শ্রীমঙ্গল থেকে: গায়ের রং চিকচিকে কালো, চেহারায়ও হাড়খাটুনি পরিশ্রমের ছাপ! পোশাক-আষাক দেখলে যে কেউ চোখ বন্ধ করেই বলে দিতে পারে মানুষটির নাজুক অবস্থার কথা। কোনোদিন হয়তো পেট ভরে খেয়ে সকালে কাজেও যেতে পারে না, হলেও আধপেটে! অনেক সময় ঋণ শোধ করতে গিয়ে তাও জোটে না।
এগিয়ে যাচ্ছে দেশ, বেড়েছে মাথাপিছু আয়। কিন্তু ‘দু’টি পাতা একটি কুঁড়ি’র নিচের অন্ধকার যেন কমেই না। এখনও মানবেতর জীবনযাপন করছেন এই কারিগররা। আর দশজন মানুষের মতো নির্বাচনে ভোটও দেন তারা, কিন্তু পরিবর্তন হয় না তাদের ভাগ্যের। ভাগ্যের ‘পরিবর্তন’ দূরের ব্যাপার, মৌলিক অধিকারের একটিও জোটে না এই চা শ্রমিকদের কপালে।
এই শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি মাত্র ৮৫ টাকা, যা অন্য যে কোনো শ্রমিকের মজুরির তুলনায় কম। তারওপর নেই কোনো স্বাস্থ্য সেবা, নেই শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষার ব্যবস্থাও। এমনকি বাসস্থানেরও নিশ্চয়তা নেই তাদের।
শুক্রবার (১৫ জুলাই) চায়ের রাজধানী খ্যাত শ্রীমঙ্গলের মাধবপুরসহ বিভিন্ন চা বাগানে কর্মরত শ্রমিক ও বাগান সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া যায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেড়’শ বছরেরও বেশি সময় ধরে বংশ পরম্পরায় চা বাগানে কাজ করছেন এ শ্রমিকরা। কিন্তু এ সময়েও প্রাপ্ত মজুরি মিলছে না তাদের।
এমনকি সন্তানদের স্কুলে পড়াশোনা করানোরও সুযোগ পাচ্ছেন না তারা। অনেক সময় মেলে না চিকিৎসা সেবাও। সবরকম সুবিধাবঞ্চিত হয়ে বাধ্য হয়েই মা-বাবার পেশাকেই বেছে নেন বাগানের শিশুরা।
পাত্রখলা চা বাগানে কথা হয় নেবুলাল ভরের সঙ্গে। বয়সের ভারে ন্যুজ না হলেও অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে বেশ বয়স্কই মনে হয় তাকে। ছয়জনের সংসারে তিনজন কর্মক্ষম।
বললেন, আমাদের অবস্থা খুব ভালো না। অনেককেই বলেছি বাবু, কিন্তু কোনো কাজ হয় না। আমরা রুজি পাই ৮৫ টাকা। যা দিয়া খরচ চলে না, খোরাকও চলে না। কষ্ট কইরাই দিন কাটাই।
‘সপ্তাহে কমপক্ষে সাড়ে চারশ’ থেকে চারশ’ ৯০ টাকা রুজি পাই। পাই তিন কেজি আটাও,’ বলেন চা শ্রমিক নেবুলাল।
জানা যায়, মৌলভীবাজারে ৯২টি, হবিগঞ্জে ২৪, সিলেটে ২০, চট্টগ্রামে ২২, রাঙামাটি ও ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় একটি করে মিলিয়ে দেশে মোট ১৬০টি চা বাগান আছে। এর মধ্যে শ্রমিক ১ লাখ ২২ হাজার, যার ৯০ শতাংশই নারী।
শ্রমিকরা জানান, এক নিরীখ চা পাতা উত্তোলন করলে (এক নিরীখ=২৩ কেজি) তাদের ৮৫ টাকা দেওয়া হয়। দৈনিক একজন শ্রমিক ৪০ থেকে ৪৫ কেজি চাপাতা তুলতে পারেন। তবে গড়ে এক সপ্তাহ পরপর মজুরি পান তারা।
বাগানের ভেতর নির্দিষ্ট এলাকায় ৮ হাত বাই ১২ হাত এক-একজন চা শ্রমিকের ঘর। সেখানে পরিবারের ৮ থেকে ১০ জন সদস্যকে নিয়ে বাস করেন তারা।
মজুরির বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, ২০০৭ সালে দৈনিক মজুরি ছিলো ৩২ টাকা ৫০ পয়সা, ২০০৯ সালে ৪৮ টাকা, ২০১৩ সালে হয় ৬৯ টাকা। বর্তমানে তা হয়েছে ৮৫ টাকা।
এ অর্থে কীভাবে সংসার চলে? জানতে চাইলে রাজ্যের হতাশা ভর করলো নেবুলাল ও রেণুবালার মুখে। রেণুবালা বলেন, চলাই যায় না। আমি আর আমার স্বামী কাজ করি, কিন্তু ঘরে ছয়জন নির্ভরশীল আছে৷ বর্তমানে যে রুজি পাই, তা দিয়ে কোনো মতেই চলে না। আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ।
শুধু রেণুবালাই নন, তার মতো আরও অনেক শ্রমিকেরই একই অবস্থা বলে আলাপ করে জানা গেছে।
ব্রিটিশ আমলের অসহযোগ আন্দোলন থেকে শুরু করে চা শ্রমিকরা অংশ নিয়েছেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও। একাত্তরে শ্রীমঙ্গলের তেলিয়াছড়া চা বাগানে ১১ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ওই চা বাগানে নিহতদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে।
বরাবর ত্যাগের সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত দেখানো এই পরিশ্রমী শ্রমিকদের ভাগ্যোন্নয়নে তাদের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ ও সন্তানদের জন্য পর্যাপ্ত স্কুল প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছেন চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা পরাগ।
** পর্যটনে আকর্ষণ তারাও
**স্বচ্ছ লেকে লাল শাপলার নিমন্ত্রণ
** ‘মৌলভীবাজার রুটের অধিকাংশ যাত্রীই পর্যটক’
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৭ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০১৬
এমএ/এইচএ/