হাজারছড়া ঝরনা (রাঙ্গামাটি) ঘুরে: চাকমা রাজার বাড়ির খোঁজে রাঙ্গামাটি শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে কাউখালী বাজার পযর্ন্ত ঢুঁ মেরেও কোনো ফল হল না।
আমরা খুঁজছি চাকমা রাজার বাড়ি।
কাউখালী বাজার থেকে রাঙ্গামাটি শহরের দিকে ১২ কিলোটার আসার পর ঘাগড়া আর্মি ক্যাম্প। এই ক্যাম্প থেকে শহরের দিকে আরো প্রায় ১ কিলোমিটার অগ্রসর হয়ে মহাসাড়কের পাশে যখন গাড়ি থামলো, তখন সূর্য পশ্চিম দিকে হেলতে শুরু করেছে।
চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি মহাসড়কের পাশে পাহাড় ঘেষা গ্রাম ঘাগড়া কলাবাগন পাড়া। সেখান থেকে হাজারছড়া ঝরনার দূরত্ব এক কিলোমিটারের বেশি।
দুর্গম পাহাড়ি ছড়ার পথ। তার উপর আবার অচেনা। লোকজনের যাতায়াতও কম। তাই গাড়ি থেকে নেমে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি, গাইড হিসেবে স্থানীয় একটা লোক যদি পাওয়া যায়।
এরইমধ্যে কোথা থেকে তিন শিশু এসে বলল-ঝরনা দেখতে যাবেন? এদিক দিয়ে আসেন- বলেই সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করলো তারা।
হাজারছড়া ঝরনা কতদূর, যেতে কতক্ষণ লাগবে? জিজ্ঞেস করতেই অচেনা এই দুর্গম পথে আর্শীবাদ হয়ে আসা মো. রমজান হোসেন, মো জকির হোসেন ও মো. আনোয়ার হোসেন নামের ওই তিন শিশুর উত্তর- বেশিদূর না। ১ কিলোমিটার হবে। সময় লাগবে আধা ঘণ্টা!
এই পরন্ত বেলায় পায়ে হাঁটা ১ কিলোমিটার পাহাড়ি দুর্গম পথ ওদের কাছে বেশি দূর না। আধা ঘণ্টা সময়ও ওদের কাছে তেমন কিছু না! কিন্তু দূরত্ব এবং দূরত্বের সঙ্গে মেপে সময়ের যে হিসাব ওরা দিলো, আমাদের কাছে তা রীতিমত শিউরে ওঠার মতো।
তবুও ওদের তিনজনকে অনুসরণ করে সামনে এগোতে লাগলাম। কোয়ার্টার কিলোমিটার যাওয়ার পর প্রথম ঝরনাটা দেখে ভাবলাম, আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গেছি। অবুঝ তিন শিশু দূরত্ব এবং সময়ের যে হিসেব আমাদের দিয়েছে, তা নেহায়াত অনাভিজ্ঞতা প্রসূত ও অনুমান নির্ভর!
কিন্তু ওরা ডান দিকে ১৯০ ডিগ্রি বাঁক নিয়ে বলল, আংকেল চলে আসেন। বড় ঝরনা সামনে! একটু কষ্ট করে উপরে উঠে আসেন।
ঝরনার তোড়ে পাহাড়ের পলি মাটি কংক্রিটের মতো শক্ত ও কাচের মতো স্বচ্ছ আকার ধারণ করেছে। তারপরও ২০/৩০ ফুট উচুঁ একেকটা ধাপ বেয়ে ওপরে ওঠা আমাদের কাছে দূরুহ ব্যাপার মনে হচ্ছে।
কিন্তু ধাই ধাই করে উপরে উঠে ৭, ১০ ও ১১ বছরের তিন শিশু আনোয়ার হোসেন, রমজান হোসেন ও মো. জকির আমাদের অভয় দিচ্ছে- চলে আসেন। আর বেশি দূর নাই!
আরো প্রায় হাফ কিলোমিটার গিয়ে দ্বিতীয় ঝরনাটি যখন চোখে পড়লো, তখনও ভাবলাম এই বুঝি গন্তব্যে পৌঁছে গেছি। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে ওরা বললো, আংকেল আরেকটু যেতে হবে। এই তো বেশি দূরে নয়!
সূর্য পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে গেছে। কিছু ক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার নেমে আসবে। সুতরাং আমরা এবার আমরা গো ধরলাম। আর যাব না। এখান থেকেই ফেরা যাক। কিন্তু ওরা তিন জন নাছোরবান্দা। আর আমাদের টিম লিডার? উনিও কম যান না। দেবশিশু সদৃশ ওই তিন বালককে অনুসরণ করে উনি এগিয়ে চলছেন!
নিতান্ত নিরুপায় হয়ে হাঁটা শুরু করতে হলো! আরো প্রায় কোয়ার্টার কিলোমিটার যাওয়ার পর চোখে পড়লো ১ শ’ ফুট উচুঁ হাজারছড়া ঝরনা। অর্থাৎ আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গেছি।
দুর্গম পাহাড়ের ১ কিলোমিটার শংকুল পথ পাড়ি দিয়ে প্রায় ৬ শ’ ফুট উপরে উঠে ১ শ’ ফুট উচুঁ হাজারছড়া ঝরনা দেখে যতটা অবাক হয়েছি, তার চেয়ে ঢের অবাক হয়েছি এই তিন শিশু ট্যুরিস্ট গাইডকে দেখে।
১৫/২০ কেজি ওজনের এই তিন ‘বিস্ময়বালক’ একবার দুইবার নয়, অসংখ্যবার তাদের দরদী হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেছে, ভয় নেই, উঠে আসেন!
ঘাগড়া কলাবাগানপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া আনোয়ার হোসেন, রমজান হোসেন ও মো. জকির অদূর ভবিষ্যতে নাম করা ট্যুরিস্ট গাইড হলে বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে না।
বরং রাজমিস্ত্রী, ভ্যান ও ট্রলি চালক পিতাদের এই সান্তানরা দারিদ্র্যের কাছে হাড় মেনে যদি পূর্ব পুরুষের পেশা বেছে নেয়, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না!
বাংলাদেশ সময়: ০৮১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৮, ২০১৬
এজেড/এমএ