শ্রীমঙ্গল থেকে: শহর ঘিরে এতো চা বাগান আর কোথাওই নেই। বাংলাদেশে মোট ১৩৮টি চা বাগানের মধ্যে এখানেই রয়েছে ৩৮টি।
এখানে রয়েছে চা জাদুঘর ও চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই)। স্থানীয় অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তিও এই চা।
এই উপজেলার পূর্বপাশে কিছু অংশে হাওর রয়েছে বটে, কিন্তু উপজেলার আর সব অংশে টিলাসারি ছেয়ে রয়েছে দু’টি পাতা একটি কুঁড়ির চা গাছে। যেনো হাইল হাওরকে সামনে রেখে সুবিশাল পাহাড়ে হেলান দিয়ে শুয়ে রয়েছে সারি সারি সবুজ গাছ।
বাংলাদেশে চায়ের চাষাবাদ শুরু হয় উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে। ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনিছড়ায় যাত্রা শুরু হয় প্রথম চা বাগানের। পর্যায়ক্রমে বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন জেলা-থানায় ছড়িয়ে পড়ে চা চাষ। সিলেটের সীমানা পেরিয়ে চায়ের আওতায় চলে আসে চট্টগ্রামেরও কিছু এলাকা। বর্তমানে সীমিত পরিসরে হলেও উত্তরবঙ্গের পঞ্চগড়েও চা চাষের চল শুরু হয়েছে।
এই চায়ের রাজধানীতেই ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তান চা গবেষণা প্রতিষ্ঠান (পিটিআরএস)। মাত্র এক যুগের মধ্যেই ৪২ হাজার ৬শ ৮৮ হেক্টর জমি চলে আসে চা চাষের আওতায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর উন্নত গবেষণার প্রয়োজনে পূর্ণাঙ্গ গবেষণা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয় পিটিআরএসকে। নাম রাখা হয়, বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই)। বাড়তে থাকে ফলন, উন্নত হতে থাকে মান। ছাটাই, চয়ন, রোপণে আসে বৈজ্ঞানিক পরিবর্তন। মাত্রাগত পরিবর্তন আসে বালাইনাশকের ব্যবহারে। আরও সুপ্রতিষ্ঠিত হয় চায়ের রাজধানী খেতাব।
রাজধানী ঢাকা থেকে চায়ের রাজধানীর দূরত্ব রেলপথে প্রায় ২শ কিলোমিটার। সড়কপথে ২৩৮ কিলোমিটার। আকাশপথে আসতে চাইলে সিলেটে নেমে আসতে হবে শ্রীমঙ্গলে। জেলা সদর মৌলভীবাজার থেকে চায়ের রাজধানীর দূরত্ব ২০ কিলোমিটার মাত্র।
উপজেলার আয়তন ৪২৫.১৫ বর্গকিলোমিটার। এ শহরের অন্যতম আকর্ষণ বাগানে পাতা তোলায় মগ্ন ভাস্কর্য চা কন্যা। ২৪ ফুট উঁচু ওই শুভ্র ভাস্কর্যের পিঠের ঝুড়িতে কতো চা পাতা জমলো কে জানে? সাতগাঁও চা বাগানের সহায়তায় ২০১০ সালে এই ভাস্কর্য তৈরি করে মৌলভীবাজার জেলা প্রসাশন। সঞ্জিত রায় এই ভাস্কর্যের শিল্পী।
চা কন্যার সামনেই বিস্তীর্ণ এলাকায় বিছিয়ে রয়েছে সাতগাঁও চা বাগান। ভানুগাছ সড়কে উঠলেই ফিনলে চা বাগান হাজির চোখের সামনে। একই সড়কের টি রিসোর্ট ছাড়িয়ে কয়েক কিলোমিটার এগুলে জেরিন টি এস্টেট। লাউয়াছড়ার আগে হাতের ডানে জঙ্গলঘেরা পথটি চলে গেছে নূরজাহান টি এস্টেটের দিকে। কমলগঞ্জের পথে চা বাগানের ভেতরে আনিন্দ্য সুন্দর রূপ নিয়ে শুয়ে রয়েছে মাধবপুর লেক। চারপাশের চা বাগানগুলো সরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল টি কোম্পানির।
এখানে চা পাতা সংগ্রহের মৌসুম শুরু হয় বৈশাখের শেষ নাগাদ। তারপর টানা পাঁচ মাস সবুজ সতেজ চা বাগান থাকে চা তোলার কর্মচাঞ্চল্যে ভরপুর।
এই মাঝ বরষায় শহরের চারপাশে অবারিত সবুজের মেলা। স্তরে স্তরে সাজানো এই সবুজ বৃক্ষরাজিকে কখনও মনে হয় সাগরের ঢেউ, কখনওবা সবুজ মাঠ। কোনো দক্ষ শিল্পী যেনো স্তরে স্তরে সবুজ বৃক্ষ সাজিয়ে রেখেছে। সেই সবুজের ভাঁজে ভাঁজে পাখির কলকাকলি, নিঃশব্দের সুর।
চায়ের রাজধানীতে আরও রয়েছে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। তার সামনে ভেষজ উদ্ভিদের বাগান। ভেতরে রাবার, আনারস, লেবু বাগান, আদিবাসী পল্লী ও পানপুঞ্জি, ওফিং হিল, বালিশিরা ভ্যালি ও বার্নিস টিলার সবুজ মায়া, শ্যামলী পর্যটন আর ডিপ ফিজাপ এরিয়া। অপার জীববৈচিত্র্য ধারণ করে রয়েছে হাইল হাওর আর বাইক্কা বিল।
আরও রয়েছে এই উপজেলার একমাত্র ঝর্ণা যজ্ঞ কুণ্ডের ধারা, মিথ আশ্রয়ী নির্মাই শিববাড়ী, সিতেশ দেবের বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন ও দেশের একমাত্র সাদা বাঘ এবং শতবর্ষের স্মৃতিবিজড়িত ডিনস্টন সিমেট্রি। এখনও দুর্ঘটনার স্মৃতি বইছে মাগুরছড়া গ্যাস কূপ।
মাধবপুর লেক ছাড়িয়ে ধলই সীমান্ত পথে শুধু চা বাগান আর বাগান।
**৪ ঘণ্টায় চায়ের দেশে
**ট্রেন চলেছে চায়ের দেশে
বাংলাদেশ সময়: ১১৪২ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০১৬
জেডএম/এসএনএস