বিলাইছড়ি (রাঙামাটি) ঘুরে: তবলছড়ি ঘাট থেকে কাপ্তাই লেকে ভাসতে না ভাসতেই চোখে ধরা পড়লো ভৌগলিক সত্যটা। লেকের দু’পাড়ে শেকলের মতো বিছিয়ে আছে পাহাড় শ্রেণি।
আর সেই শেকল পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে আসন গেঁড়েছে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ। গাছগাছালিতে ছাওয়া সবুজ পাহাড়ের চূড়াগুলোও ছুঁয়ে আছে অলস মেঘের দল। যেনো সবুজ পাহাড়ের ওপর মেঘ পাহাড়ের আলপনা। আর লেকের জলে কিছু দূর পরপরই ছোট ছোট দ্বীপের মতো সবুজ গ্রাম।
লেকের নিস্তরঙ্গ জলে ঢেউ তুলে ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার গতিতে একটানা ছুটে চলেছে ইঞ্জিন বোট। বর্ষার রেশ এখনো কাটেনি বলে লেক ভর্তি পানি। তাই লেকের জলে ডুবে যাওয়া কর্ণফুলির কোর্স ধরতে হলো না সৈয়দের ট্রলারটাকে। কখনো পাহাড়ের ফাঁকে, কখনোবা ডুবে যাওয়া চাষের জমির ওপর দিয়ে বোট ছুটলো দুর্গম বিলাইছড়ির দিকে।
পেছনে পড়ে রইলো একটা দু’টা পাহাড়ি বাজার, পাহাড়ি চূড়ার নি:সঙ্গ জুমঘর আর পাহাড়ের শরীরে ঝুলে থাকা টিন-চালার বাড়ি-ঘর। সোয়া দু’ঘণ্টার মাথায় বোট ভিড়লো বিআউডব্লিউটিএ’র নৌঘাটে। ঘাট থেকে ক্রমশ: উপরে উঠে গেছে ইট বিছানো রাস্তা। দু’পাশে দোকানপাট। পাহাড়ের মাথায় বসা বাজারটায় বিকিকিনি বোধ হয় একটু কমই।
আশেপাশে ঘুরেও কোনো পরিবহন চোখে পড়লো না। এমনকি রিকসাও নয়। চোখে পড়লো না পাকা রাস্তাও। ইট বিছানো পথে আরো এগিয়ে থানাটাকে বাঁয়ে রেখে কয়েক মিনিটেই নলছড়ি ঘাট। ঘাটে নামার সিঁড়িগুলো খাড়া।
মানেন্দ্র চাকমা নামে এক স্থানীয় গাইডের হাতে নিজেদের সঁপে দিয়ে ফের জলে ভাসা। মিনিট বিশেকের মাথায় নৌকা গিয়ে থামলো ন’কাটা ছড়ার পতিত মুখের কাছে দেওহাটায়। জলঘেরা ধানক্ষেত পেরিয়ে শুরু হলো ছড়া ধরে হাঁটা। কখনো তীর কখনো ছড়া ধরে হাঁটার পর পুরোপুরি পাথর বিছানো ছড়ার বুক বেয়েই এগুতে হলো।
শ্যাওলা জমে পিচ্ছিল হওয়া পাথর মাড়িয়ে চলতে হলো সাবধানে। এরই মধ্যে ছড়ার দু’পাশের বন আরো ঘন হয়ে উঠেছে। বনের মাথায় থমকে গেছে সূর্য়। ছড়ার বুকে সেগুন, গামারি আর বুনো ঝোপের শীতল ছায়া। কোথাও কোথাও উপর থেকে ঝুলে থাকা মোটা মোটা লতায় টারজানের মতো ঝুলে পড়ার ইশারা। সামনে ছড়ার ঢাল উপরে উঠছে তো উঠছেই। পাথরের ফাঁকে ফাঁকে কুলকুল করে বইছে শীতল স্রোত।
সময় কম বলে পা না চালিয়ে উপায়ও নেই। টানা আধা ঘণ্টা হাঁটার পর ন’কাটা ঝরনার পাদদেশে পৌঁছে সব ক্লান্তি উবে গেলো নিমিষে। অনেক উঁচু থেকে আছড়ে পড়ছে জলরাশি। জলের কণা কয়েক হাত দূরে এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে শরীর। আহ, কি শান্তি। পানির ছটার এমন আদরে শেষ তক ঝরনার কাছে সঁপে দিতেই হলো নিজেদের। কয়েক মন ওজন নিয়ে যেনো মাথা-পিঠে আছড়ে পড়তে শুরু করলো পানি। কয়েক মিনিটেই ফের তরতাজা হয়ে উঠলো ক্লান্ত শরীর।
এবার ঝরণার পাশ দিয়ে খাড়া উঠে যাওয়া পিচ্ছিল ট্রেইলটায় তরতরিয়ে উঠে গেলো মানেন্দ্র। তাকে অনুসরণ করে শহুরে চার সাংবাদিকও উঠলো বটে, কিন্তু সময় লাগলো ঢের বেশি। এবার শুরু হলো গর্জনরত ঝর্নাকে নিচে রেখে পিচ্ছিল পাহাড় বাওয়া।
কয়েক মিনিট এগুনোর পর পৌছা গেলো জলপ্রপাতের ছাদে। তারপর আর একটা প্রপাত পেরিয়ে জনমানবহীন গহীন অরণ্য পথে সামনে এগুতে হলো। কখনো ডানে, কখনো বাঁয়ে বেঁকে আর একটা ঝরনা এসে মিশেছে ন’কাটায়। মপ্পু নামে এক মারমা এখানে জুম চাষ করতো বলে তার নামেই এ ঝরনার নাম।
ন’কাটা আর মপ্পুর মোহনা পেরুনোর পর পথ হয়ে উঠলো আরো দুর্গম। খানিকক্ষণ থমকে থাকার পর বারবার ফেরার ভাবনাটা সামলে ফের শুরু হলো সামনে এগুনো। কয়েক দফা ছড়া ছেড়ে পিচ্ছিল পাহাড় বাওয়ার পর ফের ছড়ায় ফিরে এগুতে হলো। পেরুতে হলো ছোট ছোট অনেকগুলো প্রপাত।
অবশেষে দেখা মিললো মপ্পু ঝরনার উৎস্যমুখের। অনেক উঁচু থেকে আছড়ে পড়ছে পানি। পাথরে পড়ে গর্জন তুলছে যেনো। ঝরনার গোড়াটা দেখতে মাথা উঁচু করে আকাশ পানে তাকাতে হচ্ছে। এ স্থানের উচ্চতা কিছুতেই সাতশ’ ফুটের কম হবে বলে মনে হলো না।
এমন সুন্দর ঝরনা ছেড়ে ফিরে যেতে মন চায় না। কিন্তু ফেরার তাড়া আছে। দুপুর ২টায় লঞ্চ ছাড়বে রাঙামাটির। ওটা মিস করলে পরদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া বিকল্প নেই। কিন্তু পিচ্ছিল পাহাড় বেয়ে নামার কথা মনে আসতেই ভেতরে ভেতরে দমে যেতে শুরু করলো এতোক্ষণ সীমাহীন সাহস দেখানো সাংবাদিক বাহিনী।
কিন্তু ফিরতি পথে নামতে শুরু করলো ঠিকই।
বাংলাদেশ সময়: ০২১১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৮, ২০১৬
জেডএম/