চুনারুঘাট (হবিগঞ্জ) থেকে: রাত থেকেই আকাশ গলে বৃষ্টি নামছে। খোয়াইয়ের জলে খুব একটা পরিবর্তন নেই তাতে।
এ সময়টায় সেকেন্ডে ২২৮ কিউসেক পানি বয়ে যাওয়ার কথা বারোমাসী প্রবাহের খোয়াইয়ের বুক চিরে। গভীরতা থাকার কথা ৬ মিটার। কিন্তু স্রোতের গতিতে তার লেশমাত্র নেই। ৭০ মিটার প্রশস্ত নদী বুকের বড়জোর ২৫ মিটার জুড়ে পানি বইছে। দীর্ঘদিন পূর্ণ প্রবাহ না থাকায় দু’পাশের অবশিষ্ট নদী বুকে ঘাস লতা-পাতার রাজত্ব। বহমান স্রোত ঘেঁষে কলাবাগান, বারপোস্টসহ খেলার মাঠও আছে।
এই নদীতে যে কয়েক দশক আগেও বড়-বড় নৌযান চলতো, নদী পার হতে হতো ফেরি-নৌকায়, তা আর ধারণা করারই জো নেই। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে উৎপত্তি এই খোয়াই নদীর। ত্রিপুরা রাজ্যের দ্বিতীয় দীর্ঘতম এই নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে। তারপর হবিগঞ্জ সদর, বানিয়াচং ও লাখাই এর ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কালনীতে পড়েছে লাখাইয়ে।
বাংলাদেশ অংশে এর দৈর্ঘ্য ৯৪ কিলোমিটার। অববাহিকার আয়তন ৪৩৫ বর্গকিলোমিটার। হবিগঞ্জের একটা বড় অংশে পানি ও পলির উৎস্য এই নদী। ভারত-মিয়ানমারের সীমান্ত পেরিয়ে যে ৫৮টি নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে তার ১৮টিই এই বৃহত্তর সিলেটে। সেগুলোরই অন্যতম একটি হলো এই খোয়াই নদী। হবিগঞ্জে খোয়াইয়ের মতো সুতাং আর সোনাই নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ভারত থেকে। বৃহত্তর সিলেটের অন্যান্য নদীগুলোর মধ্যে সুনামগঞ্জে দামালিয়া/যালুখালি, নোয়াগাঙ, উমিয়াম, যাদুকাটা, সিলেটে ধলা, পিয়াইন, সারি-গোয়াইন, সুরমা, কুশিয়ারা, সোনাই বরদল এবং মৌলভীবাজারে জুরি, মনু, ধলাই, লংলা এসেছে সীমান্ত পেরিয়ে। এছাড়া শেরপুর হয়ে ভোগাই আর নেত্রকোনা হয়ে সোমেশ্বরী এসেছে সুনামগঞ্জ জেলায়। সব নদীর অবস্থায়ই হয়তো এখন এই খোয়াইয়ের মতোই প্রাণহীন।
শ্রীমঙ্গল ছাড়ার পর পুরোটা পথ জুড়েই দু’পাশে সঙ্গী ছিলো চা বাগান। বৃষ্টিভেজা খোয়াই পেরিয়ে শায়েস্তাগঞ্জ বাজারে এসে সকাল ৮টায়ও কোনো হোটেল খোলা পাওয়া গেলো না। মেজর জেনারেল এম এ রব চত্বরে মু্ক্তিযুদ্ধের উপ-সেনাপতির নাম ফলক ঢেকে গেছে রাজনৈতিক পোস্টারে। চত্বরের চারিপাশ কাদায় মাখামাখি। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ঢাকার দিকে কিছু দূর এগিয়ে হাতের বাঁয়ে চুনারুঘাটের রাস্তা।
কয়েক কিলোমিটার এগোনোর পর পূর্ব দিকে মুড়ারবন্দরের রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে প্রায় ৪ কিলোমিটার এগিয়ে পাওয়া গেলো সিপাহসালার নাসির উদ্দিনের মাজার। সিলেট জয়ী হযরত শাহজালালের প্রধান সেনাপতি সিপাহসালার নাসির উদ্দিন। সিলেট জয়ের পর তরফ জয়ে তিনি পাঠিয়েছিলেন তার প্রধান সেনাপতিকে। ৩৬০ আউলিয়ার ১২০ জনই ছিলেন সেই অভিযানে।
তরফ জয়ের পর এখানেই আস্তানা গাঁড়েন তারা। সিপাহসালার নাসির উদ্দিনের মাজার ঘিরে এখনো চিরনিদ্রায় শায়িত ১২০ আউলিয়া। এ জায়গার আর এক নাম তাই ১২০ আউলিয়ার মাজার। তাদের বিজয় চিহ্ন আঁকা তরফ আরো অনেক পরে হবিগঞ্জ নাম হয় সৈয়দ হাবিব উল্লাহ’র নামে।
নাসির উদ্দিনের মাজারের সামনে লিখে রাখা হয়েছে ‘দ্য গ্রেভ অব নাসির উদ্দিন হু কনক্যুয়ারড তরফ’। দক্ষিণ পাশে পুরনো স্থাপত্য কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ এখনো গৌরবময় অতীতের চিহ্ন বইছে। কয়েক খণ্ডে বিভক্ত প্রাচীন ইটের দেওয়ালে শ্যাওলা, পরগাছার উৎপাত। এর পূর্বদিকে সিপাহসালার নাসির উদ্দিনের ধ্যান গুহা। রড দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া প্রাচীন পোড়া ইটের গুহাটির মুখ।
কালো পাথরের একটি শিলালিপি ছিলো নাসির উদ্দিনের মাজারে। ভগ্ন অবস্থায় দীর্ঘ দিন সেটি পড়েছিলো এখানে। বর্তমান মোতোয়াল্লি সৈয়দ শফিক আহমেদ জানালেন, কয়েক বছর আগে চুরি হয়ে গেছে শিলালিপিটি। সঙ্গে হারিয়ে গেছে অকাট্য ইতিহাসও।
আরও পড়ুন..
**চেনা-অচেনা বন্য প্রাণীদের সঙ্গে লুকোচুরি
**বেটা-বেটির পুঞ্জি ঘুরে বীজহীন বাগানে
** রাত দুপুরে গভীর বনে ভয়ের সঙ্গে পাঞ্জা
** বন্যপ্রাণির বুনো গন্ধে মাতাল লাউয়াছড়ার রাত
**তপ্ত জলে মিশে আছে নির্মাইয়ের কান্না
** চায়ের রাজধানী সবুজ শীতল শ্রীমঙ্গলে
**৪ ঘণ্টায় চায়ের দেশে
**ট্রেন চলেছে চায়ের দেশে
বাংলাদেশ সময়: ১০০৬ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০১৬
জেডএম/