বগালেক, বান্দরবান থেকে: পৌনে ১ ফুটের মতো লম্বা আর কয়েক সুতো পুরু তুলার খণ্ড। এই খণ্ড থেকে তুলাকে সুতোর মতো টেনে উল্টো লাটিমের মতো বিঘত সাইজের লম্বা একটি যন্ত্রে বেঁধে ঘোরাচ্ছেন মুরং নারী জিতাও লিম।
সত্তরোর্ধ্ব জিতাও রাহাটকে যতো জোরে ঘোরাচ্ছেন, ততো দ্রুত তুলার খণ্ড থেকে সুতো হয়ে যন্ত্রটির গায়ে গেঁথে যাচ্ছে তা। এভাবে তৈরি হচ্ছে এক রাহাট সুতো। এই সুতো দিয়ে তৈরি হবে কম্বল। যে কম্বল টেকে দেড় থেকে দুইশ’ বছর পর্যন্ত।
বান্দরবানের রুমা থেকে শীর্ষ পাহাড়ের চূড়া কেওক্রাডং যাওয়ার পথে বগালেকের ঠিক আগে কমলাপাড়া। এই পাড়ার দোকানে সৌরশক্তি চালিত আলোতে বসে রাহাট ঘোরাচ্ছিলেন জিতাও। দোকানের ক্যাশিয়ার আসনে বসে তার ভাতিজি বউ টুমসিং।
রাহাট ঘোরাতে দেখে ভেতরে গেলে কথা বলেন টুমসিং। জিতাওয়ের সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রে দোভাষীর মধ্যস্থতাও করছিলেন তিনি।
আলাপে জানা গেল, ১০-১২ রাহাট সুতো বানানো হলে তা দিয়ে পাটি বোনার মতো কম্বল গাঁথবেন জিতাও। এ কম্বলের আকার হবে সাত ফুট বাই পাঁচ ফুট। এ কম্বল পুরু হতে পারে কোয়ার্টার ইঞ্চি বা তার কিছু কম। অনেক সময় দুই ফিট বাই দেড় ফুট মতো কয়েক খণ্ড কম্বল গেঁথে সেগুলোর ৩টিকে এক করে তৈরি হয় বড় কম্বল।
তুলাকে সুতোর মতো গেঁথে কম্বল তৈরির গল্প না হয় জানা গেল। কিন্তু পাহাড়ে এতো তুলা আসে কোত্থেকে? টুমসিং বলছিলেন, তুলার জুম চাষ হয় পাহাড়ে।
চাষের জমি থেকে এনে তুলাকে শুকিয়ে আঁখের রস বের করার মতো একটি যন্ত্রে দেওয়া হয়। মুরং ভাষায় সে যন্ত্রটির নাম যুতো। যুতোয় দিলে তুলার বীজগুলো ঝরে পড়ে, আর তুলাগুলো আঁখের পিষে যাওয়া খোলসের মতো রাহাটে বোনার মতো খণ্ড খণ্ড করে বের হয়।
একটি কম্বল বুনতে দিনের স্বাভাবিক কাজকর্ম সেরে লেগে থাকলে সময় লাগে ১ মাসের মতো। দুই ফুট বাই দেড় ফুট কম্বলের খণ্ড তৈরিতে সব কাজকর্ম ছেড়েছুড়ে লেগে থাকলে সময় লাগে ২ দিন।
এই কম্বল মুরংদের নিজস্ব ঐতিহ্য। কম্বলগুলো তৈরি করে তারা কেবল নিজেরাই ব্যবহার করেন। উপহার দেন সগোষ্ঠীর লোকদের। কিন্তু কোনোভাবেই বিক্রি করেন না। সাধারণত তুলার রঙের কম্বল তৈরি হয়ে থাকলেও মাঝেমধ্যে রুমা শহর থেকে রং এনে তা সুতোয় মেখে রঙিন কম্বলও তৈরি করা হয়।
জিতাও তার ভাষায় জানান, এখন পর্যন্ত শ’খানেকের ওপর তুলার কম্বল তৈরি করেছেন তিনি। এই কম্বল তৈরি তার পরম্পরায় শেখা। আর টুমসিং জানান, তার মা তাকে ৫টি তুলার কম্বল বানিয়ে দিয়ে গেছেন।
ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী মুরংদের বসবাস আগে ছিল পাহাড়ের গভীর অরণ্যে, দুর্গম এলাকায়। এখন তারা খানিকটা জনচলাচলের জায়গায় আসছেন। কমলাপাড়ায় ৩টি মুরং পরিবার আছে। প্রত্যেক পরিবারই তুলার কম্বল তৈরিতে অভ্যস্ত।
আরও পড়ুন-
** আত্মশুদ্ধির আহ্বানে আকাশে শতো ফানুস
** মেঘ ফুঁড়ে পাহাড়ের গায়ে রোদ বাতি!
** জলের ওপর বসতভিটে
** হ্রদের জলে কার ছায়া গো!
** সড়ক যেন আকাশছোঁয়ার খেলায় (ভিডিও)
** সাজেকের ভাঁজে ভাঁজে প্রকৃতির সাজ
** মানিকছড়ির ফুলের ঝাড়ুতে পরিচ্ছন্ন সারাদেশ
** নট ইউজিং ‘ইউজ মি’
বাংলাদেশ সময়: ০৫৫২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৬
এইচএ/এএ/