাই ভিজে রয়েছে নগ্ন সৈকত। দ্বীপের দেওয়াল হুট করে খাড়া হয়ে সাগরে নেমে যাওয়ার কারণেই সম্ভবত প্রতি ঢেউয়েই পানি নেমে যাওয়ার দৃশ্য স্পষ্ট হয় সোনাদিয়ায়।
দক্ষিণে খোলা সমুদ্র। বহুদূর থেকে ভেসে আসা নিস্তরঙ্গ ঢেউ বেশ বুঝিয়ে দিচ্ছে, দৃষ্টিসীমানায় ভেসে থাকা পানির নিচে ডুবো চর কম। কোথাও ধাক্কা খাচ্ছে না সাগরের পানি। দৃষ্টিসীমার ওপার থেকে সোনাদিয়ার খাড়া শরীর পানে ছুটে আসছে একই তরঙ্গ বজায় রেখে।

পেছনের ঝাউবন দখিনা হাওয়ায় দুলছে। ইউক্যালিপটাসের মতোই পাখি বসে না ওসব গাছে। ফলে না ফল, ফোটে না ফুল। সরু শরীর ছায়া দিতেও অক্ষম। মাটির খুব গভীরে শেকড় যাওয়ার ক্ষমতা না থাকায় সামুদ্রিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ঠেকাতেও তেমন একটা কার্যকর নয় এই ঝাউ গাছ। তবুও ফি বছর কেন যে উপকূল জুড়ে এসব গাছ লাগানো হচ্ছে তা বুঝে ওঠা সত্যিই মুশকিল।
ঝাউগাছের নিচে ঘাস-লতা জন্মায় না। এখানেও ঠিক সেটাই দেখা গেলো। পুরো ঝাউ বন জুড়ে ঝুরঝুরে বালু। অন্য গাছ তো দূরে কথা, একটা ঘাসও নেই।

এই অপয়া ঝাউবনকে বাঁয়ে রেখে পূর্ব দিকে হাঁটতে শুরু করতেই হাতের ডানে আছড়ে পড়ে সঙ্গ দিতে থাকলো বঙ্গোপসাগর। সামনে চোখের কোনে ধরা পড়লো ঝাঁকে ঝঁকে লাল কাঁকড়া। মানুষের পদধ্বনিতে যেনো রাজ্যের সব লজ্জা এসে ভর করছে ছোট ছোট লাজুক শরীরে। কাছে যাওয়ার আগেই কী এক কৌশলে সেঁধিয়ে যাচ্ছে বালুর নিচে।

জীবনসংগ্রামী জেলেদের এই দ্বীপ তো লাল কাঁকড়ারই অভয়াশ্রম।
একটু সামনে এগিয়ে পেছন ঘুরতেই চক্ষু চড়কগাছ। ছোট ছোট লাল কাঁকড়ায় লাল হয়ে রয়েছে সোনাদিয়ার দক্ষিণ উপকূল। যেনো বুঝে গেছে, এইমাত্র হেঁটে এগিয়ে যাওয়া মানুষগুলো আর পেছন ফিরবে না।

সামনে বহুদূর হেঁটে এসে যেনো ঝিমাচ্ছে বিশাল সাইজের এক লাল কাঁকড়া। এই দ্বীপে এতো বড় কাঁকড়া এই একটাই চোখে পড়লো। যে পথে হেঁটে এসেছে তার আঁকাবাঁকা ছাপ স্পষ্ট পেছন দিকটায়। কিন্তু নিথর কেন কাঁকড়ারাজ!

একটু পরই বোঝা গেলো, আহত সে। হাঁটাচলা কষ্টকর হয়ে উঠেছে তার জন্য। তাই বলে কি সঙ্গীরা ফেলে গেলো তাকে? এরা কি যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষের মতোই আহত সঙ্গীকে ফেলে যায়!
একটু পরই হাতের বাঁয়ে বালিয়াড়ির ফাঁকে পরিত্যক্ত ঘরগুলো স্পষ্ট হলো ফের। সংখ্যায় গোটা পঁয়ত্রিশ হবে। বালিয়াড়ির ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট উপত্যকার মতো জায়গায় গড়ে ওঠা এসব ঘর এই ক’দিন আগেও ছিলো জমজমাট ব্যবসার আড়ত। গভীর সাগর থেকে মাছ ধরে এখানে আনতো জেলেরা। সেই মাছ কেনা হতো এসব আড়তে। তারপর এই খোলা সৈকতেই রোদের নিচে শুকিয়ে করা হতো শুঁটকি। এই শুঁটকিই তো সোনাদিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ।

সামনে বরষা বলে এখন আর গভীর সাগরে যাচ্ছে না মাছ ধরা ট্রলার। এ বছরের মতো শুঁটকির মৌসুম শেষ। আড়ত ঘরগুলো তাই পরিত্যক্ত। মরুভূমির বুকে ঠিক যেনো পরিত্যক্ত জনমানবহীন কোনো বসতি। তবে পরিত্যক্ত ঘরে মাত্র ১০ থেকে ১২ ফুট পাইপেই উঠে আসে মিষ্টি পানি। এ যেনো নোনা সাগরে মিঠা পানির স্বর্গ। তৃষ্ণাকাতর পর্যটকের জন্য এই পানি তো স্বর্গ সুধাই হবে।

বিচ্ছিন্ন ওই জনহীন বসতির বাসিন্দা মোটে তিনজন পাহারাদার। পালাক্রমে তারা পাহারা দেন পরিত্যক্ত এসব বেড়ার ঘর। এদেরই একজন সুনীল শর্মা। জানালেন, সোনাদিয়ায় প্রায় সাড়ে তিনশো ঘরে যে দেড়-দুই হাজার বাসিন্দা রয়েছেন তারা সবাই এসেছেন মহেশখালী থেকে। তবে দ্বীপের এদিকটায় জনবসতি একদমই নেই।
এখানে জনবসতি না থাকার কারণও অবশ্য বেশ বোঝা গেছে একনাগাড়ে ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার হাঁটার পর। পরিত্যক্ত আড়তপাড়ার ওপাশে টলমলে জলের খাল। স্থানীয়ভাবে যার পরিচিতি নদী হিসেবেই।

এখানকার সাগরের মতো এ নদীর পানি নীল নয়। তবে বেশ টলটলে। নদীর পাড়ে কেওড়া বন, লতা-পাতার ঝোপ। দক্ষিণের সাগর থেকে এসে উত্তরের খালে মিশেছে এই খাল। এ দুই খালের মিলিত প্রবাহ দেশের একমাত্র দ্বীপ উপজেলা মহেশখালির পেটে দ্বীপের ভেতরে দ্বীপ, তারও ভেতরে দ্বীপের সৃষ্টি করেছে।

পূর্ব-দক্ষিণ উপকূলের সবচেয়ে ছোট দ্বীপটির মাটি এখনও শক্ত হয়নি। কোথাও বালি, কোথাও পলিতে পা দেবে যায় দু’তিন ইঞ্চি করে। এর ওপর দিয়ে হাঁটা বেশ কষ্টকরই বটে। তারওপর সারাক্ষণই মাথার ওপরে জ্বলছে সূর্য।

ওদিকটায় নানা প্রজাতির জলজ পোকার বসত। অনেকটা গুবরে পোকার মতো পিঠওয়ালা বড় বড় ঠ্যাংঙের ওগুলো কি কাঁকড়া! নাকি লোকমুখে শোনা, শিলা কাঁকড়ার দল এটা? পায়ের সাড়া পেয়ে কয়েক সেকেন্ডেই সেঁধিয়ে গেলো নরম পলির ভেতর। এই দ্বীপ যে জীববৈচিত্র্যে কতোটা সমৃদ্ধ তা বুঝতে এই সৈকতে ঘণ্টা কয়েক হাঁটাই যথেষ্ট।
খোলা মাঠে থিকথিকে বালু-পলির ভেতর উঁকি দিচ্ছে ঘাড়ের কচি ডগা। শিগগিরই জমে শক্ত হবে এখানকার পলিমাটি। তারওপর বসত গাড়বে মানুষ। ইঁট-পাথরের আঘাতে আহত হবে সোনাদিয়ার মাটি।

দু’এক দিন আগে একটা মহিষের পাল হেঁটে গেছে নরম পলির বুক চিরে। তাদের পায়ের ছাপে তৈরি হয়েছে আঁকাবাঁকা এক ট্রেইল। সেই ট্রেইলের পাশে বসে যাচ্ছে আরও দু’জন মানুষের পায়ের ছাপ।
ছোট্ট সোনাদিয়ায় যেনো ম্যানগ্রোভ আর উপকূলীয় বনের অভূতপূর্ব সমাবেশ। সাগরের গাঢ় নীল জলে চেনা অচেনা সামুদ্রিক পাখির অবাধ বিচরণ। তাই তো যাযাবর পাখির ভূ-স্বর্গ বলা হয় সোনাদিয়াকে। সব মিলিয়ে ৭০ প্রজাতির জলচর পাখি দেখা যায় সোনাদিয়ায়।

ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বসে কাদাখোচা পাখির মেলা। বৈশ্বিকভাবে বিপন্ন কাদাখোচার তিন প্রজাতি স্পুনবিল্ড স্যান্ডপাইপার, এশিয়ান ডোউইচার আর নর্ডম্যান্স গ্রীনশ্যাঙক এর দেখা মিলেছে এই সোনাদিয়াতেই। এখানে বছরভর ঝাঁকে ঝাঁকে ঘোরে লিটল প্রেটিংকল। বিচরণ করে রাজহাঁস, চকাচকি ও খন্তেমুখা বুনোহাঁস।
একসময় মুক্তার চাষ হতো সোনাদিয়ায়। কালের গর্ভে সেই সংস্কৃতি কোথায় হারিয়েছে কে জানে। তবে এখনও ঝিনুকে মুক্তা মেলে দ্বীপটির পশ্চিম উপকূলে।

এ দ্বীপের বালিয়াড়ি সমৃদ্ধ সৈকত বিরল প্রজাতির জলপাই রঙা কাছিমের ডিম পাড়ার উপযোগী ভূমি। এখানে ডিম পাড়তে আসে সবুজ কাছিমও।

এ দ্বীপের সুউচ্চ বালিয়াড়ির তুলনা দেশের আর কোথাওই নেই, বরং কেয়া-নিশিন্দার ঝোপ, বিচিত্র প্রজাতির জলচর পাখি, ছোট ছোট খালের সমাহারে প্যরাবন দ্বীপটিকে করে তুলেছে অতুলনীয়।
এখানকার প্যারাবনে মূলত বাইনের রাজত্ব। আরও রয়েছে কেওড়া, গেওয়া, হারগোজা ও নুনিয়া প্রজাতির বৃক্ষ। এই প্যারাবনের ভেতরে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা খাল আর মোহনা নানা প্রজাতির মাছ ও অমেরুদণ্ডী প্রাণীর আবাসস্থল। বাটা, কোরাল, তাইল্যা, দাতিনা, কাউন আর পোয়া মাছের মেলা এসব জলায়।

১৯৯৯ সালে সোনাদিয়াকে ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া ঘোষণা করা হয়েছে।

দেখতে দেখতে গা সওয়া গেলো সূর্যের তাপ। দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে ছুটে আসা মৌসুমী বায়ু যেনো শীতল ছোঁয়া বুলিয়ে দিচ্ছে ঘাম চিটচিটে শরীরে। হাঁটতে হাঁটতে সোনাদিয়া জেটিটা কাছে চলে এলো ফের।
মন্তব্য খাতা খুলে ছুটে এলেন আব্দুল করিম। ছয় হাজার টাকা বেতনে নিত্যদিনই রোদে পুড়ে পর্যটকদের অপেক্ষায় থাকেন তিনি। ২০১৭ সালে এখানে অবকাঠামো গড়তে শুরু করবে পর্যটন করপোরেশন। তারই আগাম প্রস্তুতি হিসেবে নিয়োগ করিমের।

বিরস কণ্ঠে জানালেন, আজ আর পর্যটক আসেনি সোনাদিয়ায়। বেলা পড়ে যাচ্ছে বলে আর আসারও সম্ভাবনা নেই।

জেটির সঙ্গ বাঁধা স্পিডবোটটা একটু একটু দুলছে। দ‍ূরে সোনাদিয়া চ্যানেলের ঘোলা জলের ওপাশে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে কক্সবাজার উপকূল যেনো কালচে রেখা হয়ে শুয়ে রয়েছে সাগরের তীর ছুঁয়ে।

**ফের জুড়ে যাবে ছিঁড়ে যাওয়া মহেশখালী
** জোয়ারেই ছিঁড়ে যায় ছেঁড়া দিয়া
** আট প্রহরই সাগরের সঙ্গে মিতালী
** মেঘের সাগরে আয়েসি উড়াল
** হাওয়া অফিস খাঁ খাঁ, ঐতিহ্যের শরীরে টাইলস আগ্রাসন
** বাংলানিউজ, ওয়েলকাম টু কক্সবাজার
** আতঙ্ক আর আনন্দ একযোগে ভর করলো সাগরে
** এই ৮ বর্গকিমিই এনেছে ৪ হাজার বর্গকিমি সমুদ্র
** সেন্টমার্টিন যেভাবে যাবেন
** তৃতীয় ধাপে চট্টগ্রাম টিম এখন কক্সবাজারে
** কক্সবাজারে বাংলানিউজের দ্বিতীয় টিম
** বছরজুড়ে দেশ ঘুরে: কক্সবাজারে বাংলানিউজ

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০১৬
জেডএম/এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ