রাঙামাটি থেকে: সকালটা এতো সুন্দর হবে ভাবনায় ছিলো না। কাকডাকা ভোরের হালকা শারদীয় কুয়াশায় সেনানিবাস এলাকা থেকে অটোরিকশায় রিজার্ভবাজার লঞ্চঘাট।
‘লংগদু দুর্গম এলাকা, একদিনে যাওয়া-আসা করা কঠিন। পর্যটকরাও সেভাবে যায় না। ওখানে তো দেখার কিছু নেই। ’
রাঙামাটির সবশ্রেণীর মানুষের মুখের এ বুলিটি কতটুকু সত্য তা যাচাই করতেই বছরজুড়ে দেশ ঘুরের একটি টিমকে পাঠালেন ট্যুর প্ল্যানার সিনিয়র আউটপুট এডিটর জাকারিয়া মন্ডল। রওয়ানা দেওয়ার আগও শঙ্কা ছিলো কেমন যে হবে!
সকাল সাড়ে ৭টার এ ট্রিপ রাঙামাটি শহর থেকে সরাসরি লংগদু যাওয়ার একমাত্র রুট কাপ্তাই লেকের সবুজ স্বচ্ছজল ঠেলে এগোতে লাগলো। রবির কিরণও তখন সবে ছড়াতে শুরু করেছে। আধঘণ্টার মধ্যে জারুলছড়ির কাছে আসতেই সৌন্দর্য যেন পেখম মেলতে শুরু করলো। ডানে পুব দিকে যে চ্যানেলটি চলে গেছে জারুলছড়ির দিকে সেখানে পানির উপর যেন ভেসে ছিলো ড্রাগন কিংবা দানকায় ডাইনোসরের প্রতিমূর্তি। পাহাড়ি গ্রাম জারুলছড়ি ছাড়াতেই স্বাগত জানালো বরকল উপজেলা। দুপাশের সবুজ বড় বড় বৃক্ষঘেরা পাহাড়গুলো ক্রমে ছুঁতে লাগলো আকাশ! আরেকটু এগিয়ে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছালো রাঙামাটির পর্যটন আকর্ষণের অন্যতম স্পট শুভলং ঝরনা।
ক্ষীণকায় সে ঝরনার শীর্ণ ধারা চোখ তো বটেই ক্যামেরায় লম্বা চোখেও ধরা পড়া দুষ্কর!
পর্যটকদের জন্য একটু মায়াই হলো! এটা দেখতেই এতো…! অবশ্য ঝরনা যাই থাক দুঃখ ভোলাবে দুপাশের পাহাড়চূড়া। স্বর্গীয় একধরনের অনুভূতি যেন! সকালের স্নিগ্ধ রোদের ঝিলমিলে আলো সবুজ গাছগুলোতে যে আলো ফেলছিলো সে আলোর স্বর্ণাভায় মোহমুগ্ধ হয়ে যেন হাসছিলো পাহাড়ি প্রকৃতি।
শুভলংয়ে ধনা মিয়ার দ্বীপ মাজার পেরিয়ে স্টিমারের গতিমুখ যখন ৯ নম্বর হাজাছড়ার দিকে, তখন পুবের আলো পশ্চিমের আকাশে পড়ে নীল-সবুজ রঙে ছবি আঁকছে লেকের স্বচ্ছ পানিতে। মানুষ কেন ইউরোপ-আমেরিকা ঘরতে যায়! প্রশ্ন জাগছিলো বারবার। যাত্রাপথে আমাদের সঙ্গ দিচ্ছিলেন লংগদু উপজেলা অফিসে কর্মরত আলফাজ আহমেদ। বলা যায় অচেনা এ জগৎ হাতে ধরে পথ পার করছিলেন তিনিই।
আলোচনা উঠতেই তিনিও জোরালো গলায় বললেন, নিজে যাইনি, তবে ইউরোপ-আমেরিকার প্রকৃতির যে ছবি দেখি তা থেকে ঢের সুন্দর, সম্ভাবনাময় আমাদের এ যাত্রাপথ। কদিন আগে ইউরোপের মেসিডোনিয়ার অখ্রিদ লেকের যে ভ্রমণ বৃত্তান্ত বাংলানিউজে পড়ছিলাম এবং দেখছিলাম ছবি তার তুলনায় কোনো অংশে কম তো নয়, বরং অনেক অনেক বেশি সুন্দর আমাদের এ যাত্রাপথ।
গড়ে ১৮-২০ কিলোমিটার গতিতে চলা স্টিমারটি যখন ১০ নম্বর বরুণছড়ি পার হলো তখন সৌন্দর্য রূপ বদলালো। সে সুন্দরকে কি বলা যায় ঠিক জানি না, বলা যায় সৌন্দর্যের সৌন্দর্য বেড়ে গেলো আরও। সঞ্জয় দে’র অখ্রিদ লেকের সেই ভ্রমণকাহিনী কদিন মোহ তৈরি করলেও তা ভঙ্গ হলো দ্রুতই। তখন আমরা কাট্টলি বিলে। এটিও লেকেরই অংশ। দেশি মাছের প্রজনন ও উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত।
জেলেদের দেখা গেলো নীল জলে ছোট্ট ছোট্ট ডিঙি নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে। লেকের দু’পাশে উঁচু পাহাড়। মেঘ এসে সেখানে ভর করছে মাঝে মধ্যে। জানতে ইচ্ছে হলো অখ্রিদে কি এতোসব আছে!
আলফাজ জানান, শীতের সময় এখানে পানি আরও নীল দেখায়। আকাশের সব নীল যেন ঢলে পড়ে জলে। তখন হাজার হাজার পরিযায়ী পাখিতে মুখর থাকে এ লেক। স্টিমারকে তখন ছুটতে হয় পাখিদের সে সমাবেশ ঠেলে।
এসময়ও নাকি এদিকে পর্যটকরা আসেন না। কারণ তারা জানেন না এদিকটা কত সুন্দর। সাড়ে তিন ঘণ্টার যাত্রাপথ সত্যি সব কষ্ট, বেদনা, ইহজাগতিক বিরক্ত অনুভূতি ভুলিয়ে দেওয়ার মতো। সব উবিয়ে দেওয়ার মতো রূপের সব ডালি সাজিয়ে বসে আছে লংগদু পর্যন্ত। যতই ভুলে থাকতে চাই এখানে এলে মনে করাবেই কবির সেই চিরসত্য চরণ, ‘ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া…’।
আমরা দেখি না, দেখার চেষ্টা করি না, তাই খুঁজে পাই না। সত্য মনে হলো বারবার। আবার কবি ভাবায়, মনে করিয়ে দেয়,আসুন, ‘আমাদের ছবির মতো দেশটাতে বেড়িয়ে যান। ’
যেভাবে যাবেন:
শহরের সেনানিবাস এলাকা থেকে রিজার্ভ বাজার পর্যন্ত অটোরিকশা ভাড়া পড়বে ১০০ টাকা। এখান থেকে লংগদুগামী স্টিমার ছাড়ে সকাল সাড়ে ৭টা, সাড়ে ১০টা, ১২টা ও দুপুর ২টা। সময় লাগবে সাড়ে ৩ ঘণ্টা। ভাড়া জনপ্রতি ১৪৫টাকা দোতলায়। নিচে ১১৫ টাকা। তবে ফিরতি বোট লংগদু থেকে সবশেষ দুপুর ১টা ৩০। লংগদুতে ২ ঘণ্টায় দেখতে পারবেন বেশ কয়েকটি বৌদ্ধবিহার।
আরও পড়ুন:
**ধসে যাচ্ছে রাঙামাটি শহরের পর্যটন
** রাঙামাটিতে বোটভাড়া নিয়ে ঠকবেন না যদি…
**বিকেলটা কাটুক হেরিটেজ পার্কে
**দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম বুদ্ধমূর্তির দেশে
**পাহাড়ের ঐতিহ্যবাহী সব খাবার ‘সিস্টেমে’
**বাঁশের ভেতর মুরগি, পদের নাম ব্যাম্বো চিকেন
**পাহাড়ের সবুজ মাল্টায় দেশজুড়ে বিপ্লব
বাংলাদেশ সময়: ১২১১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৭, ২০১৬
এএ/এইচএ/