রাঙামাটি ঘুরে: ঘন গাছপালায় নিচে সাপের মতো আঁকাবাকা ছড়া। বুকে তার নানা আকৃতির পাথর আর নুড়ির মেলা।
দু’পাশ থেকে ছড়ার উপরে ঝুঁকে আসা গাছগুলো ডালপালার ছাদ গড়ে দিয়েছে মাথার উপর। এখানে তাই সূয্যি মামার প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। তবুও গাছপালাগুলো কি সতেজ, সবুজ।
কাঁচা বাড়িঘরের ফাঁক গলে মানিকছড়ি খাল ডিঙ্গোনোর সময়েও ঠিক বুঝা যায়নি কতোটা সৌন্দর্য সাজিয়ে রাখা আছে সামনে। পরতে পরতে এখানে নিজেকে মেলে রেখে প্রকৃতি। সাজিয়ে রেখেছে অফুরন্ত বিস্ময়।
সেই বিস্ময় আরো বাড়িয়ে দিতেই যেনো হুট করে উদয় হলো প্রাণচঞ্চল এক শিশু। অবতীর্ণ হলো স্বেচ্ছাসেবি গাইডের ভূমিকায়। নাম তার আনোয়ার হোসেন। তার পিছু পিছু আর একটু সামনে এগুতে এলো আর এক শিশু মোহাম্মদ জকির। এরপর সঙ্গী হলো রমজান হোসেন।
প্রথম দু’জন পড়ে ক্লাস ওয়ানে। তৃতীয়জন ক্লাস টু’র ছাত্র। প্রাণচঞ্চল তিন শিশুর পিছু পিছু আরো কিছু দূর এগুতেই দু’পাশের খাড়া পাহাড় ঘিরে ধরলো যেনো। গামারি, তেঁতুল, কলা আর সজনে ডাঁটার গাছ দেখা যাচ্ছে না আর। পাহাড়ের খাড়া দেওয়ালে ঝুলে নেই জংলি কচু আর ঝাড়ু ফুলের ঝোপও। প্রাণহীন পাথুরে দেওয়াল যেনো দাঁত বের করে ভেংচি কাটছে। আর দেওয়ালের চোখা মাথাগুলো ছুঁতে চাইছে আকাশ।
অন্তত ৪০ ফুট উঁচু থেকে নেমে আসা একটি ঝরনা পড়লো হাতের বাঁয়ে। সেই ঝর্নার রূপসুধা পান করে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিতেই তিন শিশুর বাগড়া। কিছুতেই ফিরতে দেবে না তারা। মূল ঝরণা নাকি সামনে।
কিন্তু কিছু দূর এগুতেই প্রশস্ত এক জলপ্রপাত বাধা হয়ে দাঁড়ালো প্রশস্ত এক জলপ্রপাত। জমাট বাঁধা পাথর এখানে ঘরের টাইলসের মতো মসৃণ। কিন্তু কি দারুণ দক্ষতায় চোখের পলকে ১২ ফুট দেওয়ালের উপরে উঠে গেলো রমজানরা।
সেই বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই ক্লাস ওয়ানের ছোট্ট আনোয়ার ওপর থেকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো-স্যার হাত ধরেন। শরীরের ওজন তার কেজি বিশেক হবে কি না সন্দেহ আছে। অথচ কি সাবলীল বিশ্বাসে ৮০ কেজি ওজনের মানুষ টেনে তুলতে চাইছে সে!
ওমন অবিশ্বাস্য সাহস বুঝি অন্যের ভেতর ছড়িয়ে পড়তে সময় নেয় না। অসম্ভব মনে করে দাঁড়িয়ে থাকা জনা চারেক শহুরে সাংবাদিকের ভেতরও তাই অসীম সাহস ভর করে। একটু সময় নিলেও জলপ্রপাতের ছাদের উঠে পড়ে পুরো দল।
কখনো ডানে, কখনো বাঁয়ে ঘুরতে হচ্ছে ছড়ার স্রোত ধরে। স্রোতের নিচে অবিন্যস্ত পাথরে শ্যওলার দাপুটে উপস্থিতি। পা হড়কালেই বিপদ। তবুও তিন শিশুর তরতরিয়ে পাহাড়ের দেওয়াল বাওয়া মনের ভেতর অ্যাডভেঞ্চারের সব ক’টা বন্ধ দরোজা খুলে দেয়। টারজানের মতো গাছের ডাল ধরে আর একটা পিচ্ছিল জলপ্রপাত ডিঙ্গোতে তাই সমস্যা হয় না। তারপর ফের চলতে থাকে ক্লান্ত পা। দু’পাশে আরো সাহস যোগায় পাহাড়ের দেওয়াল চুইয়ে নামা ছোট ছোট পানির ধারা। কোনো কোনোটাতে জংলি লতার পাইপ বসিয়ে দিয়েছে রজমানরা। এতো বেশি ছড়ার জন্যই বোধ হয় হাজার ছড়া নাম এই ঝরনার। রাঙ্গামাটি শহর থেকে কাউখালির পথে ১৫ কিলোমিটার এলে হাতের বাঁয়ে কলবাগান বসতির পেছন থেকে যার ট্রেইল শুরু।
দু’পাশে পাহাড়ের দেওয়াল এবার আরো খাড়া। তারওপর আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকা চোখা চূড়াগুলো ভেতরের দিকে ঝুঁকে এসেছে বেশ। হাতের বাঁয়ে একটা পাথরের স্তূপ দেখিয়ে রমজান জানালো, ক’দিন আগের পাহাড় ধসের পাথর ওগুলো।
পাহাড় ধসের কথা শুনে ভয়ের একটা শিরশিরে স্রোত নেমে গেলো শিরদাঁড়া বেয়ে। ওমন পাথর ধসে পড়লে তো হাড়-মাংস আর আলাদা করার দরকার হবে না। কিন্তু এই তিন সাহসী শিশুকে সে কথা বুঝতে দেওয়া অবান্তর।
ভয় না পাওয়ার ভান করে তাই ফের ঢালু ছড়া বাওয়া শুরু হলো। পাথরের ওপর পানি আছড়ে পড়ার শব্দ পাওয়া গেলো এবার। আরো ক’মিনিট এগুতে বিস্ময়ে হতবাক। ফুট চারেক উঁচু প্রাটফর্মের ওপর পানি পড়ছে অন্তত ৫০ ফুট ওপর থেকে। সংকীর্ণ এই গিরিখাদে ঝরণার গোড়াটা এতো উঁচু যে ঘাড় বাঁকা করে আকাশ পানে মুখ না করলে পুরোটা দেখাই যায় না। ঝরনার নেমে আসা আর সাদা আকাশ নজরে আসে এক সঙ্গে। সংকীর্ণ গিরিখাদে পায়ের নিচে এরই মধ্যে জমে গেছে কয়েকশ’ ফুট উঁচু পাহাড়।
পানি যেখানটা দিয়ে পড়ছে সেখানে কি করে যেনো দাঁড়িয়ে আছে একটা ঝাঁকড়া জংলি গাছ। ভয় জয় করে এতো দূর আনার জন্য এই তিন বিস্ময়বালকের কাছে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা তো অনেক আগেই হারিয়ে গেছে।
** পাহাড়ের উপরে দেবতার পুকুর
** পাহাড়ের খাদে রাম-সীতার ধুমনিঘাটে
**বাঁশের রাজবাড়িতে এক চক্কর
**বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া ভারতীয় বাঁকে
** বয়সী বটের নিচে বিশ্বাসের বাসা
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৭, ২০১৬
জেডএম/