শ্রীমঙ্গল থেকে: পাঁচ পাঁপড়ির বেগুনি ফুল। পাতাগুলো তেজপাতার মতো দেখতে।
হ্রদের কথা বলছিলাম। ভাড়াউড়া হ্রদ (লেক)। অপরিচিত ঠেকছে? ফিনলে কোম্পানির ভাড়াউড়া চা বাগানের ভেতরে অবস্থান বলে এই নাম। ভৌগলিক অবস্থান অনুসারে, লেকের দক্ষিণ-পূর্বে হোটেল গ্র্যান্ড সুলতানের সীমানা, পশ্চিমে মূল ভাড়াউড়া চা বাগান, উত্তরে রেললাইন ও পূর্বে লাউয়াছড়া। শ্রীমঙ্গল সদর থেকে প্রায় ছয়-সাত কিলোমিটার হবে। পায়ে হেঁটে আসার যে জো নেই, তাতো বোঝাই যাচ্ছে।
শ্রমিক পাড়া থেকে বেরিয়ে গেলেই পুরোটা লাল-নীল-সবুজের ক্যানভাস। দু’ধারে যতোদূর চোখ যায় চা বাগান। মাথাল পরে নিপুণ হাতে চা তুলছেন চায়ের দেশের কন্যারা। কোনোদিকে তার তাকানো বারণ। হঠাৎ হঠাৎ মাথায় কাঠবোঝাই যুবা কিংবা গরু তাড়িয়ে কিশোর চলেছে আপন গাঁয়ে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, দৃষ্টিনন্দন কোনো চিত্রকর্মের চরিত্ররা প্রাণ পেয়েছে। তাতে আকাশ রয়েছে, রয়েছে মুখ টিপে হেসে চলে যাওয়া পেজা তুলোর মতো মেঘ, রোদের উঁকিঝুঁকি, দু’-একটি পাখি আর ছড়ানো প্রশান্তির পরশ। গগনচুম্বী গাছেদের সঙ্গে সই পাতিয়ে এর মধ্য দিয়ে চিলতে জায়গা নিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে পথ। সব পথ নদীতে গিয়ে থামে। কিন্তু এই পথ বুঝি পণ করেছে, ভাড়াউড়া হৃদে গিয়ে থামার। নিয়েই ছাড়বে যেনো!
ভূগোলবিদ্যা বলছে, হ্রদ (ইংরেজিতে লেক) হচ্ছে ভূ-বেষ্টিত লবণাক্ত বা মিষ্টি স্থির পানির বড় আকারের জলাশয়। হ্রদ উপসাগর বা ছোট সাগরের মতো কোনো মহাসমুদ্রের সঙ্গে সংযুক্ত নয়, তাই এতে জোয়ার ভাটা হয় না। বিভিন্ন ভূ-তাত্ত্বিক কারণে মাটি নিচু হয়ে হ্রদের সৃষ্টি হতে পারে। স্তরীভূত শিলায় ভাঁজের সৃষ্টি হয়ে, অনেক বড় আকারের শিলাস্তর ফল্টের আকারে স্থানচ্যুত হলে, কিংবা ভূমিধ্বসের ফলে পাহাড়ি নদীর গতিপথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়ে হ্রদের সৃষ্টি হতে পারে। সরাসরি বৃষ্টিপাত ও হ্রদে পতিত হওয়া নদী বা জলধারা হ্রদে পানির সরবরাহ করে।
ভাড়াউড়া হ্রদও উল্লিখিত কোনো একটির কারণ। যে যানবাহনেই যাওয়া হোক না কেন, ‘এই উল্টে গেলাম!’ অনুভূতি যখনই তৈরি হবে- বুঝতে হবে, হৃদ এসে গেছে। একেবারে টিলার মাথায় বামে শিবঠাকুরের মন্দির। এর কোল ঘেঁষে নেমে গেছে সরু ঢালু পথ। বুনো লতা-পাতার গন্ধ গায়ে মেখে নেমে পড়ুন অনিন্দ্য সুন্দরলোকে। টিলার চূড়ান্তে দাঁড়িয়ে প্রায় দুই একরের হৃদ পুরোটা দেখা যায় না। যারা কষ্ট করে শেষ মাথা অব্দি যাবেন, তাদের জন্য বাড়তি পাওনা হিসেবে মিলবে আরও খানিকটা মিঠে পানির অভিনন্দন। চারদিকে চা পাতার অবোধ্য ইশারা। পানিতে বাতাসের দোলায় ঝিরিঝিরি কারুময় ঢেউ। জলজন্মের স্মৃতি বুকে নিয়ে মেঘেরা ভিড় জমায় হ্রদের আয়নায়। বামদিক দিয়ে হাঁটা ধরলে চোখে পড়বে অসংখ্য ফৎনা তোলা ছিপের লাঠি। তাড়া না থাকলে বসে যেতে পারেন কারও পাশে। দু’দণ্ড শান্তির সঙ্গে রুই-কাতলা-মৃগেল মিলতেও পারে।
এতো নির্জন-নির্মল শান্তির হাতছানি কার সাধ্যি এড়িয়ে যায়? কারও যে নেই এটা বাজি ধরা যায়! কিন্তু প্রচার-পরিচিতি নেই বলে হাতছানি শূন্যে মিলিয়ে যায়, মত আষাঢ়স্য শেষ দিবসে দুপুর থেকে ছিপ নিয়ে বসা ব্যবসায়ী চন্দন ভট্টাচার্যের।
নেই কেন? স্মিতহাস্যে জানালেন, অনেকটা ভেতরে আর যাওয়া-আসার পর্যাপ্ত যানবাহন মেলে না বলে অনেকে জেনেও পিছিয়ে যায়। এর চেয়ে কম সুন্দর হ্রদ শুধু ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা ও কর্তৃপক্ষের বিশেষ দেখভালের কারণে জনপ্রিয় হয়ে গেছে। আপনি নিজেই দেখেন, কতো সুন্দর এটা।
সত্যিই ধ্বক করে ওঠে বুকে! তীব্র সুন্দরের একটি ভয়ঙ্কর রূপও রয়েছে। সেটি কখনও-সখনও মারাত্মক হয়ে ওঠে। ভুলিয়ে দেয় পিছুটান, মুছে দেয় ফেরার পথ…!
*** লাউয়াছড়া গভীর আনন্দের মূর্তি ধরিয়া আসে
*** ‘সবাই বন্যপ্রাণী এনজয় করে কিন্তু তাদের কথা ভাবতে চায় না’
বাংলাদেশ সময়: ০৭৩২ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০১৬
এসএনএস/আরএ